জাতীয় অগ্রগতিতে প্রয়োজন অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন

54

 

টেকসই উন্নয়নের জন্য বেশ কয়েক বছর ধরেই অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে। অন্তর্ভুক্তি শব্দটি বর্তমানে বিশ্বব্যাপী উন্নয়নের অনবদ্য ধারণা হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। আর অর্ন্তভুক্তিমূলক উন্নয়ন শব্দটির উম্মেষ ঘটেছে একুশ শতকে। মূলত বৈষম্যের অপনোদনের নিমিত্তে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন শব্দটাকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। অন্তর্ভুক্তি শব্দের সাধারণ অর্থ হচ্ছে সকলের সহযোগে, সকলের সমন্বয়ে। অর্থাৎ ‘কাউকে বাদ না দিয়ে’ বা ‘কাউকে পেছনে না ফেলে’। আর উন্নয়ন হচ্ছে ভালোর দিকে পরিবর্তন। যার অর্থ দাঁড়ায় সকলকে সঙ্গে নিয়ে ভালোর দিকে পরিবর্তনই হচ্ছে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন। আরো বিস্তৃতভাবে বললে, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন বলতে কোনও দেশের এমন এক ধরনের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বোঝায় যা দেশটির সব নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করে এবং যার ফলে সব নাগরিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল লাভ করে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে সমাজের সম্পদ অধিকতর হারে একটি সংখ্যালঘু বিত্তবান শ্রেণির হাতে কুক্ষিগত হয় এবং তুলনায় সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের সম্পদের আনুপাতিক পরিমাণ হ্রাস পায়। এই প্রবণতার ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি এবং সকলের জন্য উন্নয়ন নিশ্চিত করার প্রয়োজন থেকে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের ধারণাটি উদ্ভূত হয়েছে। ‘কাউকে পেছনে না ফেলে’ অর্থ হলো চরম দারিদ্র্যের দুরীকরণ, ব্যক্তি-গোষ্ঠী ও সমাজে বিদ্যমান অসমতার অপনোদন করা। অসমতা বা বৈষম্য সমাজের সর্বত্র বিরাজমান। সামাজিক বৈষম্য একটি সমাজের সম্পদ, সুযোগ ও পুরস্কারের অসম বিতরণকে বলা যেতে পারে। সমাজে রাজনৈতিক বৈষম্য, অর্থনৈতিক বা আয় ও সম্পদের বৈষম্য, নাগরিক সুযোগ সুবিধা প্রাপ্তিতে বৈষম্য, লিঙ্গ ও জাতিগত বৈষম্য, সামাজিক অবস্থানে বৈষম্য ও শ্রমবিভাজনে বৈষম্য উন্নয়নের প্রধান প্রতিবন্ধকতা। সামাজিক বৈষম্যের মূলে আছে অর্থনীতি। দেশে দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জিত হলেও ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্যের হ্রাস হয়নি; বরং তা বৃদ্ধি পেয়েছে। বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে মুক্তবাজার অর্থনীতির জন্য। মুক্তবাজার অর্থনীতি সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য কাজ করছে না। একচেটিয়া বাণিজ্য, দুর্নীতি ও সম্পদের অসম বন্টন আর লাগামহীন পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক নীতির ফলে পৃথিবীর সব অর্থ-ধন-সম্পদ জড়ো হচ্ছে মুষ্টিমেয় কিছু লোকের হাতে। ফলে বাড়ছে সম্পদ-বৈষম্য। ৪৬০ কোটিরও বেশি গরিবের চেয়ে ২ হাজার একশত ৫৩ জন বিলিয়নিয়ারের সম্পদ বেশি। পুরুষরা নারীদের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি সম্পদের মালিক। বিশ্বের সামগ্রিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সঙ্কটের মূলে কাজ করছে অর্থনৈতিক বৈষম্য। কেবল অর্থনীতিতে নয় উন্নয়নেও আছে বৈষম্য। বাংলাদেশ উন্নয়ন পরিষদের (বিআইডিএস) সভায় পরিকল্পনা মন্ত্রীও তা স্বীকার করে বলেন, বৈষয়িক বাস্তবতার আলোকে বাংলাদেশ যে উন্নয়নের মহাসড়কে চলছে, সংগত কারণে এতে বৈষম্য বাড়ছে। এ বৈষম্য খুব সহসা কমবে, এমন সম্ভাবনা কম। সুইডিশ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন এজেন্সি’র (সিডা) মতে, একুশ শতকের অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির বড় হওয়ার পেছনে যে বিষয়গুলো প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে সেগুলো হলো জনবহুল ও অত্যধিক নগরায়ণ হচ্ছে এমন দেশে আনুষ্ঠানিকখাতে শ্রমশক্তির প্রবেশে দুর্নীতিসহ নানা প্রতিবন্ধকতা, প্রাতিষ্ঠানিক, শিক্ষাগত ও অবকাঠামোগত দুর্বলতা, কম দামি পণ্য ও সেবার ক্রমবর্ধমান চাহিদা, দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক দুর্ভোগের কারণে মানুষের অভিবাসন, নারীদের আনুষ্ঠানিক খাতে প্রবেশের পথে নানা প্রতিবন্ধকতা ইত্যাদি। দেশের উন্নয়নের সুফল সমভাবে দেশের সকল নাগরিক পান না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, পেছনে থাকতে পারে ভূমিহীন মানুষ, গৃহহীন মানুষ, চর, হাওর, পার্বত্য ও দুর্যোগ-ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষ, বিধবা, তালাকপ্রাপ্ত, দুস্থ নারী, বয়স্ক মানুষ এবং অবিবাহিত মা, কিশোরী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি, উপকূলীয় অঞ্চল এবং জলবায়ুতে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে বসবাসকারী লোকজন, ক্ষুদ্র কৃষক, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা এবং জেলেরা। এ ছাড়াও মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা, মাদকাসক্ত যুবকরা, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিরা, স্কুল থেকে ঝরে-পড়া শিশু, কর্মসংস্থান বা প্রশিক্ষণবিহীন ব্যক্তি। সহিংসতার শিকার নারী ও শিক্ষার্থী, গৃহকর্মী এবং তৃতীয় লিঙ্গের ঝুঁকির মধ্যে থাকার আশঙ্কা রয়েছে। পরিচ্ছন্নতাকর্মী, প্রান্তিক মানুষ, চা-বাগানের শ্রমিক, মালী, ড্রামবাদক, ধোপা, বাজনদার, দাই, হাজাম, রবিদাস, চামড়া শ্রমিক, মুচি, নাপিত, সাপুড়ে ইত্যাদি এসডিজিতে পেছনে থাকতে পারে। এদের পেছনে রেখে উন্নয়ন সার্থক ও সফল হবে না। তাই অন্তর্ভুক্তিমূলকতার উপর জোর দিতে হবে। অন্তর্ভুক্তিমূলকতার উপরে জোর দেওয়া, বিশেষত বাজারে প্রবেশাধিকার, সম্পদের লভ্যতা এবং পক্ষপাতহীন নিয়ন্ত্রক পরিবেশের দৃষ্টিকোণ থেকে সুযোগের সমতাবিধানের উপরে জোর দেওয়া সফল উন্নয়নের একটি আবশ্যকীয় শর্ত। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। এতে সমাজের দরিদ্র ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর আয় বৃদ্ধি ও জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে উৎপাদনশীল কর্মসংস্থানের উপরে দৃষ্টি নিবন্ধ করা হয়। ২০১৫ সালে জাতিসংঘে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি)-২০৩০ গৃহিত হয়। এজেন্ডা-২০৩০ গৃহিত হওয়ার পর বিশ্বব্যাপী উন্নয়ন চিন্তা ও কর্মকাÐে নতুন চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। এসডিজির মূল বৈশিষ্ট্যেসমুহ হলো রুপান্তরমুখি, অংশিদারিত্বমূলক, অর্ন্তভুক্তিমূলক ও সার্বজনীন। টেকসই উন্নয়নের তিনটি মূল স্তম্ভ অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশের মধ্যে ভারসাম্য নিশ্চিত করা। বর্তমানে টেকসই উন্নয়ন বিবিধ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, টেকসই পরিবেশ এবং সামাজিক অন্তর্ভুক্তি এই তিন নীতির পাশাপাশি ‘কাউকে পেছনে না ফেলে’ এবং সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনকে প্রথমে সেবা দেওয়ায় এসডিজিকে বৈশ্বিক আকাক্সক্ষার সুসংহত এবং সমন্বিত কার্যক্রমে পরিণত করেছে। গতানুগতিক কার্যধারার বদলে