গণমাধ্যমকে নাচাচ্ছে সামাজিক মাধ্যম!

11

তুষার দেব

প্রযুক্তির উত্তরোত্তর উৎকর্ষতার ফলে পারস্পরিক যোগাযোগ এবং তথ্যের প্রবাহ ও বিস্তারে যে বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে তার ভাল-মন্দ উভয়দিকই টের পেতে শুরু করেছে মানুষ। ইন্টারনেট বা ওয়াই-ফাই সংযোগভিত্তিক অ্যাপনির্ভর যোগাযোগ ব্যবস্থা বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কোনও কোনও ক্ষেত্রে মূলধারার গণমাধ্যমকে নাচাচ্ছে। সবার আগে তথ্য পরিবেশনের প্রতিযোগিতার চাপে অনেক সময় হারিয়ে বসছে যাচাইয়ের দায়িত্বশীলতা। সামাজিক মাধ্যমের প্রভাবে গণমাধ্যমের খবরের সত্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্নের পাশাপাশি গুজব ও রটনার রাজত্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে।
তবে প্রযুক্তিবিশারদ ও গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক মাধ্যমের ব্যাপক উত্থানের পরেও বিশ্বাসযোগ্যতার জন্য সংবাদের ক্ষেত্রে এখনও মানুষ গণমাধ্যমের ওপরই নির্ভর করে। তাই সামাজিক মাধ্যমের কারণে গণমাধ্যমে একেবারে ধস নেমে এসেছে- এমনটি বলা যাবে না। আর সামাজিক মাধ্যমের মতো গণমাধ্যমেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। সামাজিক মাধ্যম যেমন পৌঁছে গেছে একবারে সাধারণ মানুষটির কাছে, তেমনি গত তিন দশকে গণমাধ্যমের ব্যবহার এবং ব্যবহারের ধারণায় বিপ্লব সাধিত হয়েছে। আকাশ সংস্কৃতির সঙ্গে বেসরকারি বা প্রাইভেট চ্যানেলের ব্যাপক প্রসার এবং সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহারে গণমাধ্যম বদলে গেছে।গণমাধ্যম ব্যাপক বিষয়কে ধারণ করছে ও বহুমাত্রিক ভূমিকা রাখছে। বদলে গেছে গণমাধ্যমের কৌশলও। নানাভাবে জনগণের একেবারে কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে, গ্রহণ করছে জনগণের প্রতিক্রিয়া এবং জনগণের প্রতিক্রিয়াকে মূল্যায়ন করার চেষ্টা করছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, গণমাধ্যমের পরিবর্তন, সম্প্রসারণ, সামাজিক মাধ্যমের শক্তিশালী হয়ে যাওয়া সকলের হাতে হাতে স্মার্টফোন সবকিছু মিলিয়েই প্রচলিত ধারণা থেকে অনেক এগিয়ে গেছে বর্তমান সাংবাদিকতার ক্ষেত্র। খবরের কাগজ থেকে রেডিও-টেলিভিশন, অনলাইন থেকে মাল্টিমিডিয়া জার্নালিজমের ধারায় প্রচলিত অনেক ধারণাই পাল্টে যাচ্ছে। বলা হচ্ছে সিটিজেন জার্নালিজম বা জনসাংবাদিকের কথা। জার্নালিজমের এই ক্ষেত্রটি এখন স্বীকৃত। এখন সবাই খবরের কর্মী। সিটিজেন জার্নালিজম অন্তত তাই বলে। সিটিজেন জার্নালিজম মূল জার্নালিজমের ক্ষেত্রকে কঠিন করে দিয়েছে। অনলাইন জার্নালিজমের পরে যে ক্ষেত্রটি আলোচিত হচ্ছে, তা হলো মাল্টিমিডিয়া জার্নালিজম। যা মূলত অনলাইন জার্নালিজমের একটি বর্ধিত অবয়ব। অনলাইন জার্নালিজম বলতে বোঝাতো শুধু নিউজ পোর্টালগুলোকে। ইউটিউব, ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপসহ অন্য মাধ্যমগুলোকে খুব একটা গোনায় ধরা হতো না। অথচ এখন ইউটিউব তথ্যের জগতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সাক্ষাৎকার, এক্সক্লুসিভ ক্লিপ থেকে ডেইলি ইভেন্টও উঠে আসছে ইউটিউবের মতো সামজিক গণমাধ্যমে।
অপরদিকে, মূলধারার গণমাধ্যমের মত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি হয়নি এটা যেমন সত্য, তেমনি এটাও সত্য যে- এই বিশ্বাসযোগ্যতার ঘাটতি নিয়েও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সংবাদের একটি বড় উৎসে পরিণত হয়েছে। শুধু তাই নয় পরিবর্তিত সাংবাদিকতায়ও বিরাট ভূমিকা রাখছে। এমন বেশ কিছু সংবাদ আছে যা শুধু সামাজিক মাধ্যমের জন্যই গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। রাজধানী ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিসান বেকারিতে জঙ্গি হামলার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ভিডিও ফুটেজটি ছিল পাশের এক ভবন থেকে এক কোরীয় নাগরিকের ধারণ করা এবং ফেসবুকেই সেটা প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল, যা মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়। পরবর্তীতে এটি সংবাদ মাধ্যম এবং গণমাধ্যমের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। হলি আর্টিসানের ঘটনার তদন্তকারীরা ভিডিওচিত্র থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পান। এমন আরও অনেক উদাহরণ টানা যাবে যেখানে সংবাদের ক্ষেত্রে সামাজিক মাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। যেমন দিনে-দুপুরে রাস্তায় কুপিয়ে বিশ্বজিৎকে হত্যা, বইমেলা থেকে ফেরার পথে লেখক-বøগার অভিজিৎ রায় হত্যা, কলেজছাত্রী খাদিজাকে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা, নগরীর ব্যস্ততম জিইসি মোড়ে শীতের সকালে এসপি পত্নী মাহমুদা খানম মিতু হত্যা-এরকম আরও অনেক আলোচিত বিষয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণেই সাধারণের নজরে এসেছে। সিলেটের কিশোর রাজন হত্যাকান্ড নিয়েও সবার আগে সোচ্চার হয়ে ওঠে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।
সামাজিক মাধ্যমে এমন অনেক তথ্য শেয়ার বা পরিবেশন করা হয়, যেটা মূলধারার সংবাদপত্র বা টিভি চ্যানেলে হয়তো উঠে আসে না। মূলধারার সাংবাদিকতার ওপর অনেক ধরনের চাপ বিদ্যমান থাকে, তা যেমন সরকারের তেমনি মালিকপক্ষের। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সে রকমের কোনও চাপের মোকাবেলা করতে হয় না বলে অনেক তথ্যই সহজে সামাজিক মাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশ সম্ভব। সামাজিক মাধ্যমের সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে জনগণের প্রতিক্রিয়া তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায়। এরকম নানা সুবিধার কারণে মূলধারার গণমাধ্যমের ওপরও সামাজিক মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুকের প্রভাব বেড়েই চলছে। এর অন্যতম কারণও হলো ওই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া।
এদিকে বিকাশমান তথ্য-প্রযুক্তিনির্ভর যোগাযোগ ব্যবস্থার কল্যাণে সামাজিক মাধ্যম, মোবাইল, ক্যামেরা এবং ভিডিওর ব্যবহার প্রচলিত সাংবাদিকতাকে ভেঙে দিচ্ছে, নানাভাবেই মুহূর্তের মধ্যেই নানা তথ্য ছড়িয়ে পড়ছে- এই বিষয়টি নানাভাবে বিপদসংকুলও করে ফেলছে সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বকে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এটি কখনও কখনও ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। দেশে এখনও ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিষয়ে বেশিরভাগ মানুষেরই স্পষ্ট ধারণা নেই। তাদের ওপর ভ্রান্ত সংবাদ, গুজব বা অপপ্রচার, এডিটেড ভিডিও মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করছে। কখনও কখনও মিথ্যা সংবাদ এবং এডিটেড ভিডিও ভিজুয়্যাল ম্যাটার দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে এবং মুহূর্তেই সমাজকে অস্থিতিশীল করে তুলছে। সামাজিক মাধ্যমের এই ব্যাপক প্রভাবকে নেতিবাচকভাবে ব্যবহার করছে নানা শ্রেণি ও দল, ব্যবহার করা হচ্ছে স্বার্থগত ফায়দা হাসিলে। সামাজিক মাধ্যমের এই নীতি ও নৈতিকতাবিরোধী ভূমিকার জন্য অনেকেই তাই প্রশ্ন রাখেন সামাজিক মাধ্যম আদতেই সামাজিক হয়ে উঠতে পেরেছে কি না?
নগরীর বহদ্দারহাটে সিডিএ নির্মিত ফ্লাইওভারের কালুরঘাটমুখি র‌্যাম্পের পিলারে ফাটল নিয়েও সামাজিক মাধ্যমে খবর-বেখবরের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। পিলারের দৃশ্যমান ফাটল সদৃশ অংশটা আদৌ ফাটল কিনা তা যথার্থভাবে খতিয়ে দেখার বিষয়টির প্রতি জাস্টিস হয়েছে কিনা এমন প্রশ্ন আসছে যখন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞরা বলছেন এটা ফাটল নয়। তাহলে কেবল একটা ছবিকে নিউজ সোর্স হিসেবে নিয়ে কয়েকজন প্রকৌশলী যারা নিজেরাও ঘরে বসে কমেন্ট করেছেন তাদের বক্তব্য দিয়ে নিউজ হয়ে গেল। যোগ হলো আতঙ্কের সাথে বিস্ময়। এ জায়গাতে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন সোশ্যাল মিডিয়া এখন নিউজ মিডিয়াকে নাচাচ্ছে। নির্মাণকারী সংস্থার তরফে পরিদর্শনের পর বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীরা একে ফাটল নয় বলে মন্তব্য করলেও সামাজিক মাধ্যমে নাগরিকদের অনেকেই তাদের মন্তব্যের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। অনেকে জনমনে সৃষ্ট বিভ্রান্তি ও আতঙ্ক নিরসনে নাগরিক সেবাদানকারী সংস্থা চসিক ও সিডিএ’র সমন্বিত বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন এবং সেই কমিটির পরিদর্শন ও মতামতেই অধিক নির্ভরতা খুঁজে পাওয়ার আশা করছেন।