ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বর্ষণ

21

নিজস্ব প্রতিবেদক

ঘূর্ণিঝড় অশনির প্রভাবে চট্টগ্রামে বৃষ্টি হচ্ছে। কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতেই নগরীর নিম্নাঞ্চলে জমে যাওয়া হাঁটু পানিতে চরম ভোগান্তিতে পড়ে নগরবাসী। গতকাল সোমবার বেলা আড়াইটা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ২২ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টিতে নগরীর নিম্নাঞ্চলের সড়কে সৃষ্টি হয় জলজটের। এতে ভোগান্তিতে পড়েন জনগণ।
বৃষ্টিতে বহদ্দারহাট, চকবাজার, কাপাসগোলা, বাকলিয়া ডিসি রোড, দুই নম্বর গেট, মুরাদপুর, খাতুনগঞ্জ, ফিরিঙ্গিবাজার এলাকার বংশাল রোড, আর. সি. চার্চ রোড, ডা. মান্নান গলি, আলকরণ এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এতে জলাবদ্ধতা নিয়ে নতুন করে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে নগরবাসীর মাঝে। সাথে আছে ড্রেনে পড়ে মানুষের মৃত্যুভয়ও। বর্তমানে নগরীর খালে খালে বাঁধের কারণে জলাবদ্ধতা ও মৃত্যুভয় আরও বেশি অনুভ‚ত হচ্ছে নগরবাসীর। জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজের জন্য বেশ কয়েকটি খালে অস্থায়ী বাঁধ দেওয়া হয়েছিল। কাজের জন্য খাল ভরাট করা হলেও পানি নিস্কাশন ব্যবস্থা পুরোপুরি নিশ্চিত করা হয়নি। যার কারণে কিছু কিছু এলাকায় দীর্ঘ সময় ধরে পানি জমে থাকছে। এতে সংশ্লিষ্ট এলাকায় জলাবদ্ধতা এই অল্প বৃষ্টিতেই উকিঝুঁকি দিচ্ছে। এ অবস্থায় নগরীর জলাবদ্ধতায় জনদুর্ভোগ কমাতে বিভিন্ন খালে থাকা সব বাঁধ ১৫ মে’র মধ্যে অপসারণ করা হবে বলে জানিয়েছেন জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের পরিচালক।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খালের মুখে বাঁধ দেওয়ার প্রধান কারণই হচ্ছে খালে আটকে থাকা পানি অপসারণ করে খাল গভীরভাবে খনন করা। শুকনো মৌসুমে খালের মুখে বাঁধ দেওয়া হয়েছিল। ইতোমধ্যে যে সকল খালের সংস্কার কাজ শেষ হয়েছে সেই সকল খালের মুখের বাঁধ খুলে দেওয়া হয়েছে। চলতি মাসে অর্থাৎ মে মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে বাকি সব খালের সংস্কার কাজ শেষ করে বাঁধ খুলে দেওয়া হবে বলেও জানান তারা। ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ নামে পাঁচ হাজার ৬১৬ কোটি টাকার প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সিডিএ। ২০১৭ সালের ৯ আগস্ট একনেকে অনুমোদন পাওয়া এই প্রকল্পের আওতায় ৩৬টি খালের ৫ লাখ ২৮ হাজার ঘনমিটার মাটি খনন এবং ৪ লাখ ২০ হাজার ঘনমিটার কাদা অপসারণ করা হবে। পানি নিষ্কাশনের জন্য সড়কের পাশে নালা তৈরি করা হবে এক হাজার ৭৭ কিলোমিটার। প্রায় ১০৮ একর জমি অধিগ্রহণ ও রিটেনিং ওয়াল নির্মাণ করা হবে এক লাখ ৭৬ হাজার মিটার। ৮৫ কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করা হবে।
এছাড়াও ছয়টি পিসি গার্ডার ব্রিজ প্রতিস্থাপন, পাঁচটি টাইডাল রেগুলেটর স্থাপন, ৪২টি সিল্ট ট্র্যাপ স্থাপন, বন্যার পানি সংরক্ষণ জলাধার স্থাপন তিনটি, বিদ্যমান নালার সংস্কার ও মেরামত, দুই হাজার বৈদ্যুতিক পোল স্থানান্তর এবং ৮৮০টি স্ট্রিট লাইন স্থাপন হবে। জলাবদ্ধতা নিরসনে এত কিছুর পরও জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি মিলছে না নগরবাসীর। অভিযোগ রয়েছে, প্রকল্পের কাজে ধীরগতির পাশাপাশি সমন্বয়হীনতা রয়েছে। সরেজমিন সোমবার বিকেলে নগরীর ৩৩নং ফিরিঙ্গিবাজার ওয়ার্ড, চকবাজার, চাক্তাই খাল ও পাহাড়তলীতে গিয়ে দেখা যায়, খালের পানির প্রবেশপথে বাঁধ দিয়ে পানি চলাচলের বন্ধ করা হয়েছে। এতে করে বৃষ্টির পানি সহজে বের হতে না পারায় সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা।
খালের মুখ বন্ধ রাখার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সংশ্লিষ্ট কয়েকজন কাউন্সিলর জানান, খাল সংস্কার করার সময় শুকনো মৌসুমে জেলে পাড়া এলাকায় খালের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে এই মুখ আর খোলা হয়নি। এখন বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি সাগরে না যাওয়ার ফলে সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। বারবার সমন্বয় সভায় এই বাঁধ খুলে দেওয়ার কথা বললেও কোন সুফল মেলেনি।
এদিকে ফিরিঙ্গিবাজার এলাকার বংশাল রোড, আর.সি চার্চ রোড, চুরিয়ালটুলী, ডা. মান্নান গলি, আলকরণ ২নং ও ৩নং গলিসহ পুরো এলাকার মানুষ গত ঈদের তৃতীয় দিন বৃষ্টিতে চরম ভোগান্তিতে পড়েন। সেদিন বাসা-বাড়িতে ময়লা পানি ঢুকে গুরুত্বপূর্ণ আসবারপত্র নষ্ট হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
তথ্যমতে, জলাবদ্ধতা নিরসনে মেগা প্রকল্পের অধীনে নগরীর ৪০টি খালের মুখে ‘¯øুইস গেট’ স্থাপনের কাজ চলছে। খালগুলোর মধ্যে ২৩টির প্রবাহ হয় কর্ণফুলী নদীতে ও ৩টির হালদা নদীতে। এছাড়া ১৪টি খাল প্রবাহিত হয় বঙ্গোপসাগরে। রেগুলেটরের ভৌত কাজের জন্য এসব খালের মুখে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। এই বাঁধের কারণেই সামান্য বৃষ্টিতেই নগরজুড়ে তীব্র জলাবদ্ধতা হচ্ছে। ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে জটিলতায় আটকে আছে নগরের ১৮ খালের কাজ। এছাড়া বর্ষা ও জোয়ারের পানির প্রবাহ ঠিক রাখতে নগরীর ৩৬টি খাল খনন, সংস্কারের কাজ চলছে। ভূমি অধিগ্রহণের জটিলতায় ১৮টি খালের কাজ শেষ হচ্ছে না।
এই বিষয়ে সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী হাসান বিন শামস এর বক্তব্য হচ্ছে, নগরীতে জলজট নিরসনে চলমান জলাবদ্ধতা প্রকল্পের কাজে কোন ধীরগতি নেই। স্বাভাবিক নিয়মেই চলছে কাজ। তবে খালের পাশে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায় কিছুটা দেরি হচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কোতোয়ালী মোড় থেকে পাথরঘাটা যাওয়ার সময় সেন্ট প্লাসিড স্কুলের আগে একটি ছোট ড্রেন ছিল। এখন উভয় পাশের ভবন ভেঙে ড্রেনকে চওড়া করার কাজ চলছে। এতে ড্রেনটি বন্ধ রাখতে হয়। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই রাস্তার উপর জমে যাচ্ছে পানি। সিডিএ এভিনিউ রোডের চশমা খাল হয়ে বহদ্দারহাট পর্যন্ত ঘুরে দেখা গেছে, চশমা খালের মোড়ে রিটেইনিং দেয়াল নির্মাণকাজ শেষ হয়নি। ফলে ২৪ ফুট চওড়া খালের পানি বিকল্প চার ফুট চওড়া জায়গা দিয়ে অপসারণ করা হচ্ছে। অপরদিকে মুরাদপুর মোড় থেকে এন মোহাম্মদ পর্যন্ত পুরো এলাকার বেশিরভাগ জায়গা মাটি দিয়ে স্তূপ রয়েছে। পানি চলাচলের কোনো রাস্তা নেই। পুরাতন চান্দগাঁও থানার পাঠানিয়া গোদা সড়কের পাশের খালে এখনো মাটির স্তূপ রয়েছে। তাহলে পানি নামবে কি করে? এই ধরনের প্রশ্ন সংশ্লিষ্টদের। তবে এই বিষয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা সিডিএ বলছে, খালগুলো পরিস্কারের কাজ চলছে দ্রæত। উদ্দেশ্য জলাবদ্ধতার নাগাল টেনে ধরা।
খালে যদি পানি না আসে, ড্রেনগুলোতে যদি পানি আটকে থাকে তাহলে কি করণীয়? এমন প্রশ্নের উত্তরে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, ড্রেনগুলোর কোথাও কোথাও জ্যাম হলে বৃষ্টির সময় পরিষ্কার করে দেওয়া হয়। তবে প্রধান হলো খাল। খাল পরিষ্কার থাকলে পানি নেমে যাবেই।
এদিকে বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড় অশনির প্রভাবে চট্টগ্রামে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস সোমবার রাত ৯টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় ২২ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করেছে বলে জানায়।
বন্দরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ঘূর্ণিঝড়ের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছেন। আবহাওয়া অধিদফতরের সতর্ক সংকেতের ওপর ভিত্তি করে বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। এখনো বন্দরের মূল জেটি, টার্মিনাল ও বহির্নোঙরে কনটেইনার, কার্গো ও শিপ হ্যান্ডলিং স্বাভাবিক রয়েছে।
এই বিষয়ে বাংলাদেশ লাইটার শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা নবী আলম বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব এখনো চট্টগ্রাম বন্দর ও বহির্নোঙরে পড়েনি। বহির্নোঙরে বড় জাহাজ থেকে আজও ছোট জাহাজে খোলা পণ্য খালাস হয়েছে। বেশ কিছু লাইটার জাহাজ এখনো বহির্নোঙরে আছে। তবে বেশিরভাগ লাইটার জাহাজ ও মাছ ধরার ট্রলার কর্ণফুলী নদীর শাহ আমানত সেতুর উজানসহ বিভিন্ন স্থানে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়ের সময় জাহাজডুবির আশঙ্কায় বন্দর চ্যানেল থেকে সব ধরনের নৌযান সরিয়ে দেওয়া হয়। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সবকিছু স্বাভাবিক রয়েছে।