সম্পদের টেকসই ব্যবহার এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ও শান্তিপূর্ণ সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম হবে এসডিজির আওতায়। অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার জন্য এসডিজি বাস্তবায়নে সবার জন্য, সমাপ্তি ঘটানো, অন্তর্ভুক্তিমূলক, সর্বজনীন, ন্যায়সংগত, সমান এবং অন্যান্য গুণগত ও পরিমাণমতো শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যদি আমরা টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট এবং লক্ষ্যগুলো গভীরভাবে বিশ্নেষণ করি তবে আমরা দেখতে পাব যে ‘শেষ’ শব্দটি এসডিজি-১ (দারিদ্র্যর অবসান), এসডিজি-২ (ক্ষুধা শেষ হওয়া) এই দুটি অভীষ্ট এবং এগারোটি লক্ষ্যে ব্যবহৃত হয়েছে, ‘সবার জন্য’ ছয়টি অভীষ্ট এসডিজি-৩ (স্বাস্থ্যকর জীবন নিশ্চিত করা), এসডিজি-৪ (মানসম্পন্ন শিক্ষা), এসডিজি-৫ (লিঙ্গ সমতা), এসডিজি-৭ (আধুনিক শক্তি), এসডিজি-৮ (অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান), এসডিজি-১৬ (শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান) এবং আঠারোটি লক্ষ্যে ব্যবহৃত হয়েছে। এর পাশাপাশি, ‘অন্তর্ভুক্ত’ শব্দটি পাঁচটি অভীষ্টে এসডিজি-৪, এসডিজি-৮, এসডিজি-৯ (স্থিতিস্থাপক অবকাঠামো), এসডিজি-১১ (মানববসতি), এসডিজি-১৬ এবং পাঁচটি লক্ষ্যে ব্যবহৃত হয়েছে। এ ছাড়া ‘সর্বজনীন’ শব্দটি আটটি লক্ষ্যে ব্যবহৃত হয়েছে, ‘অধিকার’ ছয়টি লক্ষ্যে ব্যবহৃত হয়েছে, ‘ন্যায়সংগত’ একটি অভীষ্ঠ এসডিজি-৪ এবং সাতটি লক্ষ্যে ব্যবহৃত হয়েছে এবং সবশেষে ‘সমতা’ শব্দটি দুটি অভীষ্ঠ এসডিজি-৫, এসডিজি-১০ (বৈষম্য হ্রাস) এবং বারোটি লক্ষ্যে ব্যবহূত হয়েছে। অভীষ্ট-১০-এর সব লক্ষ্য অসমতা হ্রাস করার বিষয়ে। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন বাংলাদেশের জাতীয় নীতির মূল অংশ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সব সময়েই অর্থনৈতিক উন্নয়নকে প্রাধান্য দিতেন, যাতে সকলের উন্নয়ন নিশ্চিত হয়। বাংলাদেশর আর্থিক অন্তর্ভুক্তির মূল দর্শন হলো আর্থিক পরিষেবা বর্হিভূত বা সীমিত আর্থিক পরিষেবা প্রাপ্ত জনেগাষ্ঠীর জন্য বহুমাত্রিক আর্থিক পরিষেবা নিশ্চিতকরণ। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নীতি প্রণয়ন ও অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে অংশীজনদের সহায়তা করা হয়, যা অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং অন্যান্য জাতীয় কৌশলপত্রের ন্যায় দেশে কল্যাণমুখী, অংশীদারিত্বমূলক ও টেকসই উন্নয়নে ভ‚মিকা রাখবে। বাংলাদেশর দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি আর্থিক অন্তর্ভুক্তির একটি অন্যতম চািলকাশক্তি। গত কয়েক দশক ধরেই স্থিতিশীলভাবে বাংলাদেশে ৬ শতাংশের চেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে। এ প্রবৃিদ্ধ অর্জন যেমন অর্থনৈতিক সফলতার ব্যাপ্তিকে আরও বিস্তৃত করেছে তেমিন অভিবাসন ও কৃিষর আধুনিকায়ন প্রবৃিদ্ধর হারকে অপেক্ষাকৃত সুষম করেছে, যদিও আয়বৈষম্য (গিনি কো-এফিসিয়েন্ট) ২০০০ সাল থেকে সীমিতভাবে বৃিদ্ধ পায়। ডিজিটাল প্রযুক্তির অভিগম্যতা এবং ব্যবহারের সুযোগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে অসমতা বা ডিজিটাল বিভেদ নিয়ে উদ্বেগ বাড়েছ, যার মধ্যে লিঙ্গ বৈষ্যমের বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ডিজিটাল আর্থিক পরিষেবার বিস্তারের সাথে সাথে এ অসমতা আর্থিক অন্তভুর্ক্তির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ র্নির্ধারক হয়ে উঠবে।
লেখকঃ প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট