জিয়ার আমলে ‘নির্বিচারে হত্যার’ তদন্ত হওয়া উচিত : প্রধানমন্ত্রী

25

পূর্বদেশ ডেস্ক

সাবেক সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের শাসনামলে অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের মধ্যে সামরিক বাহিনীর সদস্যদেরকে ’নির্বিচারে হত্যার’ ঘটনার তদন্ত হওয়া উচিত বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৬তম অধিবেশনে অংশগ্রহণ ও সফর নিয়ে গতকাল সোমবার গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে ওই সময়ের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে নিজের মনোভাব তুলে ধরেন সরকারপ্রধান। সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবও দেন।
একজন ভুক্তভোগীর কথা তুলে ধরে একজন সাংবাদিক সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন রেখেছিলেন, সেসব হত্যাকান্ড নিয়ে কোনো কমিশন গঠনের উদ্যোগ সরকার নেবে কি না। উত্তরে শেখ হাসিনা বলেন, ৭৭ সালে তখন ক্যুর নামে, বিশেষ করে বিমানবাহিনীর ৫৬২ জন অফিসারসহ বহু লোক সে সময় মারা গেছে, হত্যা করা হয়েছে। এর মাঝে আরও কয়েকটি ক্যু হয়, সেটা নিয়ে প্রায় দুই হাজারের কাছাকাছি বিমান ও সামরিক বাহিনীর অফিসারকে মারা হয়। তো আমরা দেখি, বিষয়টা নিয়ে যেহেতু দাবি উঠছে, আমাদের নিশ্চয় এটা নিয়ে একটা ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। এজন্য ভালো জনমতও সৃষ্টি হওয়া উচিত।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে একদল সেনা সদস্য। এরপর ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসা জিয়া সেনাপ্রধান হওয়ার পর ১৯৭৬ সালে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ক্ষমতা দখল করেন। তার পরের বছর তিনি রাষ্ট্রপতির পদও নেন।
জিয়া ক্ষমতা দখলের পর সামরিক বাহিনীতে অনেকগুলো বিদ্রোহ-অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয়, যাতে জড়িতদের সামরিক আদালতে বিচার করে মৃত্যুদন্ডসহ নানা সাজা দেওয়া হয়। ১৯৭৬ সালে এই রকম এক বিচারে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত কর্নেল আবু তাহেরের বিচার অবৈধ বলে রায় এসেছে উচ্চ আদালত থেকে।
নির্বাচন কমিশন কিভাবে গঠিত হবে এবং ভোটারদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে সরকার কি করছে, সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর সার্চ কমিটির মাধ্যমে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে। এখানে মহামান্য রাষ্ট্রপতি একটা সার্চ কমিটি করবেন তার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনারা তো বেশ কয়েকটি নির্বাচন দেখলেন। সর্বশেষ নির্বাচনে ভোটাররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিয়েছে। তবে অনেকে নির্বাচন নষ্ট করতে চায়। এরপরও নির্বাচন হয়েছে। তিনি আরও বলেন, বিএনপি যে নির্বাচন নিয়ে এতো প্রশ্ন তোলে, তাদের জন্মটা কিভাবে? তারা কি কখনো জনগণের দাবি আদায়ে কোনো আন্দোলন করেছে? তারা জানে নির্বাচনে তাদের কোনো সম্ভাবনা নেই। এ কারণেই তারা নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে নানা করা বলছে। তাদেরকে বাংলাদেশের মানুষ ভোট দেবে কেনো? তাদের এটা জিজ্ঞাসা করেন। তারা ক্ষমতায় আসার পর মানুষ কি পেয়েছে? কোনো সম্ভাবনা নেই, কোনো সুবিধা পাচ্ছে না বলেই নির্বাচন নিয়ে বিএনপির এত ক্ষোভ।
শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি যখন ক্ষমতায় আসে, তখন লুটপাট করেছে। একজন এতিমদের টাকা লুটপাট করে কারাভোগ করেছে। অপরজন ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে পলাতক আসামি হিসেবে বিদেশে অবস্থান করছে। কাজেই যারা নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তারা নিজেরাই তো অবৈধ। কিন্তু দেশে নির্বাচন হয়েছে বিধায় দেশ এখন স্থিতিশীল রয়েছে। উন্নয়ন হচ্ছে। আমরা উন্নয়নের পাশাপাশি মিডিয়া দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আপনারাই বলেন, এ অবস্থায় বিএনপিকে কে ভোট দেবে?
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানুষের ভোট নিয়ে যত কথা। আমরা আধুনিক প্রযুক্তিতে গেলাম। ইভিএমে ভোট হচ্ছে, সেটা নিয়েও প্রশ্ন। এরা যেহেতু সব সময় পরভাতে পালিত, এখন সেই জায়গাটা বোধহয় তাদের আর নেই। এজেন্সিগুলোর যে সুযোগ নিয়ে তাদের তৈরি করা হয়েছিল সেই এজেন্সিগুলো এখন যেহেতু বিএনপি ক্ষমতায় নেই, তাই তাদের নিয়ন্ত্রণও নেই। তারা তাদের সুবিধা পাচ্ছে না। আমরা তো সেভাবে তাদের ব্যবহার করি না। আমরা দেশের রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহার করি। দল ভাঙা, দল গড়া, দল করার জন্য তো ব্যবহার করি না। তারা সুবিধাগুলো পাচ্ছে না বলে হয়তো ক্ষোভ। তারা জানে যে জিততে পারবে না।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বার বার তাগিদ দেওয়ার পরও আশাব্যাঞ্জক সাড়া না পাওয়ার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, কোনো কোনো সংস্থা রোহিঙ্গাদের শরণার্থী করে রাখতেই বেশি আগ্রহী বলে তার মনে হয়েছে।
তিনি বলেন, মনে হয় রিফিউজি পালতে পারলে, এই পালাটাই একটা ব্যবসা কারও কারও জন্য। রিফিউজি না থাকলে তাদের চাকরিটাই থাকবে না। এটা হল আসল কথা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ (ইউএনজিএ)-এর ৭৬তম অধিবেশনে রোহিঙ্গা সমস্যা ও এর স্থায়ী সমাধানের বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়, যা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের উপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখবে বলে আমি আশা করি। বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনায় রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানের বিষয়ে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত থাকবে।
তিন বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কট সম্পর্কে আমি আবারও বিশ্বনেতৃবৃন্দকে স্মরণ করিয়ে দেই যে, রোহিঙ্গা সঙ্কটের সৃষ্টি মিয়ানমারে, সমাধানও রয়েছে মিয়ানমারে। রাখাইন রাজ্যে তাদের মাতৃভূমিতে নিরাপদ, টেকসই ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের মাধ্যমেই কেবল এ সঙ্কটের স্থায়ী সমাধান হতে পারে বলে উল্লেখ করে আমি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এ বিষয়ে গঠনমূলক উদ্যোগ গ্রহণ করার অনুরোধ জানাই।
বাংলাদেশ করোনার টিকা তৈরি করতে প্রস্তুত বলে জানান শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, মহামারির সময় কিছু শ্রেণি তাদের আর্থিক লাভ-লোকসানের দিকে যতবেশি তাকায়, মানুষের দিকে অত তাকায় বলে আমার মনে হয় না। শুধু আমার দেশে বলে না, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এটা লক্ষ্য করি। যে কারণে এটাকে অধিবেশনে টিকা সার্বজনীন করার জন্য বলেছি। সেই সঙ্গে এটাও বলেছি, বাংলাদেশ টিকা তেরি করতে প্রস্তত।
তিনি আরও বলেন, আমি ইতোমধ্যে ১০ একর জায়গা নিয়ে রেখেছি। সার্বিক ব্যবস্থা নিচ্ছি এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইতোমধ্যে টিকা বিষয়ক আন্তর্জাতিক জোট ও ডব্লিউএইচও’র সঙ্গে আলোচনা করেছে। আমরা বলেছি, আমরা ফর্মূলা চাই। আমরা সিড চাই এবং আমরা বাংলাদেশে এটা প্রস্তত করতে পারবো।
শেখ হাসিনা বলেন, গ্রাহকদের সাথে প্রতারণাকারী ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর টাকা কোথায় আছে তা খুঁজে বের করা হবে। আমরা চেষ্টা করব গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়ার।
তিনি বলেন, মানুষের দুঃসময়ে কিছু প্রতারক তাদের টাকা নিয়ে আত্মসাৎ করে। যখন এসব ‘হায় হায় কম্পানি’ তৈরি হয়, আপনারা (গণমাধ্যম) একটু সচেতন করলে মানুষ আর বিপদে পড়ে না।
তিনি বলেন, একবার যখন ধরা হয়েছে তখন টাকাগুলো নিয়ে কোথায় রাখল, কী করল, কী সম্পদ বানাল সেটাও খুঁজে বের করা হবে এবং আমরা চেষ্টা করে যাব এগুলো যদি ফেরত আনা যায়। তাদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা আমরা করব।
ঢাকা থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ড্রিমলাইনার নিয়ে জাতিসংঘ অধিবেশন উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার যে সমালোচনা বিএনপিসহ বিভিন্ন মহল করছে, তার জবাবও এক প্রশ্নে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, দুর্ভাগ্য যে, করোনার কারণে অনেক জায়গায় যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। বিমানগুলিকে প্রতিনিয়ত বসে থাকতে হয়, আর মেনটেইন্যান্সেরও একটা খরচা আছে। পড়ে থাকলেও কিন্তু ইঞ্জিন চালু রাখা, এটাকে ফ্লাই করানো এর পেছনে কিন্তু একটা খরচ হয়।
ঢাকা-নিউ ইয়র্ক রুটে বিমানের ফ্লাইট চালানোর যে স্লট ছিল, সেটা ফিরে পাওয়ার চেষ্টা চলছে বলে জানান সরকারপ্রধান। তিনি বলেন, আমরা যখন নতুন বিমানগুলো কিনলাম, সেটার সাথে সাথে আমাদের একটা প্রচেষ্টা ছিল ওই স্লটটাকে ধরে রাখা।
আমার চেষ্টা আমার দেশের ভাবমূর্তি তুলে ধরা। দেশের মানুষের কল্যাণ করা, দেশটাকে উন্নত করা এবং একটা আন্তর্জাতিক মর্যাদায় যেন আমার দেশের প্রতিটিপ্রতিষ্ঠান চলতে পারে, সেই জায়গটায় নিয়ে আসা। সেটুকু করে যাচ্ছি।