গণসমাবেশ

31

নিজস্ব প্রতিবেদক

মঞ্চজুড়ে নেতা, মাঠজুড়ে ‘জনতা’ : বিএনপির চট্টগ্রাম বিভাগীয় গণসমাবেশে কর্মী-সমর্থকদের উপস্থিতিতে পলোগ্রাউন্ড মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। বিভিন্ন জায়গা থেকে দলে দলে নেতাকর্মীরা যোগদান করেন সমাবেশস্থলে। শুধু পলোগ্রাউন্ড নয়, আশপাশের এলাকায়ও প্রচুর মানুষের উপস্থিতি দেখা যায়। গণসমাবেশকে ঘিরে আশপাশের এক কিলোমিটারজুড়ে লোকারণ্যে পরিণত হয়।
গতকাল বুধবার দুপুর ২টা থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামবৃদ্ধি, পুলিশের গুলিতে নেতাকর্মীদের হত্যা ও বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে এ গণসমাবেশের আয়োজন করে বিএনপি। নির্ধারিত সময়ের আগেই সকাল থেকে পলোগ্রাউন্ড
মাঠে প্রচুর নেতাকর্মী-সমর্থকের উপস্থিতিতে সরব হয়ে উঠে পলোগ্রাউন্ড মাঠ। দুপুর গড়াতেই পূর্ণতা পায় পলোগ্রাউন্ড মাঠ।
বিপুল মানুষের উপস্থিতি পেয়ে নির্ধারিত সময়ের একঘণ্টা আগে শুরু হয় সমাবেশ। তাছাড়া নির্ধারিত সময়ের আগেই সমাবেশস্থলে উপস্থিত হন অতিথিরাও।
সমাবেশে প্রধান অতিথি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, খন্দকার মোশাররফ হোসেনসহ কেন্দ্রীয় নেতারা দুপুরের আগেই সমাবেশ স্থলে উপস্থিত হন।
চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন জায়গা থেকে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা মিছিল নিয়ে সমাবেশস্থলে আসতে শুরু করেন। প্রচুর রোদ উপেক্ষা করে ভিড় করতে থাকেন মাঠে। দুপুর ২টার দিকে যখন কেন্দ্রীয় নেতারা বক্তব্য রাখছিলেন তখন পলোগ্রাউন্ড মাঠ জনসমুদ্রে পরিণত হয়। মাঠে প্রচুর ভিড় থাকায় অনেকে সমাবেশস্থলে প্রবেশ করতে পারেনি। টাইগারপাস, সিআরবি, কদমতলী, বিআরটিসি মোড় এলাকা পর্যন্ত প্রচুর মানুষের ভিড় পড়ে যায়।
এদিকে সমাবেশ স্থলে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা মিছিল সহকারে যোগদিতে থাকেন। এসময় বিভিন্ন নেতার নামে ব্যানার, পেস্টুন, টিশার্ট, মাথার ক্যাপ দেখা যায়। ‘খালেদা জিয়ার মুক্তি’ ও ‘শেখ হাসিনার পদত্যাগ’ দাবি করে বিভিন্ন ¯েøাগান দিতে দিতে সমাবেশ স্থলে প্রবেশ করেন তারা। সমাবেশে উপস্থিত কিছু কর্মীর হাতে জাতীয় পতাকা ও বাঁশের লাটি ছিল। অবশ্য পুলিশ কড়া পাহারায় দিল বিভিন্ন পয়েন্ট।
বিএনপি নেতাকর্মীদের অবস্থানের কারণে টাইগারপাস থেকে নিউমার্কেট ও সিআরবি এলাকায় যানচলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আশপাশের বাকি সড়কগুলোতেও যানচলাচল অস্বাভাবিকভাবে কমে যায়।
সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহবায়ক ডা. শাহাদাত হোসেন। সমাবেশ পরিচালনায় ছিলেন নগর বিএনপির সদস্য সচিব আবুল হাশেম বক্কর ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহবায়ক আবু সুফিয়ান। চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম সমাবেশে উপস্থিত নেতাকর্মীদের শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য বারবার তাগিদা দেন।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্যের পর সামবেশ শেষ হয়। প্রধান অতিথির বক্তব্যের আগেই সভাপতির বক্তব্য রাখেন ডা. শাহাদাত হোসেন।
সমাবেশে উপস্থিত কর্মী-সমর্থকরা মনে করছেন চট্টগ্রামে বিএনপির এটাই সবচেয়ে বড় সমাবেশ। এর আগে ২০১২ সালে খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে পলোগ্রাউন্ডে সমাবেশ করেছিল বিএনপি। সেই সমাবেশকে এতোদিন চট্টগ্রামে বিএনপির সর্ববৃহৎ জমায়েত হিসাবে দেখা হতো। তবে খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে পলোগ্রাউন্ডের সমাবেশে আরো বেশি মানুষের উপস্থিতি হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

সেলফি তোলার হিড়িক, হুড়োহুড়ি :
সিনিয়র নেতাদের নির্দেশনা উপেক্ষা করে মঞ্চের সামনে হুড়োহুড়ি করেছেন বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। গণসমাবেশের মঞ্চের সামনে ভিড় করে ধাক্কাধাকিও করেছেন তারা। কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে সেলফি তুলতেই এমন হুড়োহুড়ি করেছেন বিভিন্ন জেলা থেকে আসা বিএনপি, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। অন্যদিকে মঞ্চে ভিড় পড়ে নেতাদের। দু’টি লরির মাধ্যমে তৈরি করা মঞ্চে ভিড় করেন শতাধিক নেতা।
দুপুর ২টার দিকে মঞ্চে উপস্থিত হন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, খন্দকার মোশাররফ হোসেন, শ্যামা ওবায়েদ, ইশরাক হোসেনসহ অনেক নেতা। তাদের উপস্থিতিতে সমাবেশ স্থলে দলে দলে যোগদান করতে শুরু করেন বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা নেতাকর্মীরা। কড়া রোদের মধ্যে খন্ড খন্ড মিছিল নিয়ে মাঠে প্রবেশ করা প্রতিটি দলই চলে যায় মঞ্চের সামনে। মাথায় নানান রঙের টুপি, ব্যানার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড, ধানের শীষ হাতে আসা মিছিলগুলো মঞ্চের সামনে এসে হুড়োহুড়িতে জড়িয়ে পড়ে। মঞ্চ থেকে বারবার তাদের স্লোগান ও ব্যানার নামিয়ে ফেলতে অনুরোধ আসে। কিন্তু মঞ্চের সামনে আসা নেতাকর্মীদের সেলফি তুলতেই বেশি ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীর বারবার নির্দেশনা স্বত্বেও নেতা-কর্মীরা মঞ্চের সামনে এসে স্লোগান দিতে থাকেন। বক্তব্য চলাকালে মঞ্চে সেলফি তুলতে গিয়ে তর্কেও জড়ান এক নেতা। তাছাড়া মঞ্চের সামনে থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লাইভে গিয়েও নিজেদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি করেছেন নেতাকর্মীরা।
মঞ্চের সামনের নেতাকর্মীরা যখন সেলফিতে ব্যস্ত তখন মঞ্চের থাকা সিনিয়র নেতাদের মধ্যে মঞ্চ দখলের ব্যস্ততাও ছিল। শতাধিক নেতার উপস্থিতিতে লরির অস্থায়ী মঞ্চটি পরিপূর্ণ হয়ে উঠে। সেখানে গাদাগাদি করেই বসতে হয়েছে নেতাদের। অনেক নেতা বসার সুযোগ না পেয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। মঞ্চে নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা কমিটির দায়িত্বে থাকা কর্মীদের সঙ্গে তর্কাতর্কির ঘটনাও ঘটেছে।
জ্বালানি তেল ও নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, দলীয় কর্মসূচিতে গুলি করে নেতা-কর্মীদের হত্যার প্রতিবাদ এবং নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে বিএনপি গতকাল পলোগ্রাউন্ড মাঠে চট্টগ্রাম বিভাগীয় গণসমাবেশের আয়োজন করে।

‘নারায়ে তাকবীর’ স্লোগান সাকাপুত্রের :
বিভাগীয় গণসমাবেশে ‘নারায়ে তাকবীর’ স্লোগান দিয়ে আলোচনায় এসেছেন কেন্দ্রীয় বিএনপির সদস্য হুম্মাম কাদের চৌধুরী। দীর্ঘদিন আড়ালে থাকলেও বিএনপির মহাসমাবেশকে ঘিরে তিনি আবার সামনে আসলেন। সমাবেশে বক্তব্য ছাড়াও তিনি গত মঙ্গলবার মহানগর বিএনপির দলীয় কার্যালয় নাসিমন ভবনেও উপস্থিত ছিলেন। হুম্মাম কাদের একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসি হওয়া সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে।
পলোগ্রাউন্ড মাঠে সমাবেশে বক্তব্যের এক পর্যায়ে তিনি তিনবার ‘নারায়ে তাকবীর’ স্লোগান দেন। এ সময় মঞ্চে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন। হুম্মাম কাদেরের তিনবারের নারায়ে তাকবীর স্লোগানে পাল্টা সাড়া দিয়ে বিএনপি নেতারাকর্মীরা ‘আল্লাহ আকবর’ বলেন।
বক্তব্যে হুম্মাম বলেন, বেশি সময় নেব না। অনেক সিনিয়র নেতা এসেছেন। আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি, কোন বড় নেতা হিসেবে নয়। আজকে এসেছি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হিসেবে।
আমরা আবার এই ময়দানে আসব, সরকার গঠন করে ময়দানে আসব মন্তব্য করে তিনি বলেন, আপনারা সকলের সাথে থাকলে আমাদের পরাজিত করার শক্তি কারো নেই। এই আওয়ামী লীগ সরকারকে বলে দিতে চাই, ক্ষমতা ছাড়ার পর একা বাড়িতে যেতে পারবেন না। বাধ্য করবো প্রত্যেকটা শহীদের বাড়িতে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে যেতে হবে। যাবার আগে বাবার স্লোগান আপনাদের বলে যেতে চাই ‘নারায়ে তাকবীর’ ‘নারায়ে তাকবীর’ ‘নারায়ে তাকবীর’।
হুম্মাম কাদের চৌধুরীর পিতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৭১ সালে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের দায়ে ২০১৫ সালের নভেম্বরে তাকে ফাঁসি দেয়া হয়। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ভাই গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী বর্তমানে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন।

ক্রাচে ভর করে লক্ষীপুর থেকে সমাবেশে কামাল :
ঘর থেকে ডেকে নিয়ে পুলিশ গুলি করে পায়ে। এরপর সেই পা কেটে ফেলতে হয়। তারপরও দমে যায়নি যুবদল নেতা কামাল উদ্দিন। সরকারের পতনের দাবিতে ক্র্যাচে ভর করে লক্ষীপুর থেকে ছুটে এসেছেন বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশে যোগ দিতে।
লক্ষীপুর সদর থানা যুবদলের প্রচার সম্পাদক কামাল উদ্দিন। তিনি বলেন, ২০১৫ সালের মে মাসে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে পুলিশ আমার পায়ে গুলি করে। এরপর ডান পা কেটে ফেলতে হয়। রাত ৩টায় ঘর থেকে ডেকে নিয়ে আমাকে পুলিশ গুলি করে পঙ্গু করে দিয়েছে। আমর অপরাধ হচ্ছে, আমি যুবদল করি। আমার বিরুদ্ধে ৫টি মিথ্যা মামলা করেছে পুলিশ।
তিনি বলেন, আমি জিয়ার আদর্শের সৈনিক। বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। কিন্তু এই সরকার একনায়কতন্ত্র কায়েম করেছে। তাই আওয়ামী লীগের পতন চাই।
চার সন্তানের জনক কামাল বলেন, আদর্শের টানে সমাবেশে এসেছি। দানব সরকারের পতনের দাবিতে এসেছি।