জীবন ঘনিষ্ঠ কথা সাহিত্যের আধুনিক রূপকার

32

নাসিমা হক মুক্তা

প্রবাদ প্রবচনে পড়েছি “এক পয়সা বাঁচানো মানেই একটি পয়সা আয় করা” ঠিক তেমনি একজন অপুষ্ট জ্ঞানধারী পাঠক হিসেবে আমিও বলবো যে একটি শব্দ পড়া বা জানা একটি সাহিত্যকে জানা এবং নিজেকে সমৃদ্ধ করা।এই কাজটি যিনি করতে পারেন তিনি তার ভেতরের অন্তঃদৃষ্টির অন্ধত্বকে এড়িয়ে আলোর দেখা পান। আসলেই পৃথিবীতে কোন লেখক বা সাহিত্যিক বা মনীষী না পড়ে বিখ্যাত হননি। পাঠককে অনুসন্ধিৎসু হতে হয়। জানার আগ্রহ থাকলে পড়তেও বেশ লাগে। কোন অস্ত্রের শক্তি দ্বারা কোন এলাকা জোর করে দখল করাটা এক ধরনের আহাম্মকী। শিল্প- সাহিত্যের বিষয়টিও সে রকম। এইক্ষেত্রে সৎ, উদার ও দায়বদ্ধতা বিষয়ে আরও নিখুঁত থাকতে হয়। নিরপেক্ষ সাহিত্য একটি জগতকে আলোকিত করে এবং মানব সমাজে উৎকর্ষ ও আচরণিক শুদ্ধতা অর্জনের সহায়ক হয়। আমিও এই শুদ্ধতা অজর্নের গভীরে ডুবে মাঝে মাঝে অপরিপক্ক জ্ঞান নিয়ে কিছু দুঃসাহসিক কাজে হাত দিই, যা একেবারে আমার জন্য মহাসমুদ্রে নাবিক হীন নৌকা ভাসানোর মত। তবুও সাহিত্য কে পড়তে গেলে সুক্ষ একটি মন আমাকে বারবার ব্যাকুল করে তুলে” কোনো না কোনো কথাসাহিত্যিক, কবি, পন্ডিত বা মনীষীকে জানার আগ্রহ বেড়ে যায় । সে চেষ্টা থেকে আজ আমি হাতে তুললাম “পথের পাঁচালী” লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপ্যাধায় কে। তিনি এমন একজন লেখক যার লেখায় প্রকৃতি ও পল্লীগ্রাম মিলেমিশে একাকার। একেবারে জীবনের সাথে সম্পৃক্ত মা, মাটি ও প্রকৃতিকে নিজস্বতার বলয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পনৈপুণ্যের শৈলীতে। তার লেখা চলমান কালপ্রবাহের প্রাসঙ্গিক ও বাস্তবতার সুখ, দুঃখ, অভাব-অনটন ও মানুষের ইতিহাস রচনার অনন্য উদাহরণ। সাহিত্য সমালোচকেরা তাঁকে আনন্দ বাস্তবতা – বিরোধী, জীবন- পলাতক ও অতি- রোমান্টিক আনন্দ বললেও তিনি লেখায় প্রকৃতির ছায়াঘেরা পরিবেশকে স্বকীয়তায় তৈরি করেছেন।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় হচ্ছে উভয় বাংলার সাহিত্য জগতে গদ্যের অনন্য উচ্চতর এক উদাহরণ।তিনি প্রকৃতির কাব্যকার ও মানুষের জীবন ঘনিষ্ঠ গল্পোপন্যাসের রূপকার। তাঁর পিতা প্রখ্যাত সংস্কৃত পÐিত মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মাতা মৃণালিনী দেবী। পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার কাচরাপাড়ার নিকটবর্তী ঘোষপাড়া – মুরারিপুর গ্রামে মামার বাড়িতে ১ নভেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈত্রিক বাড়িী হচ্ছে বনগাঁর পাশে বারাকপুর গ্রামে। মহানন্দের পাঁচ সন্তানের মধ্যে বিভূতিভূষণ সবার বড়। তাঁর পিতার জীবন ছিল বোহেমিয়ান বা ভবঘুরে। ছোটবেলায় তার পিতার হাত ধরে পড়াশোনা শুরু।কিন্ত অভাবের টানাপোড়েনের কারণে সবসময় বেশির ভাগ সময় বাইরে থাকতে হতো, তবে সেই ফাঁকে মহানন্দ ভ্রমণও করতেন। বিভূতিভূষণও অনেকটা তাঁর পিতার স্বভাবের। স্কুল শুরু থেকে হেঁটে যাতায়াত করতেন। ঐ সময় প্রকৃতির নিসর্গ লীলা প্রাণভরে উপভোগ করতেন আপনমনে। হাঁটতে হাঁটতে একসময় প্রকৃতির প্রেমে এমনভাবে মজে যায় যে- অনেক সময় ঘর থেকে বের হয়ে মধ্যরাত অবধি সৌন্দর্য উপভোগ করতেন। সে কথাগুলোও তাঁর লেখনীতে ফুটে ওঠে। বিভূতিভূষণের পড়ালেখায় মহানন্দ বেশ সচেতন ছিলেন এবং তাই তিনি “বর্ণপরিচয়” টা মাসের প্রথমেই সাড়ে সাত আনা পয়সা দিয়ে পুরো মাসের জন্য এনে সযতেœ রাখতেন।তার বাবার সহযোগিতায় হরিরায়ের পাঠশালা,তারপরে হুগলি জেলার সাগঞ্জ – কেওটা, পরে বাসে করে বৌবাজারে আরপুলি লেনের পাঠশালা। অনেক দুর্গম পথ পাড়িয়ে দিয়ে বিভূতি প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন। পড়ালেখার বয়স সীমা অষ্টম শ্রেণিতে গেলে হঠাৎ তাঁর বাবা মারা যান। সংসারের সমস্ত চাপ তাঁর উপর এসে বর্তায়। ১৯১৪ সালে প্রথম বিভাগে এনট্রান্স পাস করে কলকাতার রিপন কলেজ থেকে তাও প্রথম বিভাগে আইএ এবং ১৯১৮ সালে ঐ কলেজ ডিসটিংশন নিয়ে বিএ পরীক্ষা পাশ করেন। পরে এমএ ও আইন বিষয়ে অর্ধেক করে ১৯১৯ সালে হুগলি জেলার একটি মাইনর স্কুলে শিক্ষকতার পেশা নেন। আইনের তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় বসিরহাটের মেয়ে গৌরীদেবীর সঙ্গে বিয়ে হয়। দুর্ভাগ্যক্রমে এক বছরের মাথায় বিসূচিকা রোগে তাঁর স্ত্রী মারা যান। তখন বিভূতিভূষণ মানসিকভাবে ভেঙে পড়লে সেই সাথে তাঁর পড়ালেখাও থেমে যায়। পরে হুগলির জাঙ্গিপাড়ার মাইনর স্কুলে শিক্ষকের চাকরি নেন, পরে সেখান থেকে সোনারপুরের হরিনাভি। এরপর তাঁর জীবনে আরও একটি দুর্ঘটনা ঘটে – তা স্ত্রী মারা যাওয়ার দুদশক পর। হঠাৎ ইছামতী নদীতে স্নান করতে নেমে ডুবে মারা যায় তাঁর ছোট জাহ্নবীদেবী। স্ত্রীর মৃত্যুর ২৩ বছর পর ফরিদপুর জেলার ছয়গাঁ গ্রামের ষোড়শীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে রমা দেবীর সাথে ৩ ডিসেম্বর, ১৯৪০ সালে তার পুনরায় বিয়ে হয় তাদের। রমাদেবীর পক্ষ থেকে বিভূতিকে বিয়ে করতে উদ্বুদ্ধ করে। সাত বছর পরে তাদের ঘরে একটি পুত্র তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের (বাবলু) জন্ম হয়।
বিভূতিভূষণের লেখালিখি জীবন ছিল খুব অল্প, মাত্র আঠাশ বছর। তাঁর আয়ু ছিল মাত্র ৫৬ বছর। এই অল্প জীবনে বাংলা সাহিত্যে যা দিয়েছেন তা এক্কেবারে শুরু থেকে বাজিমাত। বেঁচে থাকা সময়ে যা দিলেন – তার মধ্যে রয়েছে ২০টি গল্পগ্রন্থ, ১৫ টি উপন্যাস, ৭ টি কিশোর উপন্যাস, দিনলিপি ও ভ্রমণ কাহিনি। তাঁর প্রথম উপন্যাস হলো ‘ পথের পাঁচালী’। স্ত্রী মরার পর এই উপন্যাস তাঁর লেখালিখি শিথিল হলে তার বন্ধু নীরদচন্দ্র চৌধুরী তাঁকে তাগাদা দিতে দিতে – ১৯২৮ সালে প্রকাশিত হয়। সেই দিনই “বিচিত্রা” পত্রিকায় প্রকাশের জন্য কলকাতায় পান্ডূলিপি পাঠিয়ে দেন, কারণ বিচিত্রার সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর বন্ধু ছিল। তবে কোন এক অজ্ঞাত কারণে বইটি সেখান থেকে প্রকাশ হতে দেরি হয়েছিল। পরে “বিচিত্রা”- এ দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম সংখ্যা (আষাঢ়,১৯৩৫) থেকে ‘ পথের পাঁচালী” নিয়মিত কিস্তিতে প্রকাশিত হতে শুরু হয় এবং সমাপ্ত হয় ১৩৩৬ সালের আশ্বিন মাসে।ভারত সাহিত্য আকাদেমি কর্তৃক বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় তাঁর প্রথম উপন্যাসটির অনুবাদ প্রকাশিত হয়।
তাছাড়া ইংরেজি (অনুবাদক : টি. ডব্লু. ক্লার্ক ও তারাপদ মুখোপাধ্যায়, প্রকাশকালিন ১৯৬৮ খৃষ্টাব্দ) ফরাসি ভাষায় ও পথের পাঁচালী গ্রন্থটি অনুদিত হয়েছে। ফরাসি অনুবাদিকা মাদাম ফ্রাঁস ভট্টাচার্য; ১৯৬৯ সাল। রুশ ও জার্মান ভাষাতেও “পথের পাঁচালী” দ্বিতীয়াংশের (আম আঁটির ভেঁপু) অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এই উপন্যাসটি সত্যজিৎ রায় – চলচ্চিত্রে রূপায়ণ করেন।