জালিয়াতি, প্রতারণা, নকল ও ভেজালের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান জরুরি

53

এমরান চৌধুরী

যেখানে বলতে গেলে দেশের প্রত্যেক মানুষ জীবন-মৃত্যুর মুখোমুখি, প্রতিদিন ঝরে পড়ছে প্রায় শত মানুষ, এমন কোনো দিন নেই যেদিন তিল তিল করে বোনা স্বপ্ন অপলকে ভেঙে পড়ছে না, এতিম হচ্ছে কোনো না কোনো ছেলেমেয়ে, স্বামী হারাচ্ছে তাঁর প্রিয় জীবনসঙ্গী, স্ত্রী বরণ করছে অকাল বৈধব্য, সেখানে একজন মানুষ হিসেবে আশা ছিল এই মানবিক বিপর্যয়ের দিনে দেশের প্রত্যেক নাগরিক ‘মানুষ মানুষের জন্য’ এই সুললিত বাক্যের আহবানে সাড়া দেবে কিংবা ন্যায় ও নীতিবোধে উদ্দীপ্ত হয়ে এগিয়ে আসবে মানবতার সেবায়। কিন্তু অত্যন্ত ব্যথিত চিত্তে আমরা লক্ষ্য করছি কতিপয় মানুষ (তাদের সংখ্যা খুব একটা কম নয়) মানুষের জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে নিজেদের আখের গোছানোর কাজে অতিমাত্রায় তৎপর হয়ে ওঠেছে। তাদের কাছে মানুষের জীবনের চেয়ে রাতারাতি ধনী হওয়ার যে প্রবণতা কাজ করছে তাতে করে এই কথা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে ওপরের অবয়বে আমরা তাদের যতটা মানুষ বলে দাবি করি কিংবা আশরাফুল মাখলুকাত বলে তারা যতটা গর্ব করে প্রকৃত অর্থে তারা ততটা মানুষ হয়ে উঠেনি। তারা এক একজন মানুষ নামের খোলসমাত্র।
বীরের জাতি হিসেবে দেশে ও বিদেশে আমাদের যেমন সুনাম আছে তেমনি দুই নাম্বারি কাজে ওস্তাদ ও বিশেষজ্ঞ হিসেবেও সমান পরিচিতি রয়েছে। আমরা সেই মানুষ দেশের স্বার্থ ও সুনামের বদলে নিজের লাভটাকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকি। আর এর জন্য এমন কোনো কাজ নেই আমরা করতে পারি না। এক সময় আমাদের দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ চিংড়ি রপ্তানি হতো পৃথিবীর নানা দেশে। আমরা আমাদের চিংড়ির সেই বাজার ধরে রাখতে পারিনি। কথিত আছে কোনো কোনো অসাধু রপ্তানিকারক চিংড়ির ওজন বাড়াতে তার মধ্যে পেরেক ঢুকিয়ে বিদেশে পাঠাত। বাঙালিদের এই চরম অসাধুতার কারণে বিদেশে আমাদের চিংড়ির বাজার সংকুচিত হয়ে পড়ে। বিদেশে আমাদের সুনাম একেক সময় একেক কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। গত ৭ জুলাই বাংলাদেশ থেকে ইতালি যাওয়া বেশ ক’জন যাত্রীর শরীরে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে। তারা করোনা নেগেটিভ সনদ নিয়ে সেদেশে গমন করলেও বিমান বন্দরে করোনা টেস্টে তাদের টেস্ট পজিটিভ আসে। এরপর ইতালি কর্তৃপক্ষ ৫ অক্টোবর পর্যন্ত সেদেশে বাংলাদেশি যাত্রীদের প্রবেশে নিষাধাজ্ঞা আরোপ করে। এই অবস্থায় ৯ জুলাই একটি ট্রানজিট ফ্লাইটে করে ইতালি যাওয়া ১৪৭ বাঙালিকে ফেরত পাঠায় ইতালি সরকার। এ জাতীয় ঘটনা দেশের ভাবমূর্তির জন্য বড় ধরনের হুমকি। আমরা নিজেরাই যেন নিজেদের পায়ে কুড়াল মারতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। তা যদি না হয় আমরা জেনে শুনে বুঝে, স্বেচ্ছায়, স্বজ্ঞানে যা করি তা কোনো সুস্থ বিবেকবান মানুষ করতে পারে না। তাহলে কি আমরা অসুস্থ? পুরো সমাজ অসুস্থ? হয়তো তাই। একটি সমাজকে নষ্ট করার জন্য একটি নষ্ট মানুষই যথেষ্ট। করোনা ভাইরাসজনিত বৈশ্বিক মহামারী যখন আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে সেই সময়ে আমরা পরম বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম এমন জঘন্য কর্মকাÐ যা কোনো সুস্থ মানুষ করতে পারে না। দেখা গেল কিছু মানুষ নামের অমানুষ মানুষের সেবায় সহায়তার হস্ত প্রসারিত করার বদলে মানুষের জীবন নিয়ে শুরু করে অমানবিক খেলা। কভিড১৯ চিকিৎসায় যে সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহ করা হলো তাতে নেওয়া হলো জালিয়াতির আশ্রয়। সরবরাহকৃত মাস্ক, পিপিই কোনটাই মানসম্মত ছিল না বলে অভিযোগ রয়েছে। সোজা কথায় ঐসব সুরক্ষা সামগ্রী ছিল নকল, দুই নাম্বারই মাল। ফলে করোনাকালের শুরুতেই আমরা হারিয়েছি ফ্রন্ট লাইন যোদ্ধাদের অনেককেই। এখন যদি ছেলেহারা মা-বাবা, স্বামীহারা স্ত্রী, কিংবা এতিম সন্তানদের কেউ সরবরাহ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে হত্যার মতো জঘন্য অপরাধে বিচারপ্রার্থী হয় তা মোটেই অন্যায্য হবে বলে মনে হয় না। কারণ যারা এসব সরবরাহ করেছে তারা নিঃসন্দেহে জানত সরবরাহকৃত সামগ্রী যথাযথ মানসম্মত নয়। এগুলো ব্যবহারে ব্যবহারকারীর জীবন ঝুঁকির সম্মুখীন হবে। সব কিছু জেনেও অতি মুনাফা বা লোভের বশবর্তী হয়ে যারা এই জঘন্যতম কাজটি করেছে তারা কখনো তাদের দায় এড়িয়ে যেতে পারেন না।
প্রতারণা, জালিয়াতি, পণ্যে ভেজাল, নকল, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ও খাবার বিক্রি, নিম্নমানের পণ্য বিক্রি, মাছ, মাংস,ফলমূল ও তরিতরকারিতে পচনরোধ কিংবা বেশি লাভের আশায় ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রণ, পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বেশি মূল্য আদায়, এসব ব্যাপার যেন আমাদের সমাজের জন্য কিছুই না। বর্তমানে করোনার কারণে মানুষের জীবন এমনিতেই দুর্বিষহ, জীবন ও জীবিকা নিয়ে প্রতিটি মানুষ নিরন্তর লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এ সময়ও এক শ্রেণির ব্যবসায়ী করোনা ভাইরাসরোধী সামগ্রী মাস্ক, স্যানিটাইজার, হ্যান্ড গ্লাভসসহ নানা জিনিস বিক্রি করছে যার অধিকাংশই মানসম্মত নয়, বেশির ভাগক্ষেত্রে নকল। শুধু তাই নয়, আমাদের আগামী প্রজন্ম মাসুম শিশুদের জীবন নিয়ে খেলা করতেও এতটুকু বাধছে না প্রতারক চক্রের। সম্প্রতি একটি স্থানীয় দৈনিকে ‘ভেজালের জালে শিশু খাদ্য’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘শিশু খাদ্য উৎপাদনে সংশ্লিষ্ট কোনো সংস্থার অনুমোদন না থাকলেও পণ্যের গায়ে লাগানো হয় অনুমোদনের লেভেল। শুধু নকল মোড়ক বা লেভেলেই সীমাবদ্ধ নয়, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের সাথে ব্যবহৃত প্রতিটি উপাদানই ভেজাল। এমনই এক কারখানার সন্ধান পেয়েছে সরকারের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার চট্টগ্রাম নগর শাখা। তাদের তথ্য ও প্রত্যক্ষ উপস্থিতিতে অভিযান পরিচালনা করে ভোক্তা অধিদপ্তর চট্টগ্রাম।’ প্রতিবেদনটিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে গত ১৩ জুলাই ’ সকালে নগরীর পাহাড়তলী থানার বশির শাহ মাজার এলাকায় ছদু চৌধুরী রোডের ‘বিসমিল্লাহ ফুড প্রোডাক্ট’ কারখানায় অভিযান চালানো হয়েছে। এই কারখানায় শিশুদের জনপ্রিয় ব্রান্ডের চিপস ভেজাল উপাদান দিয়ে তৈরি করা হতো। এমন কি চিপস তৈরিতে যে রং ব্যবহার হতো সেটা খাবারের উপযোগী নয়। শুধু বিসমিল্লাহ ফুড প্রোডাক্ট না, নগরীতে নীরবে শিশুখাদ্যে ভেজাল দিয়ে নকল পণ্য তৈরি করছে একটি চক্র। শিশুদের আগ্রহে থাকা পণ্যটি ভেজাল উপাদান দিয়ে নকল করে বাজারজাত করছে। বিশেষ করে গ্রাম এলাকার এসব পণ্য সহজেই বাজারজাত হয়। দামে কম হওয়ায় বেশি লাভের আশায় সহজেই বিক্রি করতে সংগ্রহ করে বিক্রেতারা। ফলে চরম ঝুঁকির মুখে পড়ছে শিশুস্বাস্থ্য (দৈনিক পূর্বদেশ, ১৩/০৭/২০২০)। এসব ভেজাল চিপস খেয়ে গ্রামে গঞ্জে নগরে কত শিশু যে অসুস্থ হয়ে পড়ছে তার কোন হিসেব নেই। শুধু তাই নয় এই সব চিপসে মেশানো রাসায়নিক দ্রব্য তাৎক্ষণিক শরীরের কোনো ক্ষতি না করলে নিজেদের অজান্তে শরীরে বপন করে যাচ্ছে দুরারোগ্য ব্যাধির বীজ, যা জাতির প্রাণশক্তির জন্য অশনি সংকেত।
এভাবে আমাদের সমাজে একের পর এক প্রতারণা, জালিয়াতি, নকল ও ভেজাল পণ্য বাজারজাতকরণের মতো গর্হিত কর্মকাÐ সংঘটিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। শুধু তাই নয় মানুষের জীবন নিয়েও খেলছে প্রতারকচক্র। দেশে যে প্রতারণার ডালপালা কতটা বিস্তৃত ও বিধ্বংসী তার স্বরূপ আমরা ইতিমধ্যে লক্ষ্য করেছি। করোনা পরীক্ষা তথা মানুষের জীবন-মৃত্যু নিয়ে ছেলেখেলায় মেতে ওঠা একটি চক্র অতি সম্প্রতি ধরা পড়েছে সরকারের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। মানুষের সেবার নামে মানুষ মারার প্রতিষ্ঠান জোবেদা খাতুন হেলথ কেয়ার (জেকেজি), রিজেন্ট হাসপাতালসহ যে সব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে তা যত দ্রæত সম্ভব তদন্ত করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার মধ্যে নিহিত আছে ভবিষ্যৎ মানবিক সমাজ বিনির্মাণের বীজ। এই কাজে যদি এতটুকু গাফিলতি পরিলক্ষিত হয় তা হবে দেশ ও জাতির জন্য ভয়ংকর। সুতরাং মানবজাতির এই দুঃসহ ক্রান্তিকালীন যারাই জাল, জালিয়াতি, প্রতারণা ও ভেজাল দেওয়ার মতো মানবতা বিধ্বংসী কর্মকান্ডে লিপ্ত তাদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা এখন সময়ের দাবি।
লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক