কিশোর গ্যাং-এর অপরাধ বিপজ্জনক পর্যায়ে

91

মনিরুল ইসলাম মুন্না

নগরীতে দিন দিন বাড়ছে কিশোর অপরাধ। অথচ কিশোরদের ওপর ভর করে একটি সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের চিন্তা করা হচ্ছে। যারা বড় হয়ে একসময় দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেবে, সেই কিশোররাই আজ চুরি, হত্যা, ছিনতাই, উম্মুক্ত সংঘাত ও অপহরণের মতো নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এতে অভিভাবকদের কপালে চিন্তার ভাজ পড়ছে।
নগর পুলিশ কমিশনার (সিএমপি) সালেহ মোহাম্মদ তানভীর বলেন, কিশোর অপরাধগুলো গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। পাশাপাশি নগরবাসীকেও তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করার অনুরোধ করছি। বিশেষজ্ঞদের মতে, পারিবারিক ও সামাজিক অনুশাসনের অভাবের পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষার অভাব, মাদকের কালো ছায়া, সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার অভাব, অর্থনৈতিক সংকট, ভার্চ্যুয়াল জগতের নেশায় আত্মকেন্দ্রিক হয়ে ওঠার কারণেই অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়াও কিশোর অপরাধ বাড়ার পেছনে বড় ভাই নামক গ্যাং লিডাররা অনেকটা দায়ী। এসব বড় ভাইয়েরা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে কিশোরদের ব্যবহার করছে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে। উঠতি বয়সের এসব তরুণ হঠাৎ ক্ষমতার সংস্পর্শে এসে অনেকটা বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
গত শুক্রবার চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে মেলায় গুরতে এসে কিশোর গ্যাংয়ের ছুরিকাঘাতে নিহত হয় ফাহিম নামে এক কিশোর। তাকে ছুরিকাঘাতকারী ১৪ বছর বয়সী কিশোর সজলকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গতকাল মঙ্গলবার কিশোরগঞ্জ জেলা থেকে গ্রেপ্তারের পর সজলকে চট্টগ্রামে নিয়ে আসা হয়েছে।
গত সোমবার কিশোরগঞ্জের নিকলি উপজেলা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানান পাহাড়তলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাফিজুর রহমান। সূত্র জানায়, গত শুক্রবার ইফতারের পর ঈদগাহ কাঁচা রাস্তার মোড়ে দোলন কমিউনিটি সেন্টারের সামনে মেলায় তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই দল কিশোরের মধ্যে কথা কাটাকাটি শুরু হয়। ওই সময় ডিউটিরত টহল পুলিশ সদস্যরা বিষয়টি দেখে সেখান থেকে সবাইকে সরিয়ে দেয়। পরে রাত ১১টার দিকে কিশোর গ্যাংয়ের একটি দল স্থানীয় একটি টং দোকানের সামনে জড়ো হয়ে অপরপক্ষের সঙ্গে আবারও বিবাদে জড়ায়। কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে ফাহিমকে ছুরিকাঘাত করা হয়। এরপর আহত ফাহিমকে তার বন্ধুরা প্রথমে চিকিৎসার জন্য স্থানীয় একটি ফার্মেসিতে নিয়ে যায়। সেখানে চিকিৎসা দিতে না পারায় পরবর্তীতে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এছাড়াও গত রবিবার রাতে দুই কিশোর গ্যাংয়ের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এর একপক্ষের নেতৃত্বে ছিল কিশোর গ্যাং লিডার রবিউল ইসলাম রাজু। অপর পক্ষে নেতৃত্ব দেয় কিশোর গ্যাং লিডার নাইমুল হাসান তুষার। পরে নাইমুল হাসান তুষারকে আটক করেছে চকবাজার থানা পুলিশ। চকবাজার থানা এলাকার গুয়াছি বাগান এলাকায় সংঘর্ষ ও গাড়ি ভাংচুরের ঘটনার পরপরই তাকে আটক করা হয়। পরবর্তীতে গত সোমবার তাকে আদালতে পাঠানো হয়।
জানা গেছে, কিশোর গ্যাং লিডার তুষারের বিরুদ্ধে অপহরণ, সংঘর্ষ ও ছিনতাইয়ের একাধিক মামলা রয়েছে। এর আগে গত মাসেও সংঘর্ষের ঘটনায় তাকে আটক করা হয়। এরপর সে জামিনে বেরিয়ে আসে। জামিনে বেরিয়ে এসেই ফের অপরাধে জড়িয়ে পড়ে সে। পুলিশের কিশোর গ্যাং তালিকার দুই নম্বরে তার নাম রয়েছে।
কয়েকজন অভিভাবকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, যেভাবে কিশোর অপরাধ বাড়ছে তা মূলত সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে। বিশেষ করে সন্তানরা যখন বাড়ির বাহিরে যায়, মনের ভেতরে তখন একটা অজানা আতঙ্ক কাজ করে। কারণ কিশোররা যেকোনো প্রলোভনে কিছু না বুঝেই আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। এক শ্রেণির মানুষ এসব কোমলমতি কিশোরদের খারাপ কাজে ব্যবহার করছে। এতে করে কিশোররা অনেকটা নিজের অজান্তেই অন্ধকার জগতে চলে যায়। কিশোর অপরাধ প্রতিহত করতে হলে- প্রথমে কিশোর অপরাধ কেন হচ্ছে? কারা এর জন্য দায়ী তা খুঁজে বের করতে হবে। প্রকৃত দায়ীদের কঠোরভাবে আইনের আওতায় আনা গেলে কিশোর অপরাধ কমে আসবে।
সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাসুম চৌধুরী বলেন, কিশোর গ্যাং আবারও সক্রিয় হয়ে উঠছে। এইদিকে প্রশাসনের তীক্ষè নজর রাখা উচিত। এক শ্রেণির রাজনীতিবিদ ও মাদক ব্যবসায়ী কিশোরদের ব্যবহার করছে। উঠতি বয়সের কিশোরদের দিয়ে কৌশলে মাদক বিক্রি করছে তারা। বিভিন্ন পাড়া মহল্লার বড় ভাইদের ছত্রছায়ায় থেকেও নানা অপরাধ কর্মকাÐে জড়িয়ে পড়ছে কিশোররা। তাদের সকলের তালিকা তৈরি করে নজরদারিতে রাখা উচিত।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ সূত্র জানায়, নগরীর শাহ আমানত সেতু চত্ত¡র, সিটি গেট, একে খান, নিউ মার্কেট, রেল স্টেশন, কোতোয়ালি, আন্দরকিল্লা, চকবাজার, জামালখান, চন্দনপুরা, বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, ষোলশহর ২নং গেট, জিইসি, দেওয়ানহাট, আগ্রাবাদসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় দিন দুপুরে ছিনতাইয়ের মত ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনার অধিকাংশের পেছনে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা জড়িত রয়েছে বলে জানা গেছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, সমাজ ও অপরাধ বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী পূর্বদেশকে বলেন, কিশোর অপরাধের তিনটি দিক রয়েছে সামাজিক, মনস্তাত্তি¡ক ও আইনগত। এ ঘটনাগুলো বাড়ার পেছনে যে দৃষ্টিভঙ্গিগুলো লক্ষ্য করা যায় তা হল কিশোর অপরাধের যথাযথ বিচার হচ্ছে না। আইনের যে বিধান রয়েছে তা সঠিক প্রয়োগ করা হচ্ছে না। যারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বে রয়েছে তারা দায়িত্ব পালন করছে না। সমাজে বিভিন্ন শ্রেণির কিছু মানুষ আছে যারা নিজেদের স্বার্থ হাসিলে এইসব কিশোরদের মাদক সেবনসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে অনুপ্রাণিত করছে। এসব সমস্যা সমাধানে সরকারের পাশাপাশি সমাজের সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে খেলাধুলার চর্চা বাড়িয়ে তোলা, সংস্কৃতির বিকাশের পাশাপাশি জনকল্যাণমূলক কাজে কিশোর-কিশোরীদের আকৃষ্ট করা যায় তাহলে তারা বিপদগামীতার হাত থেকে রক্ষা পাবে বলে মনে করি।
তিনি আরও বলেন, কিশোর গ্যাং থেকে ছিনতাই সহ খুনের মত বড় ঘটনা ঘটছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নাম ভাঙিয়ে গড়ে উঠছে শক্তিশালী এসব কিশোর গ্যাং। যেটি তৃণমূল থেকে সর্বোচ্চ মহলে ছড়িয়ে পড়ছে। তারা বিভিন্ন পর্যায়ে ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও খুনের ঘটনায় লিপ্ত হয়ে পড়ছে। এমনকি কিশোর গ্যাং এর সদস্যরা নিজেদের জাহির করার জন্য এবং পদ-পদবী পাওয়ার জন্য খুনের মত জঘন্য কাজ করতেও পিছু হটছে না। আবার দেশে অযোগ্য প্রার্থীকে বড় পদ দেয়ার ফলে যোগ্য প্রার্থীর মধ্যে এক ধরণের ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে। যেটাতে প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার মধ্যে একটা গ্যাপ তৈরি হয়। সুতরাং এসব নির্মূল করতে হলে সবাইকে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসন, রাজনীতিবিদদেরও আচরণগত পরিবর্তন আনতে হবে।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর পূর্বদেশকে বলেন, কিশোররা যদি অপরাধে জড়িয়ে যায় সমাজের বড় একটা অংশ অপরাধ প্রবণ হয়ে ওঠে। আমরা কিশোর অপরাধগুলো গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে প্রত্যেক এলাকার অপরাধী ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে সঙ্গে সঙ্গে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, আইনের পাশাপাশি পারিবারিক অনুশাসন বাড়িয়ে সবাই সম্মিলিত চেষ্টা চালালে কিশোর অপরাধ প্রতিরোধ করা সম্ভব। এছাড়াও পাশাপাশি নগরবাসীরাও তথ্য দিয়ে পুলিশকে সহযোগিতা করলে কিশোর গ্যাংসহ বড় অপরাধ নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেডিকেল অফিসার ডা. শহিদুল আলম বলেন, বর্তমান সময়ে টিন এইজের ছেলে মেয়েরা একটু এদিক-ওদিক হলেই আবেগী হয়ে পড়ে। ফলে অল্প কিছু পাওয়ার আশায় জীবনের বড় একটি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়, যা উচিত নয়। এ সময় ছেলে-মেয়েদের হরমোন ইন ব্যালেন্সড থাকায় যে কেউ তাদের ব্যবহার করতে পারে। কিশোররা ‘হয় করবো, না হয় মরবো’ বলে এমন এমন জেদ ধরে যার পরবর্তীতে বিপদে পড়ে তারা।