তন্হা নিযামীর কাব্যে বহুমাত্রিকতা

46

 

মাওলানা মুতিয়ূর রহমান নিযামী (১৯০৫-১৯৮৬) ছিলেন ধর্মতত্তে¡র শিক্ষক- উঁচুমানের মুহাদ্দিস। আপাদমস্তক এ শিক্ষক প্রকৃতিগত ভাবে ছিলেন কবি। সেকালে তাঁর শিক্ষা-মাধ্যম উর্দু হবার কারণে, অথবা উর্দু তাঁর নিকট স্বচ্ছন্দ ছিল বলে তিনি প্রধানত কাব্যচর্চা উর্দুতে করেন। এদেশেই তখন উর্দুর পাঠক শ্রোতা ছিল বিস্তর। মাওলানা নিযামী উর্দু, ফার্সী ও আরবী ভাষায় কবিতা লিখেছেন। প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন বাংলায়। ভাষা ও বিষয় বৈচিত্র্যে এই কবির বহুমাত্রিক প্রতিভা সমকালে বিস্ময়ের হেতু ছিল।
এতো বড়মাপের কবি-অথচ প্রচারে একবারে বিমুখ থাকতেন। লেখা ছাপা, প্রকাশ করার ব্যাপারে তেমন আগ্রহী মনে হতো না। এ বিষয়ে তার বক্তব্য ঃ “কাব্যচর্চাকে কখনো আমি নেশা অথবা পেশায় পরিণত হতে দেইনি। এমনকি দীর্ঘদিন কোন কবিনাম (তখল্লুস্) ও গ্রহন করিনি।”
-নসীমে মশরিক ; আরজেহাল
সেই আপেশাদার কবি, তন্হা নিযামী (ততোদিনে তিনি ‘তন্হা’ উপনাম ব্যবহার শুরু করেছেন) কবিতার ভাষার সঙ্গে বিষয় বৈচিত্র্য নিয়ে এসেছেন। বিশেষ করে ফার্সী ও আরবী ভাষার বিখ্যাত কবিদের ত্রূটি নির্দেশ তাঁর কবিতার একটি লক্ষণীয় ব্যাপার হয়ে ওঠে। চিন্তাজগতে কতোটা ব্যুৎপত্তি থাকলে মাওলানা জালালুদ্দীন রুমীর সমালোচনা করা যায়! সকলেই জানি মাওলানার ‘মসনবী শরীফ’ কুরআন-কল্প এক অসাধারণ তুলনাহীন মহাকাব্য। মসনবী সম্পর্কে রুমীর প্রযত্নে এই চরণটি বহুল প্রচলিত ঃ
মান যে কুরআঁ মাগ্য রা বরদাশ্তম
এসতেখাঁ রা বর সগা আন্দাখ্তাম।
অর্থ- আমি আহরণ করেছি কুরআনের মগজ। অবশিষ্ট হাড্ডি কুকুরের জন্য রেখে দিয়েছি।
কিন্তু চাঁদেও কলঙ্ক থাকে। রুমী তো আর আর যাই হোন নবী নন। তাই ভুল হওয়া বিচিত্র নয়। তন্হা নিযামী মুহদ্দিসের বিচারবোধকে কাজে লাগালেন, বললেনঃ
জুম্লা কুরআন মগ্য বাশদ বেগুমা
বাদ কুরআন রাশ গোয়ম এসতেখাঁ
র্হফে র্হফেও জযবকুল মগজিস্ত আয্উ
খেশরা তু এসতেখানে সগ্মগো।
অর্থ-সন্দেহ নেই যে কুরআন আদ্যোপান্তই মগজ।
তাহলে অংশত কুরআন কি করে হাড্ডি হয় ? কুরআনের প্রতিটি অক্ষর মগজ। অংশত কুরআন কখনো হাড় হতে পারে না। (নসীম মাশরিক ; পৃঃ২৯)
ভাবতে অবাক লাগে, উলামা-জ্ঞানীজন মসনবীর তারিফ করতে যেয়ে এতোকাল সানন্দে যে কবিতার উদ্ধৃতি দিয়েছেন তার ফাঁকটা-তন্হা নিযামীর সূ²দৃষ্টিতে পরিস্ফুট হয়েছে!­
পাঠক একমত হবেন যে, কুরআন তো পুরোটাই সমান গুরুত্বপূর্ণ !
আল্লামা ইকবাল বিশ শতকে ইসলামের ব্যাখ্যাতা হিসাবে পরিগণিত মণীষা। তাঁর কাব্য ভারত তো বটেই এবং পাশ্চাত্যেও সাড়া জাগিয়েছে। ইকবালের বিখ্যাত এক কবিতার মর্ম তন্হা নিযামীকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। সেটি এই ঃ
মিঠা দো আপনি হাস্তিকো আগর কুচ মর্তবা চাহো,
কেহ্ দানা খাকমে মিল্কর গুলো গুলজার হোথা হ্যায়।
অর্থ : সম্মান চাও তো অহংকে বিনাশ কর। যে রকম বীজ মিশে যেয়ে ফুলে-ফুলে শোভিত হয়।
তানহ নিযামী মনে করেন ইকবালের এই বক্তব্য একালে মুসলমানদের জন্য ক্ষতিজনক। এ বিষয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া ঃ
খুদী র্ক বুলন্দ্ আপ্নি, নহ্ মিট্ যা খাক্মে মুসলিম
তেরে দুশমন বুলন্দী মেঁ ফলক দৌয়ার হোথা হ্যায়।

৮ ফেব্রূয়ারি ছিল কবি তনহা নিযামীর মৃত্যু দিবস
বাড়াহ দে ইলম ও হিকমত কো, কেহ্ কেহ তু ভী চান্দ তক পহুঁচে
হুনরমন্দী সে ইনসান, চাহেবে কেরদার হোথা হ্যায়।
নহ কর যায়ে উমর আপনি বুজর্গি কী নুমায়েশ মেঁ
নিকম্মা খুশ্ক যাহেদ সে খুদা বেজার হোতা হ্যায়।
ফানাহকে ঘাট পহুঁচায়া আজিমুশশান মুসলিম কো
ওহী আব্ কেহ্তে ফিরতে হেঁ, গুলো গুলজার হোতা হ্যায়
অর্থ- অহংকে উচ্চে তোল, মুসলমান মাটিতে মিশে যেয়ো না,
তোমার শত্রূর অবস্থান ওপরে, (সে) ভূমন্ডল নিয়ন্ত্রণ করছে।
জ্ঞান-বিজ্ঞান বৃদ্ধি কর, যেন তুমিও চাঁদে পৌঁছাতে পার।
মানুষ প্রযুক্তি গুণে নেতৃত্ব অর্জন করে থাকে।
বুজর্গির ধোঁকায় পড়ে জীবন অপচয় করো না,
অকর্মণ্য নিরস ইবাদতকারীর উপর খোদা অসন্তুষ্ট হন।
বিপুল মর্যাদার মুসলমান এখন ধ্বংসের শেষ প্রান্তে আর
সেই কি না এখন বলছে ‘ফুলে ফুলে শোভিত হয়।’
হাফিজ শিরাজী ফার্সীর শ্রেষ্ঠ কবি। তাঁর কাব্যপ্রীতি সমগ্র বিশ্বে পরিব্যাপ্ত। হাফিজের গজলের বহুল কীর্তিত একটি চরণ ঃ
বে মেই সাজ্জাদা রাঙ্গী কুন-গারাদ পীরে মোগাঁ গোয়াদ
কেহ্ ছালেক বেখবর না’বুয়াদ যে রাহ্ রাসমে মনযিল্হা\
দিওয়ানে হাফিজ এর প্রথম গজলের ৪র্থ চরণের উচ্চ-আধ্যাত্মিক এই ভাবটি সাধারণ-মনে ভ্রম উৎপাদন হতে পারে; এই আশংকা থেকে তন্হা নিযামীর উক্তি ঃ
কাহা হাফিজনে সজ্জাদা রাঙ্গা দো, শারাবে মারেফত্সে হোগা বেহতর
লাগা কর হম ম্যয়ে বাজার উস্মে, মুছাল্লা কো কিয়া বরবাদ এক্সর।
অর্থ : হাফিজ বলেছেন মারেফতের শরাবে জায়নামায রঙ্গীন কর। আমি বাজারের শরাব দিয়ে অহেতুক জায়নামায নষ্ট করলাম। আরবী কবিতায় তন্হা নিযামী কতো স্বচ্ছন্দ ছিলেন নিম্নের কবিতাংশটিতে বোঝা যায় ঃ
বিগাদ্দির র্ত্বাফি য়ান্চাহুলী কছীর
বিদ্বব্তিল হুসনি লা য়ূছিঈহা আহাদ
হাদীছুন তা-ল মিন্নী তৌলাল লাইল
ওয়া ইনদাচ ছুবহু ‘ক্বালা মা সামেএতু!
অর্থ : অনেকে আমাকে উপদেন দেন – দৃষ্টি আনত কর
কিন্তু যে রূপ দেখিয়ে বেড়ায় তাকে তো কেউ বারণ করে না।
রাতভর গল্প হলো, ভোরে সে বলছে- কি যেন বলেছিলে?

নিযামী কাব্যের একটি লক্ষণীয় দিক বিষয়-ভাষার বহুমাত্রিকতা-পাঠক মাত্রেই বিস্ময়াভিভূত করে।