চমেক হাসপাতালেই দুই মাসে ১৪ লাশ

37

মানসিক অস্থিরতা ও পারিবারিক অশান্তিসহ নানা কারণে আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকছে মানুষ। গত কয়েক মাস ধরে চট্টগ্রামে আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে আত্মহত্যার প্রবণতা। সামাজিক এ ব্যাধি থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে কাউন্সিলিং প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া নিজ নিজ ধর্মে যে আত্মহত্যা পাপ, তা নিয়ে পরিকল্পিতভাবে আলোচনা করার পরামর্শও দিয়েছেন তারা।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই মাসে আত্মহত্যা করেছে এমন ১৪ জনের নাম-ঠিকানা রয়েছে চমেক হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়িতে। সেখানে বেশিরভাগ আত্মহত্যাকারীই পারিবারিক কলহের জেরে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন বলে উল্লেখ রয়েছে। আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে বেশিরভাগই নারী। তবে চমেক হাসপাতালের বাইরে অন্যান্য সরকারি বেসরকারি হাসপাতালেও আত্মহত্যার ঘটনায় চিকিৎসা নিতে আসাদের সংখ্যা কম নয়। গত দুই মাসে আত্মহত্যাকারীরা হলেন- খুলশী পূর্ব আমবাগান এলাকার সাইফুল ইসলামের স্ত্রী লিপু আক্তার (১৮), আকবরশাহ পাক্কার মাথা এলাকার মো. রাজিবের স্ত্রী তাসলিমা আক্তার (২৩), আগ্রাবাদ মৌলভী পাড়ার মো. জাফর ইকবালের স্ত্রী জান্নাত (৩৫), নিউ মার্কেট আল মদিনা টাওয়ারের সালাউদ্দিনের ছেলে মনির উদ্দিন কিরণ (১৯), কাপ্তাই কর্ণফুলী পেপার মিলের পাশে বাসু দেবের স্ত্রী সুপ্তি মল্লিক (২১), বন্দরের কলসীদিঘী এলাকার রাকিব হোসেনের স্ত্রী মনি আরা বেগম (১৯), পাহাড়তলী বারকোয়ার্টারের আবুল বশরের ছেলে মো. আবুল হাসনাত (২০), চকবাজার নিকুঞ্জ নিবাস মসজিদ কলোনির রূপন দাশের ছেলে প্রত্যয় দাশ (১৫), আকবরশাহ হরিমন্দির এবি আবাসিকের মো. রানার স্ত্রী সাহিদা (৩০), চকবাজার বিএড কলেজ গলির দেলোয়ার হোসেনের ছেলে ইমন খান (২৪), বন্দরের কলসীদিঘীর পাড় ফাতেমা বিল্ডিং এর পল্টু চাকমার স্ত্রী জোনাকি চাকমা (২৭), রাহাত্তারপুল চেরাগী গলির মৃত সোলতান বেপারির ছেলে নুর হোসেন বাপ্পী (২৮), বায়েজিদ হিলভিউ আবাসিকের সামশু মিয়া বিল্ডিং এর বাসিন্দা সালাউদ্দিনের স্ত্রী সুমি আক্তার (২৫) এবং কোতোয়ালী ফিরিঙ্গীবাজারের মৃত লাল বাশি দাশের ছেলে জনি দাশ (২৫)।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ (ইন্সপেক্টর) মোহাম্মদ জহিরুল হক ভ‚ঁইয়া পূর্বদেশকে বলেন, আত্মহত্যা চেষ্টার পর বেশিরভাগ রোগী হাসপাতালে আসলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা দেখছি পারিবারিক কলহের জেরে আত্মহত্যা করে। যেটা আমরা লিপিবদ্ধ করে রাখি।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্মহত্যার পেছনে যেসব কারণ দায়ী, এসব চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে না পারলে এ প্রবণতা বাড়তেই থাকবে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেডিকেল অফিসার ডা. শহিদুল আলম বলেন, বর্তমানে করোনাকালীন সময়ে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকাতে টিন কিশোর কিশোরীরা বাসা বাড়িতে থাকতে থাকতে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ফলে সামান্য একটু এদিক-ওদিক হলেই আত্মহত্যার মত পথ বেছে নেয়। এ সময় ছেলে মেয়েদের হরমোন ইম্ব্যালেন্স থাকাতে এ প্রবণতাটা বাড়ে। যেমন- তারা ‘হয় করবো, না হয় মরবো’ বলে এমন এমন জেদ ধরে বসে থাকে যার ফলে আত্মহত্যার বিষয়টি মাথায় চেপে বসে। এছাড়া দেশে বেকারত্বটা অভিশাপ হওয়াতে আত্মহত্যাটাকে পরিণতি হিসেবে নিচ্ছে অনেকে। এ বয়সে তারা আবেগী থাকে। পরিবারের কেউ শাসন করতে গেলেই ঘটে এ ধরনের বিপত্তি।
তিনি আরও বলেন, নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে যৌতুক ও পারিবারিক নির্যাতনে, দাম্পত্য কলহে, পারিবারিক সম্পর্কের জটিলতার কারণে। উত্ত্যক্ত করার কারণেও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। আবার আমরা দেখি অনাকাক্সিক্ষত গর্ভধারণজনিত লোকলজ্জার ভয়েও এ ঘটনা ঘটে থাকে। এর বাইরে রয়েছে প্রেম, পরীক্ষায় ব্যর্থতা। এছাড়া কিছু শারীরিক অসুস্থতার কারণেও আত্মহত্যা হয়ে থাকে। এগুলো হলো- বিষন্নতা, ব্যক্তিত্বের বিকার, সিজোফ্রেনিয়া।
আত্মহত্যা প্রতিরোধ প্রসঙ্গে ডা. শহিদুল আলম বলেন, আত্মহত্যা প্রতিরোধ করতে হলে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। শিশুদের বিকাশের সময় তাদের এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে তারা সফলতার মতো ব্যর্থতাকেও মেনে নিতে পারে। আত্মহত্যার উপকরণ, যেমন ঘুমের ওষুধ, কীটনাশকের সহজলভ্যতা কমাতে হবে। প্রেসক্রিপশন ছাড়া ঘুমের ওষুধ বিক্রি বন্ধ করতে হবে। যেকোনো ধরনের মানসিক সমস্যা বা আত্মহত্যার ইঙ্গিত পেলে দ্রুত মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। এছাড়া বিষণ্ণতা, মাদকাসক্তি, সিজোফ্রেনিয়াসহ সব মানসিক রোগের দ্রুত শনাক্ত করা ও সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। পারিবারিক বন্ধনগুলো দৃঢ় করতে হবে আর পরিবারে প্রত্যেকের সঙ্গে গুণগত সময় কাটাতে হবে। বর্তমান সময়ে (করোনা মহামারি) হতাশা কাটাতে চাইলে ভার্চুয়ালি যোগাযোগ করে মনকে প্রফুল্ল রাখা উচিত। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের সাথে পরামর্শ নেয়া যেতে পারে। তাহলেই আত্মহত্যার প্রবনতা কমিয়ে আনা সম্ভব। তাছাড়া ইসলাম ধর্মসহ সকল ধর্মে আত্মহত্যার ভয়ানক পরিণতির কথা বলা হয়েছে। আত্মহত্যা থেকে বিরত থাকতে আল্লাহ তা’আলা বিশেষভাবে নির্দেশ দিয়েছেন এবং আত্মহত্যার পরিণাম কঠোর শাস্তির বর্ণনা দিয়ে পবিত্র কোরআনে (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ২৯-৩০) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা নিজেদের হত্যা করো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু এবং যে কেউ সীমালঙ্ঘন করে অন্যায়ভাবে তা (আত্মহত্যা) করবে, তাকে অগ্নিতে দগ্ধ করব; এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ।’
আত্মহত্যার ভয়ানক পরিণতি সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজেকে পাহাড়ের ওপর থেকে নিক্ষেপ করে আত্মহত্যা করে, সে জাহান্নামের মধ্যে সর্বদা ওইভাবে লাফিয়ে পড়ে নিজেকে নিক্ষেপ করতে থাকবে। যে ব্যক্তি বিষ পান করে আত্মহত্যা করে, সেও জাহান্নামের মধ্যে সর্বদা ওইভাবে নিজ হাতে বিষ পান করতে থাকবে। আর যে কোনো ধারালো অস্ত্র দ্বারা আত্মহত্যা করে, তার কাছে জাহান্নামে সেই ধারালো অস্ত্র থাকবে, যা দ্বারা সে সর্বদা নিজের পেট ফুঁড়তে থাকবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
আত্মহত্যার প্রবনতা বিষয়ে সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ড. মুহাম্মদ মাসুম চৌধুরী বলেন, শারীরিক সুখের জন্য আমরা সবকিছু করে যাচ্ছি, কিন্তু মানুষের সুখের জন্য কি করতে হবে তা আবিষ্কার করছি না। আমরা যে সবসময় হতাশাগ্রস্ত থাকি, তা থেকে কীভাবে পরিত্রাণ পেতে পারি তা নিয়ে একটু ভাবি না। বর্তমান জীবনে আমরা ভোগের সামগ্রী বাড়িয়ে ফেলেছি, কিন্তু উপভোগ করতে পারছি না। আত্মহত্যা প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে আমাদের সুন্দর একটি পরিবেশ দরকার। এছাড়া ভ্রাতৃত্ববোধ, মমতা, আন্তরিকতা ইত্যাদি বাড়াতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমান সময়ে আমরা ভার্চুয়াল জগতের দিকে মনোনিবেশ হওয়াতে সৃজনশীল কর্মকান্ড থেকে বেরিয়ে এসেছি। আগের মত কিশোর কিশোরীরা মাঠে খেলাধুলা করে না, সবাই এখন মোবাইল ও ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত, সুতরাং এসব গেজেটের প্রভাবে হতাশায় ভুগে তারা। মাথায় যা আসে তা করতে ইচ্ছে করে। আর আমাদের সুস্থ সংস্কৃতি ও সন্তুষ্টি চলে গেছে। আমাদের যা আছে তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে এবং মানসিক চাপ কমিয়ে সুন্দরভাবে জীবন যাপন করতে হবে। তাহলেই আত্মহত্যার মত কঠিন ব্যাধি থেকে সমাজ রক্ষা পাবে।