‘ঘুষের সাম্রাজ্যে’ দুদকের হটলাইন আতঙ্ক

86

আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যসহ সরকারি-বেসরকারি সেবা খাতে দীর্ঘদিন ধরে চালু থাকা ‘ঘুষের সা¤্রাজ্যে’ এবার কিছুটা হলেও ঝাঁকুনি দিয়েছে দুর্নীতিবিরোধী একমাত্র রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বিশেষ করে, অভিযোগ জানাতে ২০১৭ সালের জুলাইয়ে হটলাইন নম্বর চালু এবং সদ্যবিদায়ী বছরের জুলাইয়ের শুরুতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক অভিযান চালাতে এনফোর্সমেন্ট সেলের কার্যক্রম শুরুর পর পরিস্থিতি পরিবর্তনের চিত্র দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে।
দুদক সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, চালুর প্রথম সাত কর্মদিবসে প্রায় ৯২ হাজার কল এসেছে সংস্থাটির হটলাইন নম্বর ১০৬- এ। এর মধ্যে আট হাজারেরও বেশি কল রিসিভ করে কথা বলেছেন দুদকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। আর এখন প্রতিদিন গড়ে কল আসছে ১৩ হাজারেরও বেশি। পরবর্তী সময়ে আইন ও লজিস্টিক সাপোর্ট সংক্রান্ত নানাদিক থেকে ক্রমান্বয়ে সমৃদ্ধ হওয়া দুদক হটলাইন চালুর একবছরের ব্যবধানে তদন্ত ও অনুসন্ধান অনুবিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মহাপরিচালকের তত্ত¡াবধানে এনফোর্সমেন্ট সেলের কার্যক্রম শুরু করে। এরপর গত ছয় মাসে এনফোর্সমেন্ট সেল হটলাইনে পাওয়া অভিযোগ আমলে নিয়ে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আড়াই শতাধিক অভিযান পরিচালনা করেছে। প্রতিটি অভিযানে হাতেনাতে ধরা পড়েছেন সেবাখাত কিংবা সরকারি প্রশাসনের ‘ঘুষখোর’ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। হটলাইন নম্বরে অভিযোগ পাওয়ার পর সর্বশেষ গত ১০ জানুয়ারি দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা কাস্টম হাউসে অভিযান চালিয়ে ঘুষের ছয় লাখ টাকাসহ একজন রাজস্ব কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করে দুদক। গ্রেপ্তার ব্যক্তি হলেন কাস্টমসের রাজস্ব কর্মকর্তা (প্রশাসন) নাজিম উদ্দিন আহমেদ। এসময় কাস্টমস কর্তৃপক্ষের উপস্থিতিতে তার কক্ষে থাকা স্টিলের আলমিরা খুলে নগদ ছয় লাখ টাকা জব্দ করা হয়।
এনফোর্সমেন্ট সেলের সমন্বয়কারী দুদক মহাপরিচালক (প্রশাসন) মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী পূর্বদেশকে বলেন, ‘রাষ্ট্রের জনগণের করের টাকায় সরকারি অফিস চলে। সেই অফিসে যদি জনগণকে ঘুষ দিয়ে সেবা নিতে হয়, তাহলে জাতি হিসেবে তার চেয়ে বড় কলঙ্ক আর কিছু থাকতে পারে না। জনস্বার্থ সংরক্ষণ ও হয়রানিমুক্ত সেবাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্যই হটলাইনে পাওয়া অভিযোগ অনুযায়ী দ্রæততম সময়ে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। সেবা দিতে গিয়ে দুর্নীতি করে কেউ পার পাবে না। ঘুষের বিনিময়ে সেবাদানকারী যে কর্মকর্তা-কর্মচারি আজ ধরা পড়ছে না, মনে রাখতে হবে আগামীকালের পালা তার জন্যই নির্ধারিত রয়েছে। আজ হোক কিংবা কাল হোক তাকে ধরা পড়তেই হবে।’
দুদক জানায়, শুরু থেকে নানা পদ্ধতি বিদ্যমান থাকলেও ২০১৭ সালের ২৭ জুলাই সংস্থাটি আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ দেয়ার জন্য টেলিফোন হটলাইন চালু করে। সংবাদমাধ্যমে তা ব্যাপকভাবে প্রচারও করা হয়। আর তাতে ভুক্তভোগী নাগরিকরা যাতে অভূতপূর্ব সাড়া দেন। চালুর প্রায় দেড় বছরে হটলাইন নম্বর- ১০৬ এখন দুদকের রাডার। এক জায়গায় বসেই এই রাডারে সারাদেশের দুর্নীতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এ অভিযানের ফলে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর, অধিদপ্তরের অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারিরা প্রতিনিয়ত আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। ঘুষখোর কর্মকর্তা-কর্মচারিদের মধ্যে বিরাজ করছে অস্থিরতা। অফিসের ভেতরে-বাইরে থেকে হটলাইনে ফোন করে কখন কে বা কারা ঘুষ, দুর্নীতি ও জালিয়াতির খবর বলে দিচ্ছে- এই ভয় কাজ করছে তাদের মনে। দেশের যে কোনও প্রাপ্ত থেকে যে কোনও মানুষ প্রতিদিন সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত হটলাইনে কল করে দুর্নীতির যে কোনও তথ্য ও অভিযোগ জানাতে পারেন। এটি একটি হান্টিং নম্বর। একইসঙ্গে ৩০টি ফোন কল করা যায় এই নম্বরে। এর সঙ্গে কম্পিউটার সংযুক্ত করা আছে। তাই কোনও কল রিসিভ করা না গেলে যিনি কল করেছেন তার ফোন নম্বর রেকর্ড হয়ে যায়। আর যাদের কল রিসিভ করা হয়, তাদের কথোপকথনও রেকর্ডে থাকে। এই কল সেন্টারে কমপক্ষে সহকারী পরিচালক পদমর্যাদার কর্মকর্তারা কাজ করছেন। ছুটির দিন বাদে মোট ২০ জন কর্মকর্তা পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করেন এই কল সেন্টারে।
সূত্র জানায়, বিদায়ী বছরের জুলাইয়ের শুরুতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক অভিযান চালাতে কমিশন এনফোর্সমেন্ট সেলের কার্যক্রম শুরু করে। অফিস-আদালতে হয়রানি ও ভোগান্তির খবর পাওয়া মাত্র হাজির হচ্ছেন সেলের সদস্যরা। হয়রানিমুক্ত কাজ নিশ্চিত করছেন তারা। দুদক পুলিশ ইউনিটের সদস্যরাও থাকছেন অভিযানে। ঢাকার বাইরে ক্ষেত্রবিশেষে দুদকের কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী সংশ্নিষ্ট ডিসি, এডিসি, ইউএনও ও ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে অনিয়ম, দুর্নীতি, প্রতারণা এবং জালিয়াতির বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হচ্ছে। অভিযান চলাকালে দুর্নীতি ও হয়রানিমুক্ত সেবা নিশ্চিত করার দিকনির্দেশনা দেয়া হয়। প্রয়োজনে পদ্ধতিগত পরিবর্তনের পরামর্শও দেয়া হচ্ছে। তাদের উপস্থিতিতে অভিযোগকারীদের কাজটিও দ্রæত সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করা হয়। এনফোর্সমেন্ট সেলের সমন্বয়কারীর নেতৃত্বে সারাদেশে সরকারি প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতিবিরোধী এই অভিযান আরও জোরদার করা হচ্ছে। এনফোর্সমেন্ট সেলের কার্যক্রম শুরুর পর গত ছয় মাসে পাসপোর্ট অধিদপ্তর, বিআরটিএ, বিমানবন্দর, কারাগার, শুল্ক অধিদপ্তর, সিভিল সার্জন, ওয়াসা, হজ এজেন্সি, বিএমডিসি, রাজউক শিক্ষা ভবন, হাসপাতাল, সিএজি, বিএসটিআই, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আড়াই শতাধিক অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সরকারের সব ধরনের প্রতিষ্ঠানেই এই অভিযান পরিচালনা করা হবে। শুরুর দিকে সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানে অভিযান পরিচালনায় গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। দুর্নীতি দূরীকরণে সংস্থাটি অনুসন্ধান ও তদন্তের পাশাপাশি দুর্নীতিবিরোধী অভিযানকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে। প্রয়োজনে সরকারি ছুটির দিনেও অভিযান চালানো হচ্ছে।