ছাইরঙা ছাগল ও বাইসাইকেল

31

রোকন রেজা

ক্লাস সেভেন পর্যন্ত আমি কোথাও প্রাইভেট পড়িনি। আমার বন্ধুরা যখন দল বেঁধে প্রাইভেট পড়তে যেত মতিন স্যারের কাছে আমি তখন বাড়িতে জানালার ধারে বসে বসে জ্যামিতি মুখস্থ করতাম। প্রাইভেট পড়ানোর মতো আর্থিক সঙ্গতি আমার বাবার ছিল না।
ক্লাস সেভেন থেকে এইটে ওঠার সময় আচমকা আমার রোল নম্বর যখন দুই হয়ে গেল আমার বাবা আনিসুর রহমার, নীলমনিগঞ্জ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের হিসাব সহকারি, তাঁর স্কুলের রহমত স্যারকে বললেন আমাকে পড়ানোর জন্য। রহমত স্যার তাঁর কথা রেখেছিলেন। তিনি আমাকে অর্ধবেতনে পড়াতেন।
রহমত স্যার বাবাকে বলেছিলেন, দেখ আনিস তোমার ছেলেটা পড়াশোনায় ভাল বলেই বলছি। বিনা পয়সায় আর যাই হোক লেখাপড়াটা হয় না। তুমি অল্প কিছু যা পার দিও। যদিও তোমার কষ্ট হবে। তাতে তোমারই লাভ। ছেলেটাকে মাথা উচুঁ করে চলতে শেখাও। ওকে পরের অনুগ্রহে মানুষ করো না। পরের দানে শিক্ষিত হলে মেরুদন্ড থাকে না।
কথাটা বোধহয় বাবাও পছন্দ হয়েছিল। তারপর থেকে প্রতিদিন আমি সকালবেলা তিন মাইল পথ হেঁটে প্রাইভেট পড়তে যেতাম রহমত স্যারের কাছে। আমি কখনোই আমার বাবাকে বলিনি বাবা আমাকে একটা সাইকেল কিনে দেন। আমি জানতাম সাইকেল কিনে দেয়ার মতো অতিরিক্ত টাকা তাঁর নেই। আমি তখন অনেক কিছুই বুেঝ গিয়েছিলাম। আমাদের মতো পরিবারের ক্লাস এইটে পড়া ছেলেদের অনেক কিছুই বুঝে যেতে হয়।
আমার বাবা কত টাকাই বা বেতন পেতেন তখন! আমাদের কোনো জমি-জমাও ছিল না। আমাদের আলাদা ইনকামের আর কোনো রাস্তা ছিল না।
বাবার বেতনের টাকা হাতে আসতে না আসতেই শেষ হয়ে যেত। মাসকাবারি বাজার করার পর হাতে আর কিছুই অবশিষ্ঠ থাকত না। মাসের শেষের দিকে বিভিন্ন দোকান থেকে বাকি করতেন আমার বাবা।
আমি যখন রহমত স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়তে যেতাম মাঝে মাঝে লোলুপ চোখে তাকিয়ে থাকতাম বন্ধুদের সাইকেলের দিকে। ওরা আমাকে মাঝে মধ্যে কেরিয়ারে করে নিয়ে যেত। আমার বন্ধু আরিফ যখন নতুন একটা সাইকেল কিনল আমি সেই ঝকঝকা সাইকেলের হ্যান্ডেলে হাত দিয়ে দেখতাম। প্যাডেল ঘুরাতাম। মনে মনে ভাবতাম আমারও যদি এরকম একটা সাইকেল থাকত! আরিফ আমাকে একদিন তার নতুন সাইকেলে চড়তে দিয়েছিল। আমি স্কুলের পুরো মাঠ চার পাক ঘুরেছিলাম।
আমার মা একদিন আমাকে ডেকে বলল, তোর বাবাকে বলব তোকে একটা সাইকেল কিনে দিতে। মা কি বুঝেছিল প্রতিদিন আমার হেঁটে যেতে কষ্ট হয়।
আমার মা বাবাকে বলেছিল কিনা জানি না। তারপর একদিন বাবা রাতে আমার কাছে এসে বললেন, রিন্টু শোনো, তুমি যদি এবার বার্ষিক পরিক্ষায় ফাস্ট হতে পার তোমাকে একটা নতুন সাইকেল কিনে দেব।
