জীবন যেখানে যেমন

68

আবদুল হাই

আজকে কোন সম্পাদকীয় নয়। জীবন যেখানে যেমন এমন বিষয়ভিত্তিক একটা লেখা লেখতে স্থির করেছি। বড়োছেলে ঢাকায়। টাকা কামাতে ঢাকা। উপযুক্ত হয়েছে। তাই ওকে আর বুকে জড়িয়ে আদর করা যায় না। তারপরও চট্টগ্রাম আসলে ওকে বুকে জড়িয়ে মনটা শীতল করতে ব্যর্থ প্রয়াস, আত্মীয়ের বাসাতে বিয়ে। একনাগারে তিনদিনের ম্যারাথন দাওয়াত। দাওয়াতে যেতে হবে ঢাকায়। পিলে গা চুমকে উঠলো। না গেলেই নয়। আমার সহধর্মীনির আত্মীয় বাড়ি। আমার কনিষ্ট তনয় রাশেদ, স্বীয় উদ্যোগে ট্রেনের আগাম টিকেট সংগ্রহ করে রেখেছে। ওরা দু’ভাই কোন আনন্দফুর্তির আয়োজনে ওরা সিদ্ধান্ত নিতে কুন্ঠাবোধ করেনা। আমাকে ৫ মার্চের টিকেটখানা হাতে তুলে দিয়ে ছোট ছেলে বললো পৌনে সাতটার ট্রেন। শীট নং-৪১, ৪২। সেদিনকার ঘড়ির কাঁটা দ্রæত চলছিলো। নাকি আমাকে এ্যাডভান্স করতে ঘড়ির কাঁটা ফাস্ট করে দেয়া হয় কি জানে। আমার স্ত্রী সাদামাটা সাজগোজ করে আমার চাইতে দ্রæততর সময়ে প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। রূপচর্চা যেন ভাটা পড়েছে। তাই চোখে কাজল আর ঠোঁটে লিপস্টিক মাখা হয়নি। আমি বললাম, ওমা এ-কি, সূর্যটা যেন আজকে পশ্চিম আকাশে উদিত হয়েছে। তার চাতুর্য্যতার সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে অনেক পূর্বেই ট্রেনের আসনে উপবেশন করলাম আমরা বুড়ো-বুড়ি। তখন হাতেগুনা জনকয়েক যাত্রী। অনেক গর্ববোধ করে নড়েচড়ে বসলাম। এবার মোবাইলে টিপ মেরে সময় দেখে নিয়ে। ছেলেকে বলি ‘বাবা’ এই দ্যাখো, এখন পৌনে সাতটা। কই ট্রেন ছাড়ছেনা কেন ? ছেলে আমার মুখ লুকিয়ে নিঃশব্দে হাসতে শুরু করে। যে বিষাক্ত হাসি আমার অন্তরে যেন সর্প-দংশনের মতো। তাকে ভর্ৎসনা না করে স্বীয় ক্ষোভকে নিয়ন্ত্রণ করে এ পর্যায়ে ওকে পরোক্ষ আঘাত করে বল্লাম ঘরে পৌঁছে ঘড়ির কাঁটাটা যথাস্থানে ঘুরিয়ে দিয়ো। তার অপকর্মের মর্মার্থ উপলব্ধি করে তার চেহেরায় তেতো হাসি দৃশ্যমান। আমার প্রতিক্রিয়া যেন কিঞ্চিত কাজ হয়েছে। আক্কেল বন্কা লিয়ে ইশরামে কাপি। অর্থাৎ বোধসম্পন্নদের জন্য ইঙ্গিতেই যথেষ্ট। তারপরও আমার রাশেদ দেখভাল করার ব্যাপারে কিঞ্চিৎ ক্রটি করেনি। আমাদের পত্রিকা কিনে দিলো, পানির বোতলের জন্য আন্তরিক দোয়া। ওদের সার্বক্ষণিক তদারকি আমাকে স্বর্গসুখ এনে দিয়েছে। এ পশ্চাতে দু’টো হেতু আমি ওদের মনখুলে ভালবাসি। আর অন্য কারণ হচ্ছে সন্তানদের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক। এর বিপরীতে আমার সন্তানরা আমাকে দারুণ ভালবাসে। যাক, কথার ওপর কথা এসে যায়।
