কোটি টাকার গাড়ি লাখ টাকায়

67

ফারুক আবদুল্লাহ

বিশ্বের বিখ্যাত ব্র্যান্ডের পুরোনো ১১০টি দামি গাড়ি পঞ্চমবারের মতো নিলামে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এসব গাড়ি বিদেশে থেকে ‘কারনেট ডি প্যাসেজ’ সুবিধায় দেশে আসার পর খালাস না হওয়ায় এক দশক ধরে পড়ে আছে চট্টগ্রাম বন্দরে। এর আগে আরও চারবার নিলামে তুলে এসব গাড়ির একটিও বিক্রি হয়নি।
রিকন্ডিশন গাড়ি আমদানিকারকরা জানান, কারনেট সুবিধায় বিদেশ থেকে আনা গাড়িগুলো বার বার নিলামে তোলার পরেও যে কারণে বিক্রি হয় না তা হলো- গাড়িগুলোর অবস্থা ভালো না, সেজন্য কেউ নিতে চায় না। আর এসব গাড়ি রিপেয়ার করা অনেক কঠিন এবং প্রক্রিয়াও অনেক জটিল। তাছাড়া গাড়িগুলোর আয়ুষ্কাল ফুরিয়ে যাচ্ছে। রাস্তায় চালাতে হলে অনেক কিছু প্রতিস্থাপন করতে হবে। তাই দ্রæত নিলাম সম্পন্ন করতে হলে আমদানিনীতি ও শুল্কনীতিতে সংশোধন আনতে হবে। আর এনবিআরের বিশেষ নির্দেশনায় বিশেষ নিলামের আয়োজন করে গাড়িগুলো বিক্রি করতে হবে। একইভাবে এনবিআরও বলছে, গাড়িগুলো পুরনো হওয়ায় ক্রেতারা আগ্রহী হননি। গাড়িগুলোর বেশির ভাগেরই বয়স ১১ থেকে ২৩ বছর।
এর আগে একাধিকবার নিলামে তোলার পরও বিক্রি করতে না পেরে গাড়িগুলোর প্রকৃত অবস্থা জানতে এনবিআরের নির্দেশে কাস্টমস, বিআরটিএ, কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর, কাস্টমস মূল্যায়ন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি সরেজমিন পরিদর্শন করে বন্দরে পড়ে থাকা ১২১টি গাড়ির মধ্যে ১২০টি গাড়ির বর্তমান চিত্র তুলে ধরে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১২০টি গাড়ির মধ্যে পুরোপুরি ভালো অবস্থায় আছে এমন গাড়ির সংখ্যা কম। চাবি নেই ৫৮টি গাড়ির। একটির চাবি ভাঙা। ১১৪টি গাড়ির চাকা ও ব্যাটারি নষ্ট হয়ে গেছে। ৭৯টি গাড়ির ইঞ্জিনে জং ধরেছে। পেছনের কাচ ভাঙা দুটি গাড়ির।
এদিকে গতকাল শনিবার রাজস্ব বোর্ডের জনসংযোগ দপ্তর জানিয়েছে, আগামী ৩ ও ৪ নভেম্বর এই গাড়িগুলো নিলামে বিক্রি করা হবে। এনবিআর ও চট্টগ্রাম বন্দরের ওয়েবসাইটে নিলাম সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে। এর আগে গত মঙ্গলবার চট্টগ্রাম কাস্টমসের যুগ্ম-কমিশনার মো. তোফায়েল আহমেদ স্বাক্ষরিত একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়।
এনবিআর জানায়, আগ্রহী কেউ গাড়ি দেখতে চাইলে জাতীয় পরিচয়পত্র বা পাসপোর্টের ছবিসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আবেদন করে আগে থেকে পাস নিতে হবে। গাড়ি পরিদর্শনের তিনদিন আগে আবেদন করতে হবে। গাড়ি পরিদর্শনের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে ২৭, ২৮ অক্টোবর এবং ৩১ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত। এছাড়া নিলাম থেকে কেউ গাড়ি কিনতে চাইলে তাকে টেন্ডার জমা দিতে হবে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও মোংলায় কাস্টম অফিসে রাখা টেন্ডার বাক্সে টেন্ডার আবেদন খামে জমা দিতে হবে। আগামী ৩ নভেম্বর সকাল নয়টা থেকে ৪ নভেম্বর বেলা একটা পর্যন্ত চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস থেকে দুদিনব্যাপী এই নিলাম পরিচালনা করা হবে।
এ নিয়ে পঞ্চমবারের মতো এসব গাড়ি নিলামে তোলা হচ্ছে। এর আগে চারবার নিলামের আয়োজন করে একটি গাড়িও বিক্রি করা সম্ভব হয়নি। তবে এবার গাড়িগুলো নিলামে বিক্রি করতে চায় কাস্টমস। এজন্য বেশিকিছু উদ্যোগও নিয়েছে। এছাড়া নিলামে বেশি সংখ্যক দরদাতা যাতে অংশ নেয় সেই জন্য প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন কাস্টমস কর্মকর্তারা।
এবারের নিলামে তোলা বিশ্বের বিখ্যাত পুরোনো ১১০ দামি গাড়ির মধ্যে রয়েছে, ২৬টি মিতশুবিসি, ২৫টি মার্সিডিজ বেঞ্জ, ২৫টি বিএমডব্লিউ, ৭টি ল্যান্ড রোভার, ৭টি ল্যান্ড ক্রুজার, ৬টি লেক্সাস, ৫টি ফোর্ড, ৩টি জাগুয়ার, ১টি দাইয়ু, ১টি হোন্ডা ও ১টি সিআরভিসহ অন্যান্য গাড়ি। গাড়িগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দামি হলো যুক্তরাজ্যের ল্যান্ড রোভার গাড়ি। এ রকম সাতটি গাড়ি আছে। আর ১১০টি গাড়ির অর্ধেকই মার্সিডিজ বেঞ্জ ও বিএমডবিøউ ব্র্যান্ডের।
কাস্টমস সূত্র মতে, নিলামের আগে প্রতিটি গাড়ির সংরক্ষিত মূল্য নির্ধারণ করা হবে। আইন অনুযায়ী সংরক্ষিত মূল্যের ৬০ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি দর পেলে এগুলো বিক্রি করা হবে। যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নিলামে অংশ নিতে পারবেন। এ জন্য যে মূল্যে গাড়ি কেনার দর উল্লেখ করা হবে, তার ১০ শতাংশ দাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে পরিশোধ করতে হবে।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের উপ-কমিশনার মো. আল আমিন বলেন, কারনেট সুবিধায় আনা ১১০টি দামি গাড়ি নিলামে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এবারের নিলামে বেশি সংখ্যক দরদাতা যাতে অংশ নেন সেই জন্য বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আগে বিডাররা ২ দিন পরিদর্শন করতে পারতেন, এবারে ৫ দিন করেছি। ৫টি জায়গায় টেন্ডার বক্স বসানো হচ্ছে। পারসোনাল যোগাযোগ নাম্বার দিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যাতে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারে। নিলামে তোলার আগে ক্রেতারা এসব গাড়ি দেখতে সময় নির্ধারণ করা হয়েছে আগামী ২৭ থেকে ২৮ অক্টোবর এবং ৩১ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর। আবার অনলাইনে নিলামে অংশ নেওয়ার জন্য প্রশিক্ষণে অংশ নিতে পারবেন ক্রেতারা। আগামী ১৮ অক্টোবর সশরীরের বা অনলাইন প্ল্যাটফর্মে এই প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হবে।
গাড়ি ব্যবসায়ীদের সংগঠন বারভিডার সাবেক মহাসচিব মো. হাবিবুর রহমান বলেন, কারনেট সুবিধায় আনা গাড়িগুলোর অবস্থা ভালো না। সেজন্য কেউ এসব গাড়ি নিতে চায় না। তাই বার বার নিলামের আয়োজন করে এসব গাড়ি বিক্রি করা যাচ্ছে না। তাছাড়া এসব গাড়ি রিপেয়ার করা অনেক কঠিন এবং প্রক্রিয়াও অনেক জটিল।
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা গেছে, এক দশক আগে পর্যটক সুবিধায় এসব গাড়ি এনেছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ পর্যটকরা। শুল্কমুক্ত সুবিধার অপব্যবহারের ফলে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আনার পর গাড়িগুলো আটকে যায়। ব্যাংক গ্যারান্টি দিয়ে খালাসের শর্তারোপ করার পরই গাড়ির মালিকরা খালাস নেননি। এরপর একদশক ধরে চট্টগ্রাম বন্দরে গাড়িগুলো শেডে পড়ে আছে।