খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া জরুরি

2

‘ভাতে-মাছে বাঙালি’ উপমাটি আদিকাল থেকেই আমাদের পরিচিতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ এ দুটিই আমাদের প্রধান খাবার। ভাতের পাতে এক টুকরো মাছ হলে বাঙালির আর কিছু চাই না। এ কারণে মাছ উৎপাদন ও খাওয়ার ক্ষেত্রে আমরা বরাবরই এগিয়ে রয়েছি। দেশে এখন শীত মৌসুম চলছে। এ সময়ে খাল বিল পুকুর ও নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়ায় মাছের নাগাল পাওয়া যায় বেশি। তবে বর্ষাকালে মাছের প্রজনন হয় বেশি। শীতকালে তা খাবার উপযোগী হয়ে উঠে। তবে এখন আমদানি উন্মুক্ত থাকায় বারো মাসই বাজারে সব ধরনের মাছ পাওয়া যায়। ক্রমবর্ধমান চাহিদা বিবেচনায় শহুরে আড়তদাররা মাছ মজুদ করে রাখেন। অনেকেই মাছ টাটকা দেখানোর জন্য ব্যবহার করেন ফরমালিন এবং হরেক রকম রং। আর এতেই ভোক্তা পর্যায়ে সৃষ্টি হয় আতঙ্ক। কেননা ফরমালিনের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার মানবদেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর। অনেকেই বাজার থেকে মাছ কেনার সময় ভয়ে থাকেন। অনেকে মাছ খাওয়াই কমিয়ে দিয়েছেন। বাজারে মাছ কেনার সময় ফরমালিন দেয়া মাছ চেনার উপায় কী? কত মাত্রায় ফরমালিন দেয়া থাকলে সেই মাছ মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর? কোন কোন মাছে ফরমালিন বেশি দেয়া হয়? এমন নানা প্রশ্ন ভোক্তার মনে উঁকি দেয়। গতকাল শুক্রবার দৈনিক পূর্বদেশে চট্টগ্রাম নগরীর পাইকারি মাছের বাজার ফিশারিঘাটে কিভাবে রং এবং ফরমালিন মিশানো হচ্ছে, এর একটি সরেজমিন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তা পড়লে যেকান গ্রাহক শিউরে উঠবে- আসলে আমরা মাছের নামে কি খাচ্ছি প্রতিদিন? প্রতিবেদনে বলা হয়, ফিশারি ঘাটের মাছ বাজারে কয়েকটি আড়তের সামনে সড়কের উপর স্ত‚প করে রাখা হয়েছে কয়েক মণ ফাইস্যা, বেলে ও পোপা মাছ। শ্রমিকেরা মাছগুলোকে ঝুড়িতে ভরে একটি ড্রামের মধ্যে দুইবার করে চুবিয়ে নিচ্ছেন। বুঝতে বাকি রইলো না, সেটা রঙ-এর ড্রাম। চুবানোর পর মাছগুলোকে আলাদা একটা ড্রামে রাখছেন। আগে মাছগুলো সাদা বর্ণের থাকলেও ড্রামে চুবানোর পর হয়ে যাচ্ছে লালচে ও কমলা রঙ-এর। রফিক আলী নামে এক শ্রমিক জানালেন, এগুলো বেগুনিতে ব্যবহারের রং। তাই এ রঙে স্বাস্থ্যের কোনো ক্ষতি হবে না। মাছকে আকর্ষণীয় করে তুলতে রঙয়ের বালতিতে চুবানো হয়েছে। তবে আরেকজন জানালেন ভিন্ন কথা। তিনি বললেন, এসব মাছ দীর্ঘক্ষণ তাজা থাকার জন্য রঙয়ের বালতিতে চুবানো হয়েছে। আবার কিছু মাছ আসে বার্মা (মিয়ানমার) থেকে। এসব মাছ সেখান থেকেই ফরমালিন দিয়ে আনে। কারণ মাছ পরিমাণে বেশি হওয়ায় বরফ দিয়ে আনা যায় না। প্যাকেটে ঢুকানোর আগে কেমিক্যাল মেশানো হয়। শুধু পাইকারি এ বাজারে নয়, প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, নগরীর প্রায় প্রতিটি খুচরা দোকানেও এভাবে রঙ ও ফরমালিন ব্যবহার করা হয়। রঙ দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে মাছ বিক্রেতা শাহ আলম বলেন, রঙ দিলে মাছ সুন্দর ও তাজা দেখায়। ক্রেতারাও বেশি কেনেন। অল্প পরিমাণে রঙ দেই। আমরা নিজেরাও এ মাছ খাই। এতে স্বাস্থ্যের কোনো ক্ষতি হয় না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিক্রেতা বলেন, বড় বড় রুই মাছ, কার্প জাতীয় মাছের কানের দিকে রঙ লাগিয়ে দিলে কাস্টমাররা আকৃষ্ট হয়। এর সাথে ফরমালিন তো আছেই। সব মিলিয়ে মাছ তরতাজা দেখায়। জানা যায়, সম্প্রতি ফরমালিন বা রঙ শুধু মাছে নয়, মাংস বিশেষ করে গরু বা মহিষের কলিজায়, শাক-সবজিতেও মিশানো হচ্ছে। এ জাতীয় ফরমারিন ও রঙ নিঃসন্দেহে মানব শরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এ জাতীয় খাদ্য মানুষের শরীরের কিডনি, লিভার নষ্ট করে দেয়, ক্যান্সারসহ নানা রকম জঠিল রোগ সৃষ্টি কওে, যা মানুষকে ক্রমান্বয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. ইলিয়াছ চৌধুরী মনে করেন, কৃত্রিম রঙ মেশানো যে কোনো খাবারই শরীরের জন্য ক্ষতিকর। এছাড়া মাছে কোন কেমিক্যালটা ব্যবহার করছে তা না জানাতে বিশেষভাবে বলতে পারছি না রঙ মেশানো মাছ স্বাস্থ্যের কেমন ক্ষতি করবে। প্রতিটি রঙ আলাদা আলাদাভাবে শরীরের ক্ষতি করতে পারে। কিছু কিডনির ক্ষতি করে আর কিছু লিভারের। তা পরীক্ষা করে বলা যাবে। তিনি আরও বলেন, ক্ষতিকর কেমিক্যাল গ্রহণে চামড়ায় নানা ধরনের রোগ দেখা দিতে পারে। কৃত্রিম রঙ, ডালডা ও অতিরিক্ত তেল ব্যবহারে ওজন বৃদ্ধি পাওয়ার ঝুঁকি থাকে। উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। হরমোন তার ভারসাম্যও হারাতে পারে। স্বাস্থ্যঝুঁকি রোধে মানুষের মধ্যে সামাজিক সচেতনতার পাশাপাশি আইনের কঠোর প্রয়োগও প্রয়োজন। কিন্তু খাদ্যে এ জাতীয় ভেজাল মিশানের বিরুদ্ধে দেশে আইন রয়েছে, সে আইন কার্যকর করার দায়িত্ব ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের। বাজার সংশ্লিষ্ট সাধারণ ব্যবসায়ী ভোক্তাদের অভিযোগ স্থানীয় প্রশাসন ও ভোক্তা সংরক্ষণ অধিকার দায়িত্বশীল ভ‚মিকা গ্রহণ করলে অসাধু ব্যবসায়ীরা কোনদিন এ জাতীয মারাত্মক ভেজাল মিশাতে পারেন না। আমরা আশা করি, নামে মাত্র অভিযান না করে দেশ ও জাতির স্বার্থে খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিকার অধিদপ্তর।