আজকের ট্রেন ধরতে কোন বিড়ম্বনা পোহাতে হয়নি। তবে ঠিক আশির দশকের মাঝামাঝি একটি সময় আমার বিশেষ কাজে ঢাকা যাচ্ছি। আমার গিন্নী গোঁ ধরলো। আমাদের সহযাত্রী হবে। তার এ আবদার তুচ্ছ তাচ্ছিল্যভাবে অগ্রাহ্য না করে তার জন্যও টিকেট কেনা হয়েছিল্ োবন্ধু ইউনুছ বললো, তোমার টিকেট ও তোমার রমনীয় ঠিকেট তোমার কাছে রাখো। তুমিঐ রমনীকে নিয়ে একসাথে স্টেশন আসবে।ওর ভার ভরজা তুমিই নেবে। আমরা তখন নবদম্পতি। ওতো তারণ্যপূর্তি নবোপরিণিতা। স্বাভাবিকভাবে রূপচর্চায় অনুরুক্ত। ওর প্রতি আমার মোলায়েম ভালবাসা বিদ্যমান। আমার গিন্নী রূপচর্চায়মত্ত থাকতে থাকতে যথেষ্ট সময়ক্ষেপণ করেছে। আমার বারংবার তাগেদা ও তখন আমলেই নেয়নি। অনেক বিলম্বে স্টেশনে পৌঁছি। যখন পৌঁছি তখন অবলোকন করি আমাদের প্রকাশিত ট্রেন দ্রুুত এগিয়ে যাচ্ছে পশ্চিম দিকে। আমরা মিসিং ট্রেন যাত্রী। ফ্যাল ফ্যাল করে অসহায়ভাবে এক নাগারে ট্রেনের দিকে চেয়ে থাকালাম। কিছু বলিনি ওকে। এই বদহজমের বিষয় হজম করেছি। তারপরও ঢাকায় পৌঁছে বন্ধুদের সান্নিধ্য আসলাম, লজ্জার জড়সড় হয়ে। তখন অট্টোহাসির রোল। ইউনুছ বল্লো। গÐোগোল এই রমনী। ওর মুখ ব্যাঙ্গানো হাসি আর ঠাট্টা যেন আমার কাটা ঘা যে নুনের ছিটকার মতো বর্ষিত হলো। মিসিং ট্রেন যেন আজো স্মৃতি ময় হয়ে আমাকে মাঝে মধ্যে আহত করে।
ওর মাত্রাতিরিক্ত রূপচর্চার জন্য বন্ধুদের বিদ্রæপে শিকার হলেও গিন্নীকে নিয়ে কোন ঘাটাঘাটি করিনি। কারণ ওতো কোন ক্ষনিকের ভালবাসার কিংবা ভাললাগার ফুর নয়। তাই অতো নাড়ি নক্ষত্র পুনরাবৃত্তি করিনি। যা আজকের বার্ধক্যের রসাত্মক আমেজ। আমার নাতি-পতির হাস্য রসের বিষয়।
এখন সচরাচর নয়টা ট্রেন নয়টাতেই ছাড়ে এবং গন্তব্যস্থানে যথাসময়ে পৌঁছে। সময় এক আধটু নড়বড় হলেও তা যাত্রী সাধারণের জন্য তেমন ধর্তব্য বিষয় নয়। আমার ১০-১৫ মিনিট বিলম্বে পৌঁছি। প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আমার বড়ো ছেলে আরিফকে ফোন দেই। বিদ্যুৎ বেগে স্টেশন পৌঁছে। ও আমাদের দুজনকে ওর বাসায় নিয়ে যায়। ছেলে আমার উত্তরায় ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকে। ব্যাচেলর বাসা। লিফটে চার তলায়। দরজা খোলার পর ভেতরে নীত হলাম এলাহি কান্ড। ব্যাচেলর ঘর। গ্লাসের ছাউনীযুক্ত ডাইনিং টেবিল। বেশ কারুত্বযুক্ত ধূলোর আস্তর। দুপাশে উচ্ছৃঙ্খলে দুটো চেয়ার। একটির পৃষ্ঠে জায়নামাজ ঝুলছে। ডাউনিংটা ধূলোর আস্তÍরণে ধোঁয়াছে হয়ে গেছে। বিক্ষিপ্তভাবে নতুন পুরাতন জুতো স্যান্ডেল। অপ্রয়োজনীয় পানির প্লাস্টিক বোতলগুলো বস্তাভর্তি। ঘরে নতুন চালু সিলিং ফ্যান থাকলেও সিলিং এর হুকে সময়ের অভাবে আটকানো যায়নি, ঐ ডাইনিং রুমে। আমার যাওয়া কথা ছিলো তাই ব্যাচেলরা হালকা প্রস্তুতি নিয়েছে মনে করা যায়। ঘরের মেঝে ক্লান্ত হাতের অমনোযোগী ঝাড়–র স্পর্শে এক আধটু পরিষ্কার হয়ে ওঠেছে। পাকঘরের দৈন্যদশা, অর্থাৎ নেহাৎ প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছু নেই। মাত্র হাতেগুনা জনকয়েকের জন্য ওভার সাইজের দুটো কড়াই। দুটো ভাতের ডেকসী, ১টি পানির কলসী। বুয়ার পাক করা রান্না কড়াইয়ের তলানীতে। ভঙ্গুর প্রায় গ্যাস বার্নারে অতিরিক্ত সময় পর্যন্ত পানি সিদ্ধ হচ্ছে। ওখানে চায়ের কাপ ও পানির গøাসের অনুপস্থিত। একটি মগ এবং ৪-৫টি ম্যালামাইনের বাসন। ব্যাচেলরদের লবণ, মরিচ, হলুদ রাখার জন্য প্লাস্টিক ডিব্বা আছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত। চা খাওয়া বা কাকেও খাওয়ানোর অভ্যাস নেই।
ব্যাডরুমটাতে বেখেয়ালীপনার ছাপ। একটা ফোল্ডিং টেবিলে রকমারী কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বসার চেয়ারে সার্ট, প্যান্ট কোট, সুইটারে গিজ গিজ করছে। প্লাস্টিকের ছোট রেক মুদির দোকানকে যেন হার মানে। তাও এলাপাতাড়ি পরিত্যক্ত সম্পত্তির মতো। ব্যায়ামের কার্লিং অনুশীলনের জন্য লোহার ওয়েচ ও বারে যথেষ্ট মরিচা ধরা। জানলার সাথে ব্যাচেলার সাহেবদের কোট কভার ঝুলছে। ওখানে কোট থাকলে বেহাল দশাতো হবেই। সিলিং ফ্যান নতুন হলেও ঝাড়মুছের অভাবে পুরাতনের দৈন্যদশা। এককোণে প্লাস্টিকের ঝুড়ি উচ্ছিষ্ট পদার্থে পূর্ণ। বাথরুমের দৈন্যদশা। কোনদিন পরিষ্কারের গরজে হস্তস্পর্শ হয়েছে কিনা আল্লাহ মালুম জ্ঞাত, খাটের নতুন চাদর মাট্রোসের সাথে সে যে বিছানো হয়েছে কোনদিন ধোয়াতো দূরে থাক সাবান পানির মিশ্রণের ঝকঝকে হয়ে ওঠেনি। তারপরও যাই কই ব্যাচেলারে অতিথি হয়ে তথায় অবস্থানের সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার বাল্যবন্ধু আমিন, তার ছেলে আতিক ও আরিফ পরস্পর কক্ষসাথী। ব্যাচেলরদ্বয় অত্যন্ত সুদর্শন। চলচ্ছিত্রের নায়কী চরিত্রে নিশ্চয় ১ হয়ে যেকোন পরিচালক চুক্তি করতে বাধ্য হবে। সুন্দরভাবে ড্রেসআপ করলে নজর লাগার মতো। তাই দুজনকে চোখ তুলে তাকাইনা। ওরা নিজেদেরকে বেশ সাজাতে জানলে ঘর সাজাতে জানেনা। পুরুষদের কঠিনমত কাজ মশারী টাঙ্গানো। আমার ব্যাচেলরদ্বয় ঘরোয়া সব কাজে অনফীট। ঘর থেকে বের হয়ে জুতা পলিশ করাচ্ছে। বুট পলিশওয়ালা এক ঝাটকি মেরে ৩০টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। আমি প্রতিবাদ করি। বুট পলিশওয়ালা বলে স্যার গত ৬ মাসে এ জুতাতে ব্রাশের স্পর্শ লাগেনি। আমার ব্যাচেলর সাহেব একটু বিব্রতবোধ করেছে তা আঁচ করতে পেরে আমি উত্তরহীন থাকায় শ্রেয়মনে করি এসবতো টুকিটাকি। ওখানে আমার দু’জন কিভাবে পোষ মানিয়েছি। এপ্রসঙ্গে হাইলাইট না করে ইতি টানলাম।

লেখক : কলামিস্ট