কথা শুনে কী যে আনন্দ হয়েছিল আমার! বুকের মধ্যে বিদ্যুৎ ঝলকের মতো আগুন জ¦লেছিল যেন। কিন্তু বাবার কথা আমি পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারিনি। আমি তাঁর কথা শুনে কিছুই বলিনি তখন। তারপর কেমন যেন মৃত্যু সংবাদ শোনার মতো স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। শুধু মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম বার্ষিক পরিক্ষায় ফাস্ট আমি হবোই।
তারপর থেকে বাবা আমাকে প্রতিমাসের বেতন থেকে ২০০/৩০০ করে টাকা দিতেন। টাকাটা আমার হাতে দিয়ে বাবা বলতেন, এই টাকাটা তুমি জমাও।
বাবা একথা কেন বলতেন আমি বুঝে গিয়েছিলাম। বাবা আমাকে একবারে অত টাকা দিয়ে সাইকেল কিনে দিতে পারবে না। তাই মাসে মাসে বাবা এই টাকাটা আমাকে দিতেন। আমি সেই টাকা জমিয়ে রাখতাম প্লাস্টিকের একটা কৌটার মধ্যে। তারপর মাঝে মাঝে ঐ টাকা বের করে গুণে দেখতাম। একবার, দুইবার,অনেকবার। তারপর সেই টাকা আবার ঐ কৌটার মধ্যে ভরে রাখতাম।
শুক্রবারের দিন ৭/৮টা মুরগির ডিম অথবা উঠানের গাছের একছড়ি কাঁচা কলা অথবা ৮/১০টা সবুজ পেয়ারা দিয়ে মা আমাকে প্রায়ই নদীর ওপারে খালার বাড়ি পাঠাতেন। খালাদের বাড়িটা ছিল সত্যিই খুব সুন্দর। নদীর কিনার ঘেঁষে গাছ-গাছালিতে ভরা ছায়া ছায়া বাড়ি। খালুর ছিল ভূষি মালের ব্যবসা। তাঁর অনেক টাকা।
আমার খালাত ভাই জহির তখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। জহিরদের বাড়িতে আমি আর জহির সারাদিন খেলা করতাম। খালা যখন প্লেটে করে এটা-সেটা খেতে দিত আমাকে আর জহিরকে, জহির তেমন কিছুই খেত না। আমিই সব সাবাড় করে দিতাম। সেই ১২/১৩ বছর বয়সে আমার একবার মনে হয়েছিল আমার মা’র কেন খালুর সঙ্গে বিয়ে হলো না। তাহলে আমিই জহির হতাম। জহিরদের কোনো অভাব ছিল না।
আমি জহিরদের বাড়িতে দু’একদিন থাকতাম। আসার সময় খালা আমার হাতে পাঁচশ অথবা একহাজার টাকার একটা নোট দিয়ে বলত, সাবধানে নিয়ে যাস। গিয়ে মাকে দিবি।
আমি বাড়ি এসে সেই টাকা অবিকল মা’র কাছে ফেরত দিতাম। এখন বুঝি মা আসলে মাঝে মাঝে খালার কাছে আমাকে টাকা আনতে পাঠাত।
হঠাৎ করেই একদিন আমার বড় বোন শিউলির পেটে ব্যথা শুরু হলো। অসহ্য তীব্র যন্ত্রণা। যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল সে। অগত্যা বাবা স্কুল থেকে তড়িঘড়ি ফিরে এসে ওকে নিয়ে গেলেন ডাক্তারের কাছে। পরিক্ষা-নিরীক্ষা করে শিউলির অ্যাপেন্ডিসাইট ধরা পড়ল পেটে। বাড়ি ফিরে এসে জামা-কাপড় খুলতে খুলতে বাবা শুকনো কন্ঠে মা’কে বললেন, অপারেশন করাতে হবে।
তার একদিন পর রাতে আমার মা আমার পাশে এসে বসলেন। আমি পড়া থামিয়ে মা’র দিকে বিস্মিত চোখে তাকালাম। মা বললেন, রিন্টু শোন-আমাদের তো এখন দুঃসময়। তোর ছাগলটা না হয় বিক্রি করে দে। পরে মালাকে বলে তোকে আরেকটা ছাগল আনিয়ে দেব।
মা’র কথা শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। আমার মাথার মধ্যে রম্বস আর আয়তের সংজ্ঞা এলোমেলো হয়ে যেতে লাগল। আমি অবাক চোখে মা’র দিকে তাকালাম। এতবড় আঘাত মা আমাকে কীভাবে দিতে পারল!
