জীবিত মানুষ মৃত সুস্থ হয়েও অসুস্থ!

40

রাহুল দাশ নয়ন

ফটিকছড়ির হারুয়ালছড়ি এলাকার বাসিন্দা মো. আব্দুল ছত্তার। ৬২ বছর বয়স্ক এই ব্যক্তি ২০০৮ সালে ভোটার হিসেবে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) পান। কিন্তু করোনা মহামারিতে টিকা নিতে গিয়েই বিপত্তিতে পড়েন। বর্তমানে জীবিত থাকলেও ইসি সার্ভারে দেখা যায় তিনি মৃত। সার্ভারে স্ট্যাটাস আসে ‘ডেড’। যে কারণে তিনি টিকা দিতে পারেননি। প্রতিকার চেয়ে এনআইডি সংশোধনের আবেদন করেছেন।
ফটিকছড়ির লায়লা বেগম নামে এক নারীর ভোটার তালিকা থেকেই নাম বাদ পড়েছে। ইসি সার্ভারে লায়লা বেগমের ভোটার স্ট্যাটাস ‘ডিলেটেড’ হিসেবে উল্লেখ আছে। অথচ সার্ভারে থাকা ছবির মিল আছে। বর্তমানে এনআইডি সমস্যায় পড়ে সকল কাজে বাধার সম্মুখিন হচ্ছেন এই নারী। যে কারণে নিজের এনআইডি সংশোধন করে ভোটার তালিকার নাম বহাল রাখার আবেদন করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শুধু ছাত্তার বা লায়লা নন, এরকম অসংখ্য ভোটার এনআইডি সংক্রান্ত সমস্যায় পড়ে নির্বাচন অফিসে ঘুরছেন। এদের কেউ জীবিত হয়েও মৃত, সুস্থ হয়েও অসুস্থ কিংবা প্রতিবন্ধী, জীবিত থেকেও ভোটার তালিকায় নাম কর্তন হয়ে যাওয়ার মতো জটিলতায় পড়ে এনআইডি সংশোধনে নির্বাচন অফিসে ভিড় করছেন। এমন বিভ্রান্তিতে পড়ে চাকরিতে নিয়োগ, বিদেশ গমন, পাসপোর্ট বানানো, টিকা গ্রহণ, ব্যাংক একাউন্ট খোলাসহ নানা ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়ে চরম ভোগান্তিতে নাগরিকরা। ইতোমধ্যে চট্টগ্রামে এমন জটিলতা নিয়ে হাজার দেড়েক ভোটার ঘুরপাক খাচ্ছেন। জাতীয় পরিচয়পত্রের ছোটখাট ভুল সংশোধনে উপজেলা কিংবা জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাকে ক্ষমতা দেয়া হলেও সার্ভারে থাকা এমন ভুলের সংশোধনের ক্ষমতা রয়েছে নির্বাচন কমিশনের। যে কারণে উপজেলা, জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে ঘুরে ঢাকা থেকেই এই সমস্যা নিরসন করা হচ্ছে। এতে বাড়তি সময় যেমন লাগছে তেমনি নানা হয়রানির মুখোমুখি হচ্ছেন জনগণ।
জানতে চাইলে সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর হোসেন পূর্বদেশকে বলেন, ‘প্রতিদিনই ম্যাচ ফাউন্ড সমস্যাগুলো পাচ্ছি। এ পর্যন্ত হাজার খানেক অভিযোগ পেয়েছি।অভিযোগগুলো আমরা তাৎক্ষণিক ইসিতে পাঠিয়ে দিই। সেখান থেকে অনুমোদন হয়ে আসলেই সমাধান করা যায়। তবে অন্যান্য এনআইডি সংশোধনের মতো এমন জটিলতা সমাধানের ক্ষমতা আমাদের দিলে মানুষের উপকার হবে। ইতোমধ্যে বিষয়টি আমরা কমিশনে জানিয়েছি। সফটওয়ার সমস্যা ও আঙ্গুলের ছাপের মিলের কারণেই এমন সমস্যা হয়। তবে তা খুব বেশি না। লাখে হয়তো ১-২টা হয়। অচিরেই বিষয়গুলো সমাধান হয়ে যাবে।’
ফটিকছড়ির হারুয়ালছড়ি এলাকার ভোটার মো. আব্দুল ছত্তার পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমিতো জীবিত আছি। আমার বাবাও জীবিত। করোনা থেকে বাঁচতে টিকা দিতে গিয়েই বড় ঝামেলায় পড়ে যাই। ইউনিয়ন পরিষদসহ বিভিন্ন স্থানে গিয়ে টিকা আবেদন করতে পারি নাই। পরে নির্বাচন অফিসে গেলে জানতে পারি আমি মৃত। প্রশ্ন রাখলাম মৃত হলে এখানে কিভাবে আসলাম। পরে তারা একটি ফরম দিয়ে আবেদন করতে বললে আমি আবেদন করেছি। তিনমাস পরেই সংশোধিত কার্ড পাবো বলে জানিয়েছে নির্বাচন অফিস।’
আগ্রাবাদের সালেহ আহমদ লেনের বাসিন্দা জয়ন্তী সরকার স্বাস্থ্য সুরক্ষায় টিকা গ্রহণ ও ব্যাংক একাউন্ট খুলতে গিয়ে এনআইডি সমস্যায় পড়েন। এই মহিলার ভোটার স্ট্যাটাসে অন্যের সাথে মিল আসে। নির্বাচন অফিসে যোগাযোগ করলে বলা হয়, অন্যজনের সাথে আঙ্গুলের ছাপ মিলে যাওয়ায় এমন সমস্যা হয়েছে। আর এ সমস্যায় পড়ে এখনো টিকা গ্রহণ করতে পারেননি জয়ন্তী। জানতে চাইলে তার স্বামী নয়ন সরকার বলেন, ‘টিকা নিতে গিয়ে এনআইডি কার্ডের সমস্যাটি ধরা পড়ে। নির্বাচন অফিসে গেলে উনারা জানান ‘ম্যাচ ফাউন্ড’ আসছে। একটি আবেদন করেছি। এখন সংশোধনের জন্য অপেক্ষা করছি।’
রহমতগঞ্জ দেওয়ানজী পুকুর লেইন এলাকার ভোটার সৌরিনা দত্ত ঐশীও এনআইডি ভোগান্তিতে পড়ে টিকা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তাঁর পিতা অনুপম দত্ত বলেন, ‘মেয়ে টিকা দিতে নিবন্ধন করতে গেলেই জানতে পারে আঙ্গুলের ছাপের সমস্যার কারণে এনআইডি কার্ড ‘ম্যাচ ফাউন্ড’ আসছে। নির্বাচন কমিশনে যোগাযোগ করলে আবেদন করতে বলেন। দেড় মাস পর সংশোধিত কার্ড পাবো বলে উনারা জানিয়েছেন।’
নির্বাচন অফিস সূত্র জানায়, প্রতিদিনই জেলার কোনও না কোনও উপজেলা কিংবা থানা নির্বাচন অফিস থেকে এনআইডি সমস্যা নিয়ে আবেদন জমা পড়ছে। এ সমস্যাগুলোকে দ্রæত নিষ্পত্তি করতে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এগুলো সংশোধনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কাগজ হিসেবে ইউনিয়ন পরিষদের জীবিত মর্মে প্রত্যয়ন, সার্ভার কপি, জন্ম নিবন্ধন সনদ কপি সংগ্রহ করা হয়। সন্দ্বীপ, ফটিকছড়ি, লোহাগাড়া, রাঙ্গুনিয়া, বাঁশখালী ও নগরের কয়েকটি থানা নির্বাচন অফিসে এমন আবেদন বেশি জমা পড়ছে। প্রতিদিনই ২০-৪০টি আবেদন ঢাকায় পাঠানো হচ্ছে।
বাঁশখালী উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. ফয়সল আহমদ পূর্বদেশকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম থেকেই ম্যাচ ফাউন্ড সমস্যা সমাধানের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে শুনেছি। সার্ভারের সমস্যা সমাধানের কাজ চলছে। দ্রুত এমন সমস্যা কেটে যাবে। বাঁশখালী থেকেও এমন কিছু সমস্যা সমাধানের জন্য পাঠানো হয়েছে।’