জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি এ. বি. এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর শূন্যতা পূরণ হবে কবে?

36

জামাল উদ্দিন

জীবদ্দশায় কিংবদন্তীতুল্য রাজনীতিকদের মৃত্যুপরবর্তী শূন্যতা কখনও পূরণ হয়না, এমনকি পূরণ হবার কথাও নয়Ñ এটাই বাস্তবতা। এসব রাজনীতিকদের সন্তানরাও এই শূন্যতা পূরণের যোগ্যতা রাখেন না। তবে এক্ষেত্রে দেশীয় রাজনীতিতে একমাত্র ব্যতিক্রম বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনা। তিনি ঢাকায় ইন্টারমিডিয়েট মহিলা কলেজ (বর্তমান বদরুন্নেসা কলেজ) ছাত্র লীগের নেতৃত্বের আসনে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে রোকেয়া হল ছাত্রী নিবাস ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। যে সময় রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম সভা ও মিছিলে তিনি নেতৃত্বের পুরোভাগে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু যখন কারাগারে মা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের সাথে শেখ হাসিনা অসংখ্যবার বাবার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করেছেন। দলের নেতাকর্মীদের জন্য বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী বেগম মুজিব যে রাজনৈতিক ম্যাসেজ নিয়ে আসতেন তার সাক্ষী শেখ হাসিনা। তবে এটা সত্যি যে, তিনি রাজনীতিক হবেনÑ এমন কোনো ইচ্ছা তাঁর ছিলো না। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পাপিষ্ট কুলাঙ্গাররা যখন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নিষ্ঠুর ও নির্মমভাবে হত্যা করে তার ১৫ দিন আগে শেখ হাসিনা প্রবাসী স্বামী ওয়াজেদ মিয়ার জার্মানীস্থ আবাসে গিয়েছিলেন ছোট বোন শেখ রেহানাকে সাথে নিয়ে। সে যাত্রায় সৌভাগ্যক্রমে বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরসূরি দুইবোন প্রাণে বেঁচে গেলেও পাঁচ বছরের বেশি সময় বিদেশ তাঁদের জীবন কেটেছে অবর্ণনীয় দুর্দশায়Ñ এসব কথা কারও অজানা নয়। কী অবস্থায় এবং কেন আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়ে তাঁকে দলের হাল ধরতে হয়েছে তাতো অমোচনীয় ইতিহাসের একটি উজ্জ্বল অধ্যায়। অল্প শোকে কাতর ও অধিক শোকে পাথর না হয়েও কঠিন ও দুর্বিনীত দুঃসময়ে তাঁর হৃদয়ে প্রোথিত হয়েছিল ইস্পাত-কঠিন দৃঢ়তা ও প্রত্যয়। তার সুফল ও প্রাপ্তিযোগ জাতি পেয়েছে বা পাচ্ছেÑ তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। এখন চট্টলবীর এ. বি. এম মহিউদ্দিন চৌধুরী প্রসঙ্গে ফেরা যাক। বলছিলাম কিংবদন্তীতুল্য রাজনীতিকদের মৃত্যুপরবর্তী শূন্যতা বিষয়ে। অন্য দলের কিংবদন্তীতুল্য রাজনীতিকদের বাদ দিয়ে চট্টগ্রামে আওয়ামী ঘরানায় এ ধরনের একঝাঁক রাজনীতিক রয়েছেন। তাঁরা প্রয়াত। এই ঘরানায় এখন পর্যন্ত কিংবদন্তীতুল্য রাজনীতিক নেই বললেই চলে এবং ব্যক্তিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে তাঁদের সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা নেই। চট্টগ্রামে জীবদ্দশায় কিংবদন্তীতুল্য রাজনীতিক ছিলেন আমির হোসেন দোভাষ, এম এ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী, এম এ হান্নান, এম এ মান্নান, বিভ‚তি রঞ্জন চৌধুরী (মানিক চৌধুরী), আতাউর রহমান খান কায়সার, আকতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু এবং সর্বশেষ চট্টলবীর এ. বি. এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। এদের উত্তরাধিকার বা সন্তানরা কেউ কেউ কমবেশি রাজনীতির সাথে যুক্ত হলেও সর্বজনীন রাজনৈতিক চারিত্র্যের ধারে-কাছেও নেই। এরা কেউ কেউ মন্ত্রী, জাতীয় সংসদ সদস্য, মেয়র ও কেন্দ্রীয় পদ-পদবী পেলেও সর্বজনীন নন। সর্বজনীন চারিত্র্যের প্রধান নিশানা বা ভিত্তি হলো মানবিক বোধ ও মানুষের প্রতি নিখাদ ভালোবাসা; সর্বোপরি প্রাণ-প্রকৃতির প্রতি আকর্ষণ এবং এর বিকাশ সাধন। এ. বি. এম চৌধুরী প্রথমত, মানবিক ও দার্শনিক এবং অতঃপর আপাদমস্তক আদর্শিক ও রাজনীতিক।
আজ ১ ডিসেম্বর ২০২২, ১৯৪৪ সালের এই দিনে রাউজান থানার গহিরার শান্তিরদ্বীপ গ্রামে জন্ম নেয়া এ. বি. এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর ৭৮তম জন্মদিন। এই শুভ জন্মদিনে অনেক স্মৃতিচারণ হবেÑ এটাই স্বাভাবিক; তবে মহিউদ্দিন চৌধুরীর প্রিয় চট্টগ্রাম এখন তাঁর অবর্তমানে কেমন আছেÑ এ কথা ক’জন বলবেন? একটা কথা মনের গহীন ভেতরে উচ্চারিত হয়Ñ প্রশ্ন নেই, উত্তরে মৌন পাহাড়।
১৯৭০ সালে নভেম্বর মাসে প্রলয়ঙ্করী প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপন্ন উপক‚লবর্তী জনগণের আর্তমানবতার সেবায় বিপুল সাহায্য সামগ্রী নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন হাতিয়ার। তখন তিনি দলীয় পদ-পদবীতে ছিলেন না। এখান থেকেই শুরু মানবিক এ. বি. এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর পদযাত্রা। মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনাকালে তিনি হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হনÑ কীভাবে, কেমন করে কারাগার থেকে বেরিয়ে মুক্তিযুদ্ধে লড়াকু যোদ্ধা হলেনÑ এসব চট্টগ্রামবাসী জানেন।
২০১৭ সালে আমার শুধু নয়, সকলের প্রিয় এ. বি. এম মহিউদ্দিন চৌধুরী প্রয়াত হলেন। হওয়ার তিন মাস আগে থেকেই তাঁর ছায়াসঙ্গী ছিলেন প্রদীপ খাস্তগীর। ঐ সময় নানা জটিল রোগে আক্রান্ত মহিউদ্দীন ভাই বলতেনÑ ‘ওডা চট্টগ্রামের সমস্যা তো বহুত। ক্যান গরি সমাধান হইবো’। (চট্টগ্রামের সমস্যা তো অনেক, কীভাবে সমাধান হবে।) প্রদীপ খাস্তগীর অভয় দিলেনÑ ‘অনে বাঁচি থাকিলে হইবো’। (আপনি বেঁচে থাকলে হবে।) করোনাকাল গেলÑ তখন চট্টগ্রামবাসীর হাহাকার শুনি- মহিউদ্দিন চৌধুরী কোথায়?
এভাবেই মহিউদ্দিন চৌধুরীকে আজও চট্টগ্রামবাসী ডাক দেন- ‘আসুন আমাদের পাশে থেকে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পতাকা উড়িয়ে ডাক দিন। চট্টগ্রামবাসী এই মহিউদ্দিন চৌধুরীর জন্যে অপেক্ষা করছে এবং শত বছর পর হলেও তাঁর শূন্যতা পূরণ হবেনা। এই অমোঘ সত্যের প্রতি ভরসা রেখেই বিজয়ের এই মাসের প্রথম তারিখ ১৯৪৪ সালে এই দিনে জন্ম নেয়া মহিউদ্দিন চৌধুরীকে সালাম ও শত প্রণাম।
১৯৭১ সালে চট্টগ্রামসহ দেশের উপক‚লবর্তী এলাকায় প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ¡াসের বিভীষিকার দুঃসহ স্মৃতি এখনও জ্বলজ্বল করে মানসপটে। ঐ সময় চট্টগ্রাম টানা পনের দিন অন্ধকারে ডুবে ছিলো। তখন ডায়রিয়া মহামারিতে রূপ নেয়। এ. বি. এম মহিউদ্দিন চৌধুরী ঐ সময় মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে অস্থায়ী দাতব্য হাসপাতাল খুলে দুর্গতদের স্বাস্থ্যসেবা দেন। সেখানে প্রতিদিন ছাত্রলীগ, যুবলীগকর্মী এবং সাধারণ মানুষকে নিয়ে গড়া স্বেচ্ছাসেবক টিম প্রতিদিন কয়েক হাজার প্যাকেট খাবার স্যালাইন তৈরী করেন। এমনকি হাজার হাজার রুটি বানিয়ে দুর্গতদের মাঝে পৌঁছে দিতেন। মহিউদ্দিন ভাই হাসপাতালটি না খুললে ডায়রিয়ায় মৃত্যুর মিছিল আরো দীর্ঘ হতো। ঐ বছরই কিছুদিন পর বন্দরটিলায় নৌ-বাহিনীর কিছু উচ্ছৃঙ্খল সদস্যদের সাথে এলাকাবাসীর সাংঘর্ষিক ঘটনা ঘটে। নৌ-বাহিনীর গুলিতে বেশ কয়েকজন এলাকাবাসী হতাহত হন। মৃতদের লাশ নৌ-বাহিনী নিবাসে ডিপ ফ্রিজে রাখা হয়েছিল। এ নিয়ে পরিস্থিতি সংক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তখন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নিযুক্ত মেয়র ছিলেন মীর নাছির উদ্দিন। আব্দুল্লাহ আল নোমান ও জহিরুদ্দিন খান তৎকালীন বিএনপি সরকারের পূর্ণমন্ত্রী ছিলেন। বন্দরটিলায় উত্তপ্ত ঐ পরিস্থিতে মেয়র ও কোন মন্ত্রী-এমপি যেতে সাহস করেননি। একমাত্র রাজনীতিক এ. বি. এম মহিউদ্দিন চৌধুরী তাঁর কর্মী বাহিনী নিয়ে ছুটে গিয়ে ছিলেন। নৌ-বাহিনী নিবাস এলাকায় ঢুকে ফ্রিজ থেকে মরদেহগুলো উদ্ধার করে গোসল ও দাফন-কাফন নিজেই করেছিলেন। ২০০১ সালে নির্বাচন পরবর্তী ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামাতের পেটোয়া বাহিনী সারাদেশে আওয়ামী লীগ সমর্থক ও সংখ্যালঘু সম্পদ্রায়ের উপর হামলে পড়ে। হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের মত জঘন্য ঘটনা একের পর এক ঘটতে থাকে। এ. বি. এম মহিউদ্দিন চৌধুরী তখন দ্বিতীয় দফায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন মেয়র। সংক্ষুব্ধ মহিউদ্দিন চৌধুরী লালদীঘি মাঠে এক বিশাল প্রতিবাদী জনসভায় হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন, ‘খবরদার, চট্টগ্রামে অরাজকতা হলে হামলাকারীদের কোন ছাড় দেয়া হবে না। আমরা রাজপথ ছাড়ি নাই। হামলাকারীদের নির্মূলে একাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠবে। আমরা প্রস্তুত।’
এ. বি. এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর এই বীরোচিত হুঙ্কারের ফলে চট্টগ্রাম নগরীতে তো বটে মিরসরাই ছাড়া চট্টগ্রামের আর কোথাও বিএনপি-জামাত অরাজকতা ও নাশকতা চালাতে সাহস করেনি। কালুঘাট শিল্পাঞ্চলে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে ভয়াবহ অগ্নিকাÐের ঘটনায় প্রায় পঞ্চাশ জন নারী-পুরুষ কর্মী অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান। অগ্নিদগ্ধ কিছু লাশ শনাক্ত করাও সম্ভব ছিলো না। লাশগুলো গোসল করিয়ে দাফন, জেয়াফত ও চেহলামের ব্যবস্থাও তিনি করেছিলেন। মানবিক এ. বি. এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর মানব সেবার ফিরিস্তি বড়ই দীর্ঘ এবং লিখে শেষ করা যাবে না। তিনি যতটা রাজনীতিক, তার চেয়ে বেশি মানবিক। তাঁর সুপারিশ ও ডিও নিয়ে অগণিত রোগী ভারতে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ও ভাল মানের হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নিয়েছেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিক হিসেবে যতটা তিনি সফল তার চেয়ে আরও বেশি দক্ষ ও সফল প্রশাসক হিসেবে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ১৭ বছর মেয়র থাকাকালীন সময়ে দক্ষ প্রশাসক হিসেবে তিনি দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হন। তাঁর সময় চট্টগ্রাম সিটি মেয়র স্বনির্ভর এবং আর্থিকভাবে সমৃদ্ধ ও সক্ষম।
এ. বি. এম মহিউদ্দিন চৌধুরী- শূন্য চট্টগ্রামে দু-একটি নয়; একাধিক সমস্যা বিদ্যমান। জলাবব্ধতা তো আছেই। এটা নিরসনে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন সেগুলোর মেয়াদ ও ব্যয়-বরাদ্দ বাড়ছেই; কবে প্রকল্পটি পূর্ণ বাস্তবায়িত হবে তা বলা যাচ্ছে না। যানজট লেগেই আছে। কর্ণফুলী দূষণ ও দখল মুক্ত হচ্ছে না। কর্ণফুলীর তলদেশে ২০ফুট সমান জমাট পলেস্তারায় ক্যাপিটাল ড্রেজিং বিঘিœত হচ্ছে। চট্টগ্রামের উন্নয়নে বাস্তবায়নাধীন মেগাপ্রকল্পগুলো সমন্বয়হীনতায় সময় ও দুর্ভোগ বাড়াচ্ছে। চট্টগ্রামের উন্নয়নের সাথে ১৭টির বেশি সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা যুক্ত। এর কোনটির সাথে অন্যটির কাজের সমন্বয় সাধন নেই। এজন্য মহিউদ্দিন চৌধুরী সিটি গভর্মেন্টের প্রস্তাব দিয়েছিলেন বিএনপি শাসনামলে। অন্যান্য মেয়ররাও মহিউদ্দিন চৌধুরীর প্রস্তাবে সায় দিয়েছিলেন। প্রস্তাবটির মর্মার্থ হলো মেয়রের নেতৃত্বে সরকারের ভেতরে আরেকটি সরকার। এ ধরনের সরকার উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বে আছে।
এ. বি. এম মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রাম অন্তঃপ্রাণ। জাতীয় নেতা হওয়ার সকল গুণাবলী ও যোগ্যতা তাঁর ছিলো; কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য বা টেকনোক্র্যাটি কোটায় মন্ত্রী হতে চাইলে হতে পারতেন; তাঁর কাছে প্রস্তাবও ছিলো। কিন্তু তিনি হননি, আমৃত্যু চট্টগ্রামের মাটি ও মানুষকে আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেনÑ এটাই সর্বজনীন এ. বি. এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর মাহাত্ম্য। বর্তমানে চট্টগ্রামে আওয়ামী রাজনৈতিক ঘরানায় মহিউদ্দিন চৌধুরীর মাপের সর্বজনীন মানবিক ও কিংবদন্তীতুল্য রাজনীতিক লক্ষ্যণীয় নয়, যে কোন কঠিন সংকট উত্তরণে যে গতি ও তেজ প্রয়োজন রাজনৈতিক নেতৃত্বে তার অভাব আছে। এই শূন্যতা কবে পূরণ হবেÑ এই প্রশ্ন এখন বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
লেখক : ইতিহাসবিদ, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও সাংবাদিক