জহিরদের বাড়িতে আমি আর জহির ছাগল নিয়ে খেলা করতাম। জহিরদের ছিল অনেকগুলো ছাগলের বাচ্চা। একটা কালো রঙের খাসি ছাগলের বাচ্চা আমার খুবই প্রিয় হয়ে উঠেছিল যার মাথার কাছে আর পেটের কাছে ছিল ছাই রঙের ছোপ ছোপ দাগ। ছাগলের বাচ্চাটা আমাকে দেখলেই কেন জানি ছুটতে ছুটতে কাছে চলে আসত। আমি বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম। আদর করতাম। ঘাস-পাতা খাওয়াতাম।
বাচ্চাটিকে ছেড়ে বাড়ি আসার দিন অনেক মন খারাপ হয়েছিল আমার। মনে মনে ভেবেছিলাম এরকম একটা সুন্দর ছাগলের বাচ্চা যদি আমার থাকত! আমার মন খারাপ দেখে অবশেষে আমার খালা, জহিরের মা ছাগলের বাচ্চাটি আমাকে দিয়ে দিয়েছিলেন।
আমি ছাগলের সেই বাচ্চাটি নিয়ে এলাম বাড়িতে। তার সার্বক্ষনিক দেখা-শুনা করতে লাগলাম। বিকেলের দিকে মাঠে গিয়ে ঘাস নিয়ে আসতাম। বাড়ির পিছন থেকে কাঁঠালের পাতা ভেঙে আনতাম। স্কুল আর পড়াশুনা বাদ দিয়ে বাকি সময়টুকু আমার ছাগলের পিছনেই কেটে যেতে লাগল। বাচ্চাটিকে আমি পরম যতেœ বড় করতে লাগলাম। বাচ্চাটির দিকে তাকালে কী যে ভাল লাগত আমার! কী যে ভালবেসেছিলাম তাকে! দিনে দিনে সে হয়ে উঠতে লাগল পাড়ার শ্রেষ্ঠ ছাগল। অথচ আমার মা, আমার নিষ্ঠুর মা তাকে বিক্রি করে দিতে বলছেন।
আমার মা’র কথার উত্তরে আমি কিছুই বলিনি তখন। চুপচাপ উঠে চলে এসেছিলাম বাড়ির পিছনের কাঁঠালতলায়। মন খারাপ করে বসেছিলাম সারা বিকেল। তারপর সন্ধ্যের পড়াটা শেষ করে প্লাস্টিকের সেই কৌটাটা আমি খুললাম। টাকাগুলো উপুড় করে বিছানার ওপর ঢাললাম। তারপর একে একে সাট করে সেগুলো গুনতে লাগলাম।
পরেরদিন আমি শরীর খারাপের ভান করে শুয়ে থাকলাম বিছানায়। প্রাইভেটে গেলাম না। স্কুলে গেলাম না। আমার মা বিছানায় বসে কপালে হাত দিয়ে বললেন, জ¦র তো নেই। শুধু শুধু শুয়ে আছিস কেন?
মা’র কথা শুনে আমার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি গড়িয়ে পড়ল। আমি প্লাস্টিকের কৌটা থেকে টাকাগুলো বের করে মা’র হাতে দিয়ে বললাম, মা আমার সাইকেল কেনা লাগবে না। এই টাকা দিয়ে শিউলির অপারেশন করাও। আমার ছাগলটা থাক।
মা টাকাগুলো হাতের মধ্যে নিয়ে নির্বাক তাকিয়ে থাকল আমার পানে। আমি বললাম, বাবা বলেছে আমি যদি ফাস্ট হই এমনিতেই বাবা সাইকেল কিনে দেবে।
আমার ঐ টাকা আর মা’য়ের হাঁস-মুরগি বিক্রির জমানো টাকা দিয়ে শিউলির অপারেশনটা হয়ে গেল।
তার কিছুদিন পর আমার ছাগলটা হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়ল। ছাগলের পেট ফুলে ঢোল হয়ে গেল। মলদ্বারের আশে-পাশে লাল লাল রক্তের দাগ দেখা গেল। মলদ্বার দিয়ে অনবরত পাতলা পানি ঝরতে লাগল। গ্রামের পশু ডাক্তারকে দেখালাম। উনি একটা ইনজেকশন দিলেন। পরেরদিন ভোরবেলা আমার ছাগলটা মারা গেল।
তারও মাসখানিক পর আমার স্কুলে বার্ষিক পরিক্ষা শুরু হলো। আমি ইচ্ছে করেই গণিত পরিক্ষার দিন দুটো অংক ভুল করে রাখলাম।