দলীয় গণতন্ত্র চর্চার এ উদ্যোগ অব্যাহত থাক

45

গণতন্ত্রের সফল বাস্তবায়নের জন্য তৃণমূল পর্যায়ে গণতান্ত্রিক চর্চার আবশ্যকতা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। মধ্যযুগীয় গণতান্ত্রিক চর্চার চারণক্ষেত্রে আরবভূমিতে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয় খোলেফায়ে রাশেদীনের যুগে। হযরত আবু বককর (রা.আ.) প্রথম ভাষণে বলেছিলেন ‘যতদিন আমি সত্য ন্যায়, আল্লাহ এবং রাসুল (স.) পথ অনুসরণ করে চলবো ততদিন আপনারা আমাকে সমর্থন করবে’। হযরত ওমর ফারুক (রা.) প্রতিবাদী যুবকের প্রতিবাদকে আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করে বলেছিলেন আমার থেকে পরনের কাপড়ের ঘাটতি থাকাতে আমার পুত্রের দেয়া আর একখণ্ড কাপড় নিয়ে সে ঘাটতি পূরণ করেছি, তাই আমার পরনে ২ খণ্ড কাপড় শোভা পাচ্ছে। আল্লাহর কাছে দু’হাতে উত্তোলনপূর্বক শোকর গুজর করে বললেন, হে আল্লাহ তোমার কাছে শোকর আমার সামরাজ্যে আমার মতো পরাক্রমশালী ওমর ফারুকের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করার মতো এক সাহসী যুবক তুমি দিয়েছো। হযরত ওসমান গণি(রা.) অভাবী এক লোকের অভাঙঘুচাতে বললেন, তাকে জায়গা দিয়ে মাল বোঝাই করা আমার উটের কাফেলা আসছে সেটা তোমার পছন্দ সেটাই তুমি নিয়ে নিও। লোকটা তার পছন্দের উটের রশিধরে টানলে সমস্ত উট লোকটিকে অনুসরণ করলে ব্যাপারটা খলিফার গোচরে আনা হলে খলিফা ওসমান গণি(রা.) লোকটিকে কাফেলাভুক্ত সব উটগুলো নিয়ে যেতে নির্দেশ দেন। অর্থাৎ জনগণের অধিকার এবং অভাব অভিযোগের প্রতি সদা সতর্ক থেকে যেকোন কিছুর বিনিময়ে গণতন্ত্রের সমুন্নত রাখতে সদা সচেষ্ট ছিলেন।
গত ৭ ডিসেম্বর ২০১৯ উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনকে ঘিরে এক সংবাদ শিরোনাম চাপা হয় ‘ কে হচ্ছেন সভাপতি ফজলে করিম নাকি এম এ সালাম’? অধিকতর ছোট্ট অক্ষরে লিখিত ছিলো ‘সমঝোতা না হলে ভাগ্য নির্ধারণ করবেন ৩৬৬জন কাউন্সিলর’। উভয় নেতা দারুণ সাহসী বটে। নির্বাচনের মাধ্যমে ভাগ্য নির্ধারনি পরীক্ষায় উভয় নেতা অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপনে সাহসী ভূমিকা নিয়ে মাঠে নামেন লালদিঘীর ময়দান তথা মুজিব পার্কে সকাল ১০ টায় অনুষ্ঠিত হবার কথা চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলন। উৎসুক চিত্তে সম্মেলন স্থলে একটু ঘুরে আসলাম।
চট্টগ্রাম মহানগর বা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন এখনও বাকী। উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের ৭টি উপজেলার সম্মেলন ধারাবাহিকভাবে সমাপ্ত। এ সাফল্যের জন্য উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ অবশ্যই কৃতিত্বের দাবীদার,তা সমাপ্ত করে। উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ ১০-১২ হাজার নেতাকর্মীর উপস্থিতিতে প্রকাশ্যভাবে উৎসাহ, উদ্দীপনার মাধ্যমে তাঁদের সম্মেলন সমাপ্ত করতে পেরেছেন। সম্মেলন বলতে সাধারণত যা কিছু দেখা যায়, অর্থাৎ আধিপত্য, গ্রুপিং, লবিং, অনুচিত প্রভাব এসব কিছু থেকে উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের এবার সম্মেলন মুক্ত ছিলো একথা আগ থেকে ধারণা করা গেছে। কারণ নেতাকর্মীরা বলেছিলেন, সমঝোতা না হলে সভাপতি পদে এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী ও এম এ সালামের মধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। এদুজন নেতা অত্যন্ত দৃঢ়চিত্তে সাহসী মন নিয়ে কাউন্সিলরদের ভোটাভুটির মাধ্যমে সভাপতি নির্বাচিত হবার বিষয়টা মেনে নিয়েছেন। সমঝোতা কিংবা কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকে ৩৬৬জন কউন্সিলরের মতামতই গ্রাহ্য হয়ে নতুন নেতৃত্ব সৃজন হবার বিষয়টা প্রাধান্য পায়। অথচ কেউ কেউ সন্দিহান ছিলো কাউন্সিল অধিবেশন নিয়ে এবং এতদ্ব্যাপারে বিকল্প করনীয় স্থির করা হয়েছিলো। সমস্ত জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে দ্রুতমত সময়ের মধ্যে দিয়ে উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ এক ভিন্ন চমক সৃষ্টি করে গণতান্ত্রিক মানসিকতাকে উজ্জ্বীবিত করে অপ্রতিদ্ব›দ্বী সুনাম অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। Challenge should be faced by the challenge. মোকাবিলাকে মোকাবিলার মাধ্যমেই রুখে দিতে হবে সেটাই হচ্ছে বীরত্ব। নেতৃত্বের জন্য এমন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকা বাঞ্জনীয়। দুই নেতার মনের জোরের কোন ঘাটতি লক্ষ করা যায়নি। দুই সাধারণ সম্পাদক প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সকাল ১০ টার দিকে সংঘর্ষ ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে যার সচিত্র প্রতিবেদন চেয়ার ছোড়াছুড়ি পত্রিকার পাতায় দেখা গেছে। সম্মেলন ঘিরে এটা আলাদা আমেজ সৃস্টি করলে ও তা অত্যন্ত দৃস্টি কটু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় এ ঘটনা সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। তবে পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শীতল হয়েছিলো। সম্মেলনের প্রথম অধিবেশন লালদিঘীর মাঠে সমাপ্ত হয়ে দ্বিতীয় অধিবেশন কাজীর দেউড়ি ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টারে ৫০০ জন পুলিশ বেষ্টনীর মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়। ২০০ জন পুলিশ ছিলো শুধু কাউন্সিলস্থলে। আশেপাশের সবকিছুই ছিলো পুলিশের নিয়ন্ত্রণে। ভোটাভুটির মাধ্যমে নেতা নির্বাচন পরীক্ষা কাউন্সিলরদের প্রত্যক্ষ ভোটে সভাপতি পদে এম এ সালাম সাধারণ সম্পাদক পদে শেখ আতাউর রহমান নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাহেব স্বগর্বে জয়ী প্রার্থীদ্বয়ের নাম ঘোষণা করলেন। ৩৬৬ জন কাউন্সিলর বাছাই করলেন তাদের নেতৃত্ব। এম এ সালাম ২২৩ ভোট এমবিএম ফজলে করিম মাননীয় এম পি মহোদয় পেছেন ১২৯ ভোট। পক্ষান্তরে সাধারণ সম্পাদক পদে আতাউর রহমান পেয়েছেন ১৯৬ ভোট গিয়াস উদ্দিন পেছেন ১৫৪ ভোট। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কাউন্সিলরদের মূল্যায়ন করা হয়েছে। অর্থাৎ তাদের ইচ্ছার প্রতিফলন হয়েছে তারা অসহায়, নীরব দর্শক নয়। এক্ষেত্রে নেতা মূল্যাবান উপাদান গণতন্ত্রের প্রবক্তা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট লিনকনের মতে Democracy is the institutionalization of freedom ‘গণতন্ত্র হচ্ছে মুক্তির প্রাতিষ্ঠানিকতা ’ তাঁর বিখ্যাত গেটিসবার্গ বক্তৃতা যা ১৯.১১.১৮৬৩ সালে গৃহযুদ্ধকালীন সময়ে প্রকাশিত হয়। গণতন্ত্রকে তিনি অত্যন্ত সহজ বোধগম্য ভাষায় সংজ্ঞায়িত করেছে, তাঁর মতে Democracy is a government of the people, by the people and for the people গণতান্ত্রিক সরকার, জনগণের, জনগণের দ্বারা এবং জনগণের জন্য। একেইভাবে একটা গণতান্ত্রিক সংগঠনে নেতৃত্ব সৃষ্টিতে গণতান্ত্রিক চর্চা অত্যন্ত উত্তম পথ। এ চর্চা অনুসৃত হলে আওয়ামী লীগের শক্তি সামর্থ উত্তর উত্তর বৃদ্ধি পাবে। কাউন্সিলর ও ডেলিগেটদের উদ্দেশ্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে নবনির্বাচিত সভাপতি এম এ সালাম এর বক্তব্য প্রাণিধানযোগ্য ‘ আমি সবার প্রতি কৃতজ্ঞ। যারা ভোট দিয়েছেন বা যারা দেননি সবাইকে নিয়ে সংগঠনকে শক্তিশালী করতে কাজ করবো’। তাঁর এ উক্তি গণতন্ত্রের জন্য শক্তি যোগাবে দেশে গণতন্ত্রের পথ সুপ্রশস্থ হবে। এটাই নিঃসন্দেহে আশা করা যায়।

লেখক : কলামিস্ট