ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ দরবেশ মাওলা (রহ.)

40

অধ্যাপক মুহাম্মদ এমরানুল ইসলাম

বাংলার সর্বত্র সুফিবাদী ইসলামের মর্মবানী প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ও সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির জন্য অসংখ্য আল্লাহর নৈকট্য প্রাপ্ত আউলিয়া কেরামদের আগমন ঘটেছে। এরমধ্যে আঠার শতকের সাহিত্যিক, দার্শনিক ও সুফি চট্টগ্রামের আনোয়ারা পরৈকোড়া ইউনিয়নের ওষখাইন গ্রামের সাধক শাহ আলী রজা কানুশাহ (রহ.) এর বংশের উজ্জ্বল প্রদীপ ও ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ খাজা শাহনুর দরবেশ মাওলা (রহ.) তাদের মধ্যে অন্যতম। যিনি রূহানী শক্তি, মোহনীয় ও আদর্শিক কর্মকাÐের মাধ্যমে এদেশে ইসলামের সঠিক রূপরেখা প্রচার ও প্রসার ঘটিয়েছেন। তাই পাঠকদের জ্ঞাতার্থে এই মহান মনীষীর স্মরণীয় ও বরণীয় বর্ণাঢ্য জীবন-কর্ম সংক্ষেপে উপস্থাপন করা হলো।
হযরত শাহসুফি মাওলানা নূরুল রশিদ আখতার রজা (রহ.) চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার ওষখাইন আলীনগর গ্রামে খলিফাতুর রাসুল (দ.) হজরত আবু বকর ছিদ্দিক (রা.) এর বংশধর হজরত আল্লামা শেখ জালাল উদ্দিন রুমি (রহ.) এর বংশধর গাউসুল অলি শাহসুফি আলী রজা কানু শাহ (রহ.) এর পঞ্চম বংশধর। তাঁর পিতা শাহ সুফি মাওলানা মোহাম্মদ আমিনুর রহমান (রহ.) একজন কামিল বুজুর্গ, আলিম ও আধ্যাত্মিকতায় পরিপূর্ণ সুফি সাধক ছিলেন। তাঁর মা জাহেদা খাতুন একজন মহিয়সী রমনী, যিনি তাঁর সন্তানকে যোগ্য করে গড়ে তোলার জন্য কঠোর সাধনা করেছেন। দরবেশ মাওলা (রহ.) মায়ের গর্ভে আসার পূর্বে তাঁর দাদা হজরত শাহসুফি মাওলানা হাবিবুর রহমান (রহ.) তাঁর জন্য নিজের জুব্বা, খিলকা, পবিত্র কোরআন শরীফ ও অজিফাসহ তাঁর দাদী হজরত ছেমন আরা (রহ.) নিকট আমানাত রেখে যান। এছাড়াও তিনি তাঁর খলিফা মকবুল সুফি (রহ.) এর নিকট দরবেশ মাওলা (রহ.) এর নামে লিখিত খিলাফতনামা ও ছয় তরিকতের অজিফা হাদিয়া হিসেবে রেখে যান, যা ১৯৮৬ সালে তাঁর হস্তগত হয়। অন্যদিকে তিনি গাউসুল অলি আলী রজা কানু শাহ (রহ) এর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মগ্রহন করেছেন বিধায় তাঁকে ‘মাজহারে আলী রজা’ নামে অভিহিত করা হয়।
দরবেশ মাওলা (রহ.) পাঁচ বছর বয়সে পিতা হজরত শাহসুফি আমিনুর রহমান (রহ.) এর কাছ থেকে প্রাথমিক ও মক্তব শিক্ষা লাভ করেন। ক্রমান্বয়ে স্থানীয় মকবুলিয়া ও জোয়ারা মাদ্রাসায় অধ্যয়ন করেন। বাল্যকাল হতে তিনি অত্যন্ত মেধাবী ও বিনয়ী ছিলেন। তাই খুব অল্প সময়ে তিনি ইলমে নাহু, ইলমে ছরফ ও বালাগাত, কোরআন ও হাদীস সহ বিভিন্ন শাস্ত্রের জ্ঞান অর্জন করেন। একথা বলা হয় যে, তিনি আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান তথা ইলমে লাদুনির অধিকারী ছিলেন, যাহা পরবর্তী সময়ে কোরআন ও হাদিসের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে তাঁর নিগূঢ় তথ্য উপস্থাপন, গবেষণা কর্ম, কিতাব ও অজিফা রচনা এবং মলফুযাতের শরিয়ত ও তরিকতের বিভিন্ন বক্তব্যে সুস্পষ্ট। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তিনি দাখিল, আলিম, কামিল ফাজিল ও ১৯৬২ কামিল (মাস্টার্স) অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে সম্পন্ন করেন। ইলমে শরীয়তের প্রাতিষ্ঠানিক সনদ অর্জন করার পর দরবেশ মাওলা (রহ.) তাঁর পূর্ব পুরুষের পদাংক অনুসরণ করেন বিশেষত আল্লাহর নৈকট্য এবং ফানা-ফি-আল্লাহ ও বাকাবিল্লাহ স্তরের মর্যাদায় আসিন হওয়ার লক্ষে দীর্ঘ ২৬ বছর বনবাসী হয়ে আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন হন। এ কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য যে, তিনি ছাত্র জীবন তথা ১৫ বছর বয়স হতে তাঁর দাদা হুজুর (রহ.) এর রওজা শরীফে ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। ছাত্র জীবনের ধ্যান সাধনাকে আরো গভীরতর করার লক্ষে ১৯৬২ হতে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ আট বছর চন্দনাইশ থানার অন্তর্গত পোলার বাপের টেক পাহাড়ের চূড়ার গুহায় রিয়াজতে মগ্ন ছিলেন। সেখান থেকে ফিরে ১৯৭১ হতে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত চন্দনাইশ হযরত আলি শাহ (রহ.) এর দরগায় রিয়াজত ও ধ্যান সাধনা করেন। পরবর্তীতে তিনি ১৯৭৩ সাল হতে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত প্রায় তিন বছর পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহের বিভিন্ন পাহাড়-পর্বতে রিয়াজত ও ধ্যান সাধনায় লিপ্ত ছিলেন। তাঁর বাবা হুজুর (রহ.) তাঁর লিখিত কিতাবে উল্লেখ করেন, দরবেশ মাওলা (রহ.) দীর্ঘ ধ্যান সাধনা হতে ২ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে রোজ রবিবার ভোর ৪টায় নিজ পিতৃগৃহে ফিরে আসেন।
পিতৃগৃহে কিছুদিন অতিবাহিত হবার পর দরবেশ মাওলা (রহ.) পুনরায় গৃহবাস ত্যাগ করে প্রায়ই বাংলার বিভিন্ন পর্বত চূড়ায় একাকিত্ব ধ্যান ও ইবাদতে মশগুল থাকতেন। এ সময় তিনি মানুষের কল্যাণার্থে ও সুফিবাদের সঠিক দর্শন ও মতবাদ সাধারণ মানুষের মাঝে প্রচার করার লক্ষে এ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দ্বীনি খিদমত ও ছয় তরিকার (বিষু) তাসাউফ চর্চায় মনোনিবেশ করেন। বিভিন্ন ডকুমেন্টস পর্যালোচনা ও তথ্য নির্ভর বর্ণনায় এ কথা স্পষ্ট যে, দরবেশ মাওলা (রহ.) তাঁর নিজের কর্মদক্ষতা, রিয়াজত, ধ্যান ও তাসাউফ চর্চার মাধ্যমে নিজেকে একজন উচ্চ স্থরের সুফি সাধক ও আল্লাহর অলি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর আধ্যাত্মিক শক্তি ও কার্যকলাপের মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন আউলিয়া কেরামদের রওজার সঠিক স্থান নির্ধারণ এবং অনেক মাজার ও মুরিদদের জিয়ারতের স্থান পুনঃসংস্কার করেন। তিনি যেখানে অবস্থান করেছেন সেসব অঞ্চলগুলোতে মসজিদ, খানকাহ, মক্তব ও মাদ্রাসা কম্প্লেক্স প্রতিষ্ঠা করেন। ঐসব অঞ্চলের সাধারণ মানুষ তাঁর সান্নিধ্য লাভের মাধ্যমে তাদের সমাজ, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় জীবনকে সুফিবাদী ভাবধারায় আনয়ন করেন। তাঁর প্রভাবে মানুষ অন্যায়, অবিচার, কু-কর্ম ও কু-প্রবৃত্তি হতে নিজেদের জীবনকে রক্ষা করেন।
তাঁর উত্তরসূরিগণ আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান গরিমায় উজ্জ্বল হলেও তাঁর বড় শাহজাদা মাওলানা মীর মোহাম্মদ মঈন উদ্দিন নূরী সিদ্দিকী আল কুরাইশি (ম.জি.আ) একজন মায়ের গর্ভের আল্লাহর অলি। তিনি শরীয়ত, তরিকত ও মারেফতের একজন সাচ্চা আলিম ও সুফি সাধক যাহা তাঁর জ্ঞান-গরিমা, নৈতিকসম্পন্ন গুণাবলী, জীবনাচরন, বক্তব্য, গবেষণা ও তাসাউফ চর্চার মাধ্যমে সমাজে সমাদৃত হয়েছেন।
দরবেশ মাওলা (রহ.) তাঁর একজন যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে বড় শাহজাদাকে ২০০৫ সালে ছয় তরিকার লিখিত খিলাফতনামা প্রদান করেন। তাঁর যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে বড় শাহজাদা তাঁর উপর অর্পিত তরিকতের দায়িত্ব সততা ও নিষ্ঠার সাথে আঞ্জাম দিচ্ছেন।
পারিবারিক জীবন শুরুর পর হতে দরবেশ মাওলা (রহ.) চট্টগ্রাম শহরের পূর্ব নাসিরাবাদ এলাকার পশ্চিম ষোলশহরের রুবি গেইট বালিকা মোড়ের উচ্চ পাহাড়ের উপর তাঁর উপর অর্পিত পীর-মাশায়েখদের তরিকতের দায়িত্ব ও কর্ম পদ্ধতি পরিচালনার উদ্দেশ্যে ‘নূরীয়া বিষু মঞ্জিল’ ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর ভক্ত-মুরিদগনের উপস্থিতিতে ছয় তরিকার কর্মপদ্ধতি (বিষু) পালন করতেন। বর্তমানও তাঁর খিলাফত প্রাপ্ত শাহজাদা নিয়মতান্ত্রিকভাবে তাঁর দেওয়া তরিকতের দায়িত্ব ও কর্মপদ্ধতি পালন অব্যাহত রেখেছেন। ত্বরিকতের এ অনুষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে মুরিদ ও ভক্তগনদেরকে ছয় তরিকার কর্মপদ্ধতি (বিষু) ও ইহার দর্শন, তাসাউফ, ইলমে শরীয়ত, তরিকত ও মারেফতের জ্ঞান শিক্ষা দেওয়া হয়। এই সুফি সাধকের বর্ণাঢ্য কর্মকাÐে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে হাজারো কারামত সংগঠিত হয়। একথা সর্বজন সমাদৃত যে, ভক্ত ও মুরিদগন একই সময়ে বিভিন্ন জায়গায় এ সুফি সাধককে স্বশরীরে সাক্ষাত পেয়েছেন। বিশেষত বাংলাদেশ ছাড়াও দেশের বাহিরে তাঁকে অগনিতবার মক্কা শরীফ, মদিনা শরীফ, বোগদাদ শরীফ, কারবালা, আজমীর শরীফ, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিন আফ্রিকা সহ বিভিন্ন দেশে ভক্ত-মুরিদগন বিপদ-আপদে স্বশরীরে দেখতে পেয়েছেন। এমনকি তাঁর ইন্তেকালের পরও ভক্ত-মুরিদগণ তাঁকে বিভিন্ন জায়গায় সাক্ষাৎ পেয়েছেন এবং পাচ্ছেন বলে একাধিক ঘটনার উল্লেখ রয়েছে।
দরবেশ মাওলা (রহ.) একজন কবি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি বাংলা, উর্দু, ফার্সী ও আরবি ভাষায় হামদ ও নাত সহ সুফি কেরামগণের শানে মূল্যবান সংগীত রচনা করেন। তাঁর কাব্যিক ও সাহিত্যিক চিন্তাধারা তাঁর রওজা শরীফ জিয়ারত করতে গেলে সাধারন মানুষের খুব সহজে দৃষ্টিগোচর হয়। দরবেশ মাওলা (রহ.) এর শত ব্যস্ততা ও রিয়াজতের মশগুল থাকা সত্তে¡ও সাতচল্লিশটি ছোট-বড় কিতাব ও অজিফা রচনা করেন। তন্মধ্যে তাঁর লিখিত মিনহাজুল মুরিদাইন, নাজমুস ছাক্কিব (কিতাবুত-তাওয়ারিন), হাদিসের আলোকে মুনাফিকের স্বরূপ উন্মোচন, ওয়াও-য়ে রাদিফ, মলফুজাত-ই-কুতুবুল আলম (তাসাউফের বক্তব্য সংকলন) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিশেষত ‘মিনহাজুল মুরিদাইন’ নামক কিতাবটি আকারে তেমন বড় না হলেও ইহা বাংলা ভাষায় তাসাউফের একটি আকর গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত। এভাবে তিনি তাঁর গবেষণা কর্মের মাধ্যমে সঠিক দ্বীনি ইসলাম ও তাসাউফ চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তাঁর অমর কীর্তি ও আধ্যাত্মিক কর্মকাÐের বিবরণ অতি অল্প লিখনিতে মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। জীবনের শেষ সময়ে দরবেশ মাওলা (রহ.) ৯ অক্টোবর ২০১১ ইং তারিখে (ইন্তেকালের ৪ দিন পূর্বে) নিজ দাফনের স্থান নির্দিষ্ট করে ইন্তেকালের দিনক্ষন ও তারিখ তাঁর প্রিয় সহধর্মিণী ও বড় শাহাজাদাকে অবহিত করেন। অবশেষে তাঁর নির্দিষ্ট করে দেওয়া তারিখে ২৮ আশ্বিন ১৪২৭ বঙ্গাব্দ ১২ অক্টেবর ২০১১ইং ১৪ জ্বিলহজ ১৪৩২ হিজরী রোজ বুধবার দিবাগত রাত ৩.০০ টায় সিজদারত অবস্থায় ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। পরেরদিন ১৩ অক্টোবর বৃহস্পতিবার বাদ আসর দরবেশ মাওলা (রহ.) এর জানাজা অনুষ্ঠিত হয় এবং বাদ মাগরিব নূরীয়া বিষু মঞ্জিলে তাঁর দাফন সম্পন্ন হয়।
তিনি একজন আপাদমস্তক নবি মোস্তফা (দ.) এর সুন্নাতের গোলাম ও আশেক ছিলেন। কেননা, তিনি সুন্নাতের পরিপন্থি কোন কর্মে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতেন না। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এ সুফি সাধক ২০০৪ সালে মারকাযে এশায়াতে আহলে সুন্নাত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেন এবং সুন্নি মতাদর্শ ভিত্তিক শরিয়ত ও তরিকতের কার্যক্রম সাংগঠনিক কাঠামোতে শুরু করেন। তাছাড়া তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের মহান ব্যক্তিত্ব ইমাম আহমদ রেজা খাঁন বেরলভী (রহ.) এর একজন খাঁটি ভক্ত ছিলেন এবং মসলকে আলা হজরতকে অনুসরণ করতেন।
এই মহান সাধকের বর্ণাঢ্য জীবন ও কর্মকে জনসাধারণের মাঝে পৌঁছিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে প্রতিবছর ১৩ অক্টোবর চট্টগ্রামের অন্তর্গত পশ্চিম ষোলশহরের রুবি গেইটে অবস্থিত তাঁর মাজার প্রাঙ্গণে পবিত্র ওরশ মোবারক অনুষ্ঠিত হয়। মহান রাব্বুল আলামীনের কাছে ফরিয়াদ এই যে, দরবেশ মাওলা (রহ.) এর জীবন ও কর্ম চর্চার মাধ্যমে দ্বীন ইসলাম, মাযহাব মিল্লাতের সঠিক কর্মপন্থা ও তাসাউফ চর্চায় নিজেদের জীবন পরিচালিত করার তাওফিক দান করুন। ‘আমিন’।
লেখক : শিক্ষক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক