দু’জাহানের বাদশাহ হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.)-র আগমন এবং নবী প্রেম

42

অধ্যাপক মোহাম্মদ শাহজাহান

আচ্ছালাতু আচ্ছালামু আলাইকা ইয়া রাসূল আল্লাহ(সা.), আচ্ছালাতু আচ্ছালামু আলাইকা ইয়া হাবিব আল্লাহ(সা.),
আচ্ছালাতু আচ্ছালামু আলাইকা ইয়া রাহমাতুল্লিল আলামিন (সা.)। লক্ষ, কোটি দরুদ ও সালাম পেশ করছি অন্ধকার যুগের তমসা থেকে সমগ্র জাহানের মুক্তির দূতরূপে শান্তি, সাম্য, ঐক্য, কল্যাণের শুভ সংবাদ নিয়ে মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশে প্রেরিত হওয়া প্রিয় নবী, শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি। যিনি পৃথিবীতে আবির্ভূত হন এমন এক কঠিন সময়ে যখন সমগ্র পৃথিবী আইয়ামে জাহেলিয়াতের মধ্যে নিমজ্জিত ছিল। কোথাও শান্তি ছিল না, স্বস্তি ছিল না, ধর্মের নামে অধর্ম বিরাজ করছিল সর্বত্র। শিরক ও কুফরের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল সবাই। নারীদের সম্ভ্রম লুণ্ঠিত হচ্ছিল অবলীলায়, কন্যাসন্তানকে দেয়া হচ্ছিল জীবন্ত কবর। মারামারি, হানাহানি, খুন-খারাবির উন্মত্ততায় গোটা সমাজ ছিল টালমাটাল, পৃথিবীর সেই করুণ অবস্থা নিরসনের জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার প্রিয় হাবিব হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে সিরাজুম মুনিরা বা প্রদীপ্ত চেরাগরূপে ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার সুবহে সাদিকের সময় এই ধরার বুকে প্রেরণ করলেন। দোজাহানের বাদশাহর আগমন দিনের খুশিই পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)।
সৃষ্টির শুরু থেকেই উভয় জগতে আল্লাহ তায়ালা তাঁর সব রহমত ও দয়া এ নবীর উসিলায় প্রবাহিত করছেন। মহানবী (সা.)-এর আগমনের দিন পবিত্র ১২ রবিউল আউয়াল বিশ্ব ভুবনের জন্য নিঃসন্দেহে রহমত ও বরকতময়। নবীজির আগমনে ইবলিশ ছাড়া সবাই খুশি। বিশ্ববাসী আমরাও খুশি।
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বিশেষ কোনো জাতি বা গোষ্ঠীর জন্য প্রেরিত হননি; তিনি কোনো বিশেষ দেশ বা অঞ্চলের জন্যও প্রেরিত হননি; তিনি প্রেরিত হয়েছেন সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য। রব্বুল আলামিন বলেন: ‘আর আমি আপনাকে পাঠিয়েছি সমগ্র মানবতার জন্য সুসংবাদদাতা ও সাবধানকারী হিসেবে; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না।’ (সুরা-৩৪ আস সাবা, আয়াত: ২৮)। কোরআন মজিদে আল্লাহ রব্বুল আলামিন ঘোষণা দিয়েছেন: ‘হে নবী (সা.)! আমি আপনাকে বিশ্বজগতের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।’ (সুরা-২১ আল আম্বিয়া, আয়াত: ১০৭)।
কোরআন ও হাদিসের আলোকে আমরা জানতে ও বুঝতে পারি ইমামুল আম্বিয়া, সাইয়িদুল মুরসালিন, খাতামুন নাবিয়্যিন মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.) হলেন আল্লাহর প্রিয় হাবিব, প্রিয় বন্ধু। আল্লাহর ভালোবাসা বা বন্ধুত্ব পেতে হলে প্রিয় নবী (সা.)-এর আনুগত্য স্বীকার করতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘হে নবী (সা.)! আপনি বলুন, তোমরা যদি আল্লাহর ভালোবাসা পেতে চাও, তবে তোমরা আমার নবী (সা.)-এর অনুসরণ করো; তাহলেই আল্লাহ তাআলা তোমাদের ভালোবাসবেন।’ (সুরা- আলে ইমরান, আয়াত: ৩১)।
সেই মর্মে তিনি ঘোষণা করেন: ‘আমার উম্মতের বড় বড় গুনাহগার অপরাধীদের জন্যই আমি সুপারিশ করব।’ (সহিহ্ বুখারি শরিফ)। সুপারিশ লাভের উপায় সম্পর্কে তিনি বলেন: ‘যে আমার রওজা শরিফ জিয়ারত করল তার জন্য সুপারিশ করা আমার ওপর ওয়াজিব হয়ে গেল।’ (বুখারি শরিফ ও মুসলিম শরিফ)।
কারণ আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘আমি আপনার অসিলায় আপনার (উম্মতের) আগের পরের সব গুনা মাফ করে দিয়েছি। ’ (সূরা ফাতাহ, আয়াত: ২)।
সুতরাং আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) কোনো একটি বিশেষ দল বা স¤প্রদায়ভুক্ত নবী ছিলেন না এবং তিনি ছিলেন সমগ্র বিশ্বের মানুষের জন্য বিশ্বনবী। কারণ তাঁর পর দুনিয়ায় আর কোনো নবীর আগমন ঘটবে না। এই প্রসঙ্গে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘অন্য নবীরা তাঁদের নিজ নিজ স¤প্রদায়ের প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন, আর আমি বিশ্বের সব মানুষের জন্য প্রেরিত হয়েছি।’ তাই বিশ্বের সব মানুষের কাছে দ্বীনে মুহাম্মদীর প্রকৃত দিকনির্দেশনা পৌঁছে দেওয়ার প্রক্রিয়া ও কার্যক্রমই পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) মূল উদ্দেশ্য। বর্তমান মুসলিম উম্মাহর এই সংকটময় অবস্থা থেকে উত্তরণ ও ইসলামের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের প্রধান উপায় হচ্ছে প্রিয় নবীকে ভালোবাসা ও অনুসরণ করা।যেহেতু রাসুলের প্রতি ভালোবাসাকে আল্লাহ তাঁর প্রতি ভালোবাসার মাপকাঠি হিসেবে ঘোষণা করেছেন, সেহেতু রাসুলপ্রেমই আল্লাহপ্রাপ্তির পূর্বশর্ত! যার ভেতর রাসুল (সা.)-র প্রতি ভালোবাসা নেই, সে মুমিন হতে পারে না। শুধু বাহ্যিক সুন্নাত পালন রাসুল (সা.)-র প্রতি প্রেম নয়। বাহ্যিক সুন্নাহর সঙ্গে আন্তরিক ও আত্মিক সম্পর্ক থাকতে হবে এবং এ আত্মিক সম্পর্কের ফলে প্রেমিকের দৃষ্টিতে শুধু প্রেমাস্পদই বিরাজ করে। পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদযাপন করে সেই মহান রবের নিয়ামত প্রিয় নবীকে স্মরণ করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার মধ্যেই রয়েছে দুনিয়া ও আখিরাতের মুক্তির পথ ও পাথেয়। আল্লাহ তাঁর হাবিব (সা.)-এর আগমনের মাসের উছিলায় আমাদের কবুল করুন। আমাদের সবার অন্তরে আল্লাহ ও রাসুল (সা.)-এর মোহাব্বত দান এবং তাঁর আদর্শ অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন এবং কিয়ামত দিবসে তার সুপারিশ আমাদেরকে নসিব করুন।
অতএব পৃথিবীর সব মুমিন মুসলমান রাসুল (সা.)-এর দেখানো শান্তির পথে পরিচালিত হোক, আমিন।
লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক