ট্রেন দুর্ঘটনা ‘আমি জীবিত আছি’, লাশের সারিতে শব্দ!

74

সৈকত প্রায় চার ঘণ্টার মতো ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতাল মর্গে লাশের সারিতে পড়েছিল। জ্ঞান ফিরলে বলছিল, আমি জীবিত আছি, আমাকে হেল্প করুন। হয়তো গলার স্বর এত ক্ষীণ ছিল যে কেউ খেয়াল করেনি। আর সেদিন সেখানকার পরিস্থিতিও তো খুব খারাপ ছিল রোগীদের নিয়ে। তাই হয়তো ডেডবডির দিকে কেউ খেয়াল করেনি, বলছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত সৈকতের ছোট চাচা জাহিদ হাসান। গতকাল বুধবার সকালে কথা হয় তার সঙ্গে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের পুরাতন ভবনের একটি ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছেন সৈকত। এ প্রতিবেদক যখন সেখানে যান তখন সৈকতকে সিটিস্ক্যান করার জন্য নেওয়া হয়েছে। সৈকতের বেডের পাশে দাঁড়িয়েই কথা হয় চাচা জাহিদ ও বাবা শহীদুল্লাহর সঙ্গে। সেদিন সৈকতকে মৃত ভেবে চিকিৎসার ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে জাহিদ বলেন, লাশের সারিতে মর্গে পড়ে থাকা অবস্থার কথা জানিয়ে সৈকত বলেন, মাথা-নাক-মুখ দিয়ে অনবরত রক্ত ঝরছিল। ওরা বারবার বলছিল, এখানে একটা ডেডবডি আছে। আমি শুনতে পাচ্ছি, আমাকে তারা ডেডবডি বলছে। কিন্তু কিছু বলতে পারছিলাম না। তখন আমার তো জ্ঞান ফেরে আবার জ্ঞান হারাই এমন অবস্থা। কিন্তু কিছু বলার মতো শক্তি বা অবস্থা কোনোটাই ছিল না আমার। ভাঙা ভাঙা উচ্চারণে, থেমে থেমে এসব কথা জানান সৈকত। সবাই ভেবেছিলেন সৈকত মারা গেছে, তাই তার দিকে কেউ খেয়াল করেননি। পরে কোনও রকমে সাহস করে নিজের শার্টের হাতা ছিঁড়ে মাথায় বেঁধে নিজেই গেছে একজনের কাছে। গিয়ে বলেছেন, আমাকে বাঁচান, আমার পরিবারকে জানান অ্যাক্সিডেন্টের কথা। খবর বাংলা ট্রিবিউনের
জাহিদ বলেন, এত রক্ত ঝরেছে, শার্ট প্যান্ট সব ভিজে শুকিয়ে শরীরের সঙ্গে শক্ত হয়ে গেছে। আমি নিজে সেসব গা থেকে খোলার জন্য কাঁচি দিয়ে কেটেছি। সৈকত কেবল একটা কথাই বারবার আমাকে বলছিল, কাকা আমি যুদ্ধ করে এ পর্যন্ত এসেছি, নিজে বেঁচেছি।
সৈকতের আঘাত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ওর মুখের ভেতরের দুই পাশের চোয়াল ভেঙেছে। একটা দাঁতও ঠিক নেই, কথা বলতে গেলে ভেতরের মাড়ি উঠে আসে। মুখের ভেতরের পুরোটাই ভাঙা, আছে মাথায় আঘাত, কোমরে ব্যথা আছে। রক্ত দেওয়া হয়েছে তিনব্যাগ, আরও রেডি করে রাখতে বলেছেন চিকিৎসক।
এরই ভেতরে সৈকতকে ট্রলিতে করে নিয়ে আসেন তার ভাই সাকিবসহ অন্যরা। সবাই মিলে ধরাধরি করে তাকে শোয়ানো হয় বেডে। বাবা শহীদুল্লাহ পরম মমতায় ছেলের গায়ে চাদর টেনে দেন। ছেলের মুখের কাছে গিয়ে জানতে চান, ‘কষ্ট হচ্ছে বাবা?’ সৈকত কিছু বলেন না, কেবল মাথা নেড়ে ‘না’ করেন।
সৈকতের বেডের পাশে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়েছিলেন বাবা। গ্রামের বাড়িতে কাঠমিস্ত্রির কাজ করা ৬৫ বছরের শহীদুল্লাহ জানান, সেদিন ভোররাতের দিকে সৈকতের ফোন থেকেই তার কাছে একটি কল আসে। অসময়ে ফোন আসায় কিছুটা অবাক হন তিনি। কিছুটা বিরক্তি নিয়েই ঘুমচোখেই কল রিসিভ করেন। কিন্তু যখন ওপাশ থেকে বলা হয়, আপনার ছেলে সৈকত ট্রেন অ্যাক্সিডেন্টে মারাত্মক আহত হয়েছে, তখন তার ঘুম উড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে আরেক ছেলে সাকিবকে জানান তিনি। সাকিব তখন সৈকতের নম্বরে কল-ব্যাক করলে জানানো হয়, সৈকত ব্রাহ্মণবাড়িয়া হাসপাতালে আছে, তারা যেন দ্রুত হাসপাতালে চলে আসেন।
নৈায়াখালীর দুর্গাপুরে সৈকতদের বাড়ি। তিনি পুরান ঢাকায় বোরকা তৈরির কাজ করেন। কয়েকদিন আগে তিনি সিলেট যান। দুর্ঘটনার দিন জয়ন্তিকা এক্সপ্রেসে সিলেট থেকে বাড়ি আসছিলেন, ফেনীতে নামার কথা ছিল। কিন্তু বাড়িতে আর আসা হয়নি, তার বদলে এখন আমরা সবাই হাসপাতালে, বললেন জাহিদ।