খাদ্যে স্বনির্ভরতা নিশ্চিত করতে কৃষির ওপর জোর দিতে হবে

7

 

আমাদের ছোট চাচা ধনমিয়া এক অদ্ভুত প্রকৃতির লোক ছিলেন; পেশায় একজন ছাগল ব্যাপারী ছিলেন। পেশাটাকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। কর্মই ধর্ম। একবার তিনি একটি পাটনাইয়া ছাগল ক্রয় করে আনলেন। ‘পাটনা’ইয়া বললেই অনায়াসে বুঝাযায় এটি ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য, বিহারের রাজধানী শহর। আর পাটনাইয়া ছাগলের প্রজাতিটা দেখলেই সহজে অনুমেয়। ইয়া লম্বা-লম্বা কান, চাঁদের মতো বাঁকা মুখ, ঘাড়ও হাতদেড়েক লম্বা, উচ্চতা ছোটখাটো একটি গরুর বাচুরের মতো। এ প্রজাতির ছাগলের গতিবিধি ও আচরণ অদ্ভুত প্রকৃতির হয়। অনেকটা সাহেবী সাহেবী ভাবসাব; কিন্তু ছেঁড়া বা কুঁড়ে পাওয়া কাগজ দেখার সাথে সাথে মচমচিয়ে-চিবিয়ে খেয়ে সাবাড় করে। এ ছাগলটিরও একই হালহকিকত ছিল! আমরা তা দেখে আহাম্মক বনে যাই; এরপর তিনি আরেকটি বড়সড়ো-তাজা ছাগল ক্রয় করে আনলেন। এ ছাগলটিও রীতিমত মানুষের মতো ভাত খেতো; অবশ্য এটি দেশীয় প্রজাতির ছাগল। আমরা বরাবরই এসব ব্যতিক্রম ঘটনায় কৌতুহলি হয়ে ওঠি- আবার চাচা কখন কি ঘটনা ঘটিয়ে বসে, তা বলাই মুশকিল। এরমধ্যে একদিন চাচাকে দেখলাম বস্তা-বস্তা চুল এনে জমিনে ছিটাচ্ছে; জমিনে চুল দিলে নাকি ভালো ফলন হয়! চাচার এক বন্ধু চাচাকে এ বুদ্ধি দিয়েছেন। ওই বন্ধুর বাজারে একটি সেলুনের দোকান রয়েছে। প্রতিদিন কাটিংসাটিং করা সব চুল দোকানে বস্তাভর্তি করে জমিয়ে রাখতেন। ওই দোকানদার বাজারের আরো কয়েকটি সেলুনের দোকান ঠিকটাক করে দিলেন। তিনিও প্রতিদিন জমিয়ে রাখা ২-৩ বস্তা চুল এনে জমিনে দিতে লাগলেন। অবশ্য চাষ করা জমিটা চাচার ছিল না। খাজনা দিয়ে বর্গা নেন তিনি। সেবার তরমুজ-বাকি চাষ করলেন। সেকি গাধার খাটুনি না খাটলেন। যথাসময়ে পানি, গোবর ও ফসফরাস সার দিয়েছেন। দেখাগেল, কিছুদিন পর তরমুজ-বাকির চারা ঝিমে ঝিমে মড়ক ধরে। অবশেষে যা কয়েকটি ছিল তাতেও ফলন ভালো হয়নি। এরপরও চাচা ক্ষান্ত হলেন না, শেষ না হওয়া পর্যন্ত দেখেই ছাড়বেন। এরকম তাঁর জেদ। এবার ওই জমিতে ধান চাষ করেন। ধান চাষেও চাচার মাথায় হাত! ভালো ফলন হয়নি, চারাধানের ডগায় মোছড়বালাই পেয়ে বসে। নামমাত্র দু-এক ডগা ছিল, তাতে আর ভালো ফলন হয়নি। সত্য কথা কি তিনি পেশাদার কৃষক ছিলেন না। কিন্তু কৃষিকাজে ছিল তীব্র আগ্রহ। এখন কৃষিতে প্রকৃত কৃষকদেরও আগ্রহ হ্রাস পাচ্ছে। হাঁড়ভাঙা খাটুনি খেটে তাঁরা ফসলের ন্যায্যমূল্য পায় না।
চাচার ওই বর্গাজমিতে কৃষিকাজ হয় না; আবাসন ব্যবসায়ীরা ইট-বালি দিয়ে ৮-৯ খন্ড করে অধিক চড়া মূল্যে বিক্রয় করে দেয়। তাদের দেখাদেখিতে আশপাশের সব কৃষি জমির মালিকরা অভিনব আচরণ করে বসে। তারাও দখল হওয়ার ভয়-ভীতিতে জমির চতুর্দিকে উঁচু উঁচু দেয়াল দিতে থাকে। সঙ্গে গাছগাছালি রোপন করেই চলছে। এতে করে পার্শ্ববর্তী কৃষি জমিও চাষের অনুপযোগি হয়ে পড়ে। একই সাথে পানি চলাচলের পথেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে চলেছে। তাদের এমন খেয়ালখুশি যে, হঠাৎ মাঠের মধ্যখানে সুনির্দিষ্ট একটি কৃষিজমিতে উঁচু দেয়াল-ঘেরা লক্ষ্য করা যায়। প্রথমে আমলে না নিলেও পরক্ষণে কৃষি জমি গ্রাস হতে থাকে। হয়তো এমন ঘেরা দেখে বলবেন, কারণ কি কৃষি জমিতে দেয়াল কেন? প্রত্যুত্তরে শোনাযায়, জায়গাটি ‘অমুকে’ কিনেছে। তাই ইটের দেয়ালের ঘেরা দেয়া হয়েছে। যদি প্রশ্ন করেন, জায়গা কিনলে কি ঘেরা দিতে হয়? জায়গাটি দ্বিতীয় কেউ কি দখল করে নেবে? এমন আশঙ্কা কি বিদ্যমান? জায়গাতো স্থিত আছে। এ ভাবেই কৃষি জমি ঘেরা দেয়া হচ্ছে। আর আশপাশের সব কৃষি জমি নষ্ট হতে চলেছে।
আবার বলাবলি করলে দেখাদেয় হৈচৈ-হাঙ্গামা-মামলা। থানা-কোর্টকাচারিতে যেতে দ্বিধা করে না! এ হলো বাস্তব পরিস্থিতি। এভাবে হাজারো সমস্যা অক্টোপাসের মতো খামছে ধরেছে।
বরাবরই বলে আসছি, ভূমি ক্ষয়রোধ প্রকল্পের কথা। এটি এমন একটি প্রকল্প, একাধারে আবাসন সমস্যা লাঘব হবে, অন্যদিকে কৃষিজমি পুনরুদ্ধারসহ বহুগুণ বেড়ে যাবে। বেকার সমস্যা হ্রাস পাবে। খাদ্যে নির্ভরতা বাড়বে। যত্রতত্র রাস্তা নির্মাণ ও সংস্কারের নামে অতিরিক্ত ব্যয় সাশ্রয় হবে। রূপরেখাটি আমার লেখা ‘ভূমিপুত্র’ উপন্যাসে রয়েছে। গ্রন্থটি ২০১০ সালে চট্টগ্রামের ‘অবনী’ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়। অনেকটা এ রূপরেখার আদলে কক্সবাজারের খুরুশকুলসহ দেশের কয়েকটি স্থানে পরিক্ষামুলক প্রকল্প নেয়া হয়। কিন্তু মাঝপথে এসে এটি থমকে যায়। দেশে বড় বড় মেগা প্রকল্প হাতে নিতে গিয়ে জাতীয় বাজেটের সিংহভাগ ব্যয় হচ্ছে। এক্ষেত্রে আমজনতার দ্বিবাস্বপ্ন-অধরা রয়ে গেল। শুধু একটি নির্দিষ্টস্থানে সিঙ্গাপুরের মতো উন্নয়নের ভাবনা কতটুকু সমুচিত হচ্ছে; ভাবতে হবে সামষ্টিক উন্নয়ন। চলমান প্রকল্প সমাপ্ত ব্যতিত, সম্প্রসারণ ও নতুন প্রকল্পের দিকে না হাঁটার পরামর্শ দেয় বিজ্ঞজনেরা। সাম্প্রতিক শ্রীলঙ্কা এমন দুরাবস্থায় পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। সিঙ্গাপুরের আদলে কলম্বো সিটি গড়তে গিয়ে আম-ঝুড়ি দুটি হারাতে হলো শ্রীলঙ্কাকে। ১৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে এ সিটি গড়ে তোলা হয়। অতঃপর যারা এই উন্নয়নের অংশিদারিত্বে ছিলো, অবশেষে দেনার দায়ে ওই পরাশক্তির কাছে ৯৯ বছরের জন্য বন্ধক দিতে বাধ্য হয়। তাহলে টেকসই উন্নয়ন হলো কোথায়? দেশটিতে তীব্র খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে। জনরোষে পড়ে মন্ত্রীপরিষদ পর্যন্ত পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। অথচ দেশটির শিক্ষার হার ৯৫ শতাংশ। জনসংখ্যা প্রায় ২ কোটি ১২ লক্ষ। মাথাপিছু জিডিপি চার হাজার ডলারেরও বেশী ছিল। কেন্দ্রীয় রিজার্ভ ছিল ৭.০৫ বিলিয়ন ডলার। তা এখন হ্রাস পেয়ে ১.৫৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে! প্রতি কেজি চাউল ২৫০-৩০০টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্যান্য পণ্যের মধ্যে ঔষধ, জ্বালানীসহ শিশুদের খাদ্য নেই বললে চলে। দেশটির এ সষ্কট লাঘবে ৩০০ কোটি বৈদেশীক মুদ্রা সাহায্য প্রয়োজন বলে দেশটির অর্থমন্ত্রী জানিয়েছে। দেশটির রাজস্ব আয়ের প্রধান উৎস পর্যটন খাত। বৈশ্বিক করোনা-মহামারিতে পর্যটন খাতে ধস নামে। একই সাথে বিদেশে কর্মরত জনশক্তি থেকে রেমিটেন্স আয় হতো, তা আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পায়। কৃষিতে অর্গানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদে আগ্রহ বাড়াতে উৎপাদনও কমে আসে। দেশটির অন্যান্য খাতেও চরম অসঙ্গতি দেখাদেয়। এসবে অর্থনৈতিক ভারসাম্য হারায়। দেশটির এ চরম অবস্থা আমাদের প্রচন্ডভাবে ভাবায়। কোনভাবেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কাটে না। তবে বিশ্ব ব্যাংক বাংলাদেশকে বৈদেশিক ঋণের কম ঝুঁকিতে রয়েছে বলে উল্লেখ করে। বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় জিডিপি হতে পারে ৬.৪ শতাংশ। ওয়াশিংটনভিত্তিক এই আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাটি এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যদিওবা খাদ্য উৎপাদনে স্বয়সম্পূর্ণতার কথা বলা হচ্ছে। বাংলা নববর্ষ ১৪২৯ (১৩ এপ্রিল) উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ নিশ্চয়তা ঘোষণা দেন। পবিত্র ঈদকে সামনে রেখে ১ কোটি ৩৩ হাজার ৫৪টি ভিজিএফ কার্ডের বিপরীতে ১লাখ ৩৩০ মেট্রিক টন চাউল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এছাড়া ২৮টি প্যাকেজের মাধ্যমে ১লাখ ৮৭হাজার ৬৭৯ কোটি টাকা প্রণোদনা বরাদ্দ দিয়েছে। ইতিমধ্যে ১ কোটি হতদরিদ্র পরিবারের মাঝে ১০ টাকা মূল্যে পুষ্টিকর চাউল দেয়ার কথা জানান। এ পুষ্টিকর চাউল প্রতিটি পরিবারকে ৩০ কেজি করে টানা ৬ মাস প্রদান করা হবে। এছাড়া কাবিখা বরাদ্ধ অব্যাহত রেখে উন্নয়ন গতিশীল রাখা হয়। সরকার সর্বোচ্চ খুচরা বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হ্র্রাসকৃত মূল্যে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) অব্যাহত রাখে।
যেখানে ১৯৭১ সালে ১ কোটি ১৮ লাখ খাদ্য-শষ্য উৎপাদন হয়। সেখানে ২০২১সালে উৎপাদিত হয় সোয়া ৪ কোটি মেট্রিক টন। খাদ্য-শষ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ ভিয়েতনামকে পেছনে ফেলে উঠে এসেছে তৃতীয়স্থানে। বাংলাদেশে ১ কোটি ৬২ লাখ কৃষক পরিবার রয়েছে। শিক্ষার ক্ষেত্রেও সাফল্যের স্বাক্ষর রাখে। বছরের শুরুতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে বই উঠিয়ে দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। শিক্ষার্থীরা নতুন বইয়ের ঘ্রাণে মাতোয়রা। নিরবচ্ছিন্নভাবে শতভাগ বিদ্যুতায়নেও চমক দেখিয়েছে। ২৫ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছেড়ে গেছে। ২০২১সালে যা ছিল ২৪ হাজার মেগাওয়াট। রূপপুর পারমানবিক প্রকল্পসহ আরো একাধিক বিদ্যুৎপ্রকল্প চলমান রয়েছে। বর্তমানে বিদ্যুৎ গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি।
তবে মনে রাখতে হবে আমদানিনির্ভর একটি দেশ কখনো টেকসই-স্থিতিশীল অবশ্যম্ভাবী। কোনভাবেই রপ্তানিমুখি গার্মেন্টশিল্প ও কর্মরত বিদেশ থেকে অর্জিত রেমিটেন্সের হেরফের হলে ‘ঝুড়ি’র অবস্থা বেসামাল ঠেকার শঙ্কা রয়েছে। তাই দেশে রপ্তানিমুখি খাত আরো বাড়াতে হবে। চা, চামড়া, পাটজাত পণ্য ও কেমিকেল জাতিয় কাঁচামাল উৎপাদনে আবারও এগিয়ে আসতে হবে। বন্ধ হয়ে যাওয়া পাটকল ও জুট মিল, কেমিকেল ফ্যাক্টরী দ্রুত পুনরায় চালু করতে হবে। পাটকলের সাথে নতুন কর্মসংস্থানের সম্পর্ক রয়েছে। এতে পাটজাত পণ্যের বহুবিধ ব্যবহার বাড়াতে হবে। অন্যদিকে কৃষকদেরও আশার-আলো জেগে উঠবে পুনরায়। চামড়ার ক্ষেত্রে, বিগত কয়েক বছর ধরে ধস দেখা যায়। পানির দরে চামড়া বিক্রয় করতে বাধ্য হয়। ছাগল ও ভেড়ার চামড়া তো বিক্রয় হয়নি। ক্ষোভে কোটি কোটি টাকার চামড়া মাটিতে পুতে ফেলে। অথচ কর্পোরেট কোম্পানীর উৎপাদিত চামড়ার পণ্যে হাত দেয়া যায় না; সেখানে সম্ভাবনাময় কাঁচা চামড়ার মূল্যের ক্ষেত্রে এহেন করুণ হাল হওয়ার কথা নয়! সহজলভ্য কাঁচা মাল লবণ দিয়ে মূল্যবান কেমিক্যাল পদার্থ উৎপাদনে দৃষ্টান্ত আছে। দেশে পর্যাপ্তপরিমাণ লবণও উৎপাদন হয়। বন্ধ থাকা চিটাগাং কেমিকেল কমপ্লেক্সটি পুনরায় চালু করার বিষয়ে সরকারের প্রতিজ্ঞা ছিল। কেন পেছনে সরে এসেছে আল্লাহ্মালুম; এটি চালু করে সরকারের ভাবমুর্তি পুনরুদ্ধারে যেন সচেষ্ট হয়। দেখাযায়, ভোজ্যতেল সয়াবিনের বাজার নিয়ন্ত্রণ রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এর বিপরীতে দেশীয় সরিষাচাষে জোর দিতে হবে। আপাতত ডাল এবং পেঁয়াজের ঝাজ সামলানো গেছে; নয়তো পেঁয়াজের ঝাজেই বেসামাল পরিলক্ষিত হতো মসনদ; এসব বিষয়ে আমজনতা একেবারেই অসহীনয়।
লেখক: কবি, কলামিস্ট ও মুক্তিযোদ্ধবিষয়ক গবেষক