কালের ধূলায় ঢাকা নন্দিত জনহিতৈষী আবু সাঈদ চৌধুরী

62

এম.এ. মাসুদ

আজ আমরা এমন একটা সময়কালে বসবাস করছি যখন দেশ ও সমাজের জন্য কোন দায়িত্ব পালন না করা মানুষও শুধুমাত্র অর্থ-বিত্তের অধিকারী হয়ে আর রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন কিনে ভোটে দাঁড়িয়ে বিখ্যাত হতে চায়। বর্তমানে আমাদের সমাজে এমন অনেক মানুষ আছেন যারা জনদরদী সমাজ সেবকের ভনিতা করে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জন করতে প্রয়াসী হন। বর্তমানে আমাদের সমাজের এসব তথাকথিত নেতারা তাদের প্রত্যেক কাজকে রাজনীতিকরণ করে ফেলেন। এমনকি তারা যখন দরিদ্র মানুষের মাঝে দান খয়রাত করেন তাও রাজনৈতিক পরিচয়েই করেন। নুতন যারা এ পথে আসতে চান তারা রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন ক্রয় করে ভোটে দাঁড়ানোর প্রতিযোগিতার লিপ্ত হওয়া ছাড়াও মাঝে মধ্যে বড় বড় মেজবানীর আয়োজন করে নিজেদের আর্থিক সক্ষমতার জানান দিয়ে থাকেন। কিন্তু আমাদের দুই প্রজন্মের আগের রাষ্ট্র বা সমাজের নেতাদের প্রতি যদি আমরা তাকাই তাহলে দেখব তাদের সাথে বর্তমানকালের আমাদের সমাজের সর্দার-সমাজপতি বা রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যেকার আকাশ-পাতাল পার্থক্য। তখনকার দিনে মানুষ দান করত পুণ্যের জন্য, এখন করে দানবীর আখ্যা পাওয়ার জন্য। তখন মানুষের অন্তরের মধ্যেই নেতার জন্ম হত। এখনকার মত রাজনৈতিক দলের সদস্য হয়ে নয়। পশ্চিম পটিয়ায় (বর্তমান-কর্ণফুলী উপজেলা) আবু সাঈদ চৌধুরী সেই সময়েরই এমন একজন নেতা যে নেতার জন্ম হয়েছিল মানুষের অন্তরে মানুষেরই জন্য কল্যাণমূলক কাজ করার মাধ্যমে। আবু সাঈদ চৌধুরী দেশের জন্য এবং সমাজের জন্য কাজ করেছেন নিজের মনের তাগিদ থেকে, দেশ ও সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে এবং মানবতার প্রতি মমত্ববোধ থেকে। নিজ কর্মগুণে তিনি মানুষের প্রিয়ভাজন হয়েছিলেন, মেজবানের আয়োজন করে বা অন্য কোন ভাবে নিজের অর্থ-বিত্তের জানান দিয়ে নয়।
আবু সাঈদ চৌধুরী ১৮৯১ সালের ২০শে জানুয়ারি বর্তমান কর্ণফুলী উপজেলার বড়উঠান ইউনিয়নাধীন দৌলতপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আমীর আহমদ চৌধুরী এবং মায়ের নাম তরিকা খাতুন। তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু হয় গ্রামের মক্তবে। ১৯১৭ সালে তিনি চট্টগ্রাম সরকারী মুসলিম হাই স্কুল থেকে এন্ট্রাস পাশ করেন। তাঁর এন্ট্রাস পরীক্ষায় পাসের খবর পেয়ে তৎকালীন শিক্ষা দীক্ষায় পশ্চাৎপদ পশ্চিম পটিয়া ও আনোয়ারা থানার বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রচুর মানুষ তাঁকে দেখতে এবং শুভেচ্ছা জানাতে তাঁর বাড়ী এসেছিলেন। কর্মজীবনে তিনি চট্টগ্রাম শহরের লয়েল রোডে তাঁর বাবার নামে ‘আমীর প্রেস’ প্রতিষ্ঠা করেন। চট্টগ্রামের প্রাচীনতম মুষ্টিমেয় কয়েকটি প্রেসের মধ্যে এটি অন্যতম। তৎকালে মুদ্রণ শিল্প বিকাশে এই প্রেসের ভূমিকা ছিল অনন্য। আবু সাঈদ চৌধুরী হাজী শরিয়ত উল্লাহর নেতৃত্বাধীন ব্রিটিশ বিরোধী ফরায়েজী আন্দোলনে যোগ দেন। চট্টগ্রাম জেলায় ফরায়েজী আন্দোলনের তিনি ছিলেন অন্যতম প্রধান নেতা। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের প্রাক্কালে ফরায়েজী আন্দোলনকে গতিশীল করার কাজে সক্রিয় ভূমিকা পালনের অজুহাতে তৎকালীন বৃটিশ সরকার তাঁর মালিকানাধীন ‘আমীর প্রেস’ বন্ধ করে দেয়। পরবর্তীতে তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪২ সালে তিনি পটিয়া থানাধীন (বর্তমানে কর্ণফুলী উপজেলা) বড়উঠান ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিপুল ভোটে প্রতিপক্ষের জামানত বাজেয়াপ্ত করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদের দায়িত্ব পালন করেন। বড় উঠান ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনকালে তিনি সমগ্র ইউনিয়নে চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি বন্ধে কঠোর পরিশ্রম করেন। প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সময়ে তাঁর এলাকায় চুরি, ডাকাতি, শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। তাঁর আমলে তিনি সামাজিক বিবাদ, মারামারি রোধে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। সামাজিক বিরোধের বিচারকার্য তিনি কঠোরতা, ন্যায়পরায়নতা আর দক্ষতার সাথে নিষ্পত্তি করতেন। এমনকি বড়উঠান ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্টের পদ ছাড়ার পরেও তাঁকে এলাকার মানুষের পারিবারিক ও সামাজিক সম্প্রীতি রক্ষার দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। তৎকালীন সমগ্র বড় উঠান ইউনিয়ন বোর্ড এবং এর বাইরের সন্নিহিত এলাকায় সামাজিক সম্প্রীতি ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় তাঁর যে অবদান, তা’ এখন ইতিহাসেরই অংশ। সামাজিক শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষায় তাঁর দক্ষতা আর সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি তৎকালীন চট্টগ্রাম জেলা কালেক্টরেট কর্তৃক প্রশংসিত হয়েছিলেন। সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষায় তাঁর অবদানের জন্য তিনি তাঁর জীবদ্দশায় জীবন্ত কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছিলেন। দৌলতপুর হাইস্কুলের প্রতিষ্ঠাতা তাঁর ছোট ভাই আবদুল আউয়াল চৌধুরী। এই স্কুল প্রতিষ্ঠায় আবু সাঈদ চৌধুরী ছিলেন তাঁর ভাইয়ের সক্রিয় সহযোদ্ধা।
বড়উঠান ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন এবং আগে ও পরে তাঁর এলাকায় ফৌজদারী ও দেওয়ানী প্রকৃতির বিরোধ শালিশী বৈঠকের মাধ্যমে নিষ্পত্তিতে তাঁর সততা ও অসামান্য দক্ষতার কারণে সরকার তাঁকে চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালতের জুরী বোর্ডের সদস্য মনোনীত করেন। তিনি উৎকোচের শত প্রলোভন উপেক্ষা করে এই দায়িত্ব পালন করেন। চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচার কাজে তাঁর প্রশ্নাতীত সততা, দক্ষতা এবং জটিল মামলা বিশ্লেষণে তাঁর বিচক্ষণতা, তৎকালীন সময়ে তাঁকে সকলের কাছে সম্মান ও মর্যাদার এক উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত করেছিল।
১৯৪৭ সালে এই উপ-মহাদেশ ইংরেজ শাসনের কবল মুক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি দেশে বিভক্ত হয়। বাংলাদেশের অন্তর্গত বর্তমান সিলেট জেলা ভারতে না পূর্ব পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হবে সে বিষয়ে সে সময়ে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। দেশের সেই ক্রান্তিকালে সিলেটের সেই গণভোটের কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার জন্য আবু সাঈদ চৌধুরী চট্টগ্রাম থেকে একটি স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতৃত্ব দিয়ে সিলেট যান এবং সুষ্ঠুভাবে গণভোট অনুষ্ঠানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। সিলেট জেলা পূর্ব পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত হওয়ার পর তিনি তাঁর নেতৃত্বাধীন অনুগামী স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে চট্টগ্রাম ফিরে আসেন। ১৯৪৭ সালের উপমহাদেশের বিভক্তির পর সমগ্র ভারত ও পাকিস্তানের দুটি অংশে হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছিল। উভয় দেশের তৎকালীন সরকার এই দাঙ্গা দমনে ব্যর্থ হয়। এমন কি উভয় দেশের কোথাও কোথাও প্রশাসন উসকানি দিয়ে এই দাঙ্গা প্রলম্বিত করেছিল। দেশের সেই ভয়াবহ সময়কালে এই দাঙ্গা দমনে চট্টগ্রাম শহরের দাঙ্গা প্রবণ এলাকাগুলিতে তিনি অকুতোভয়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিলেন। গ্রামে তাঁর নিজ এলাকায় সংখ্যালঘুদের জান-মাল রক্ষায় তিনি যে অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করেছিলেন, তা’ মানবতার প্রতি তাঁর মমত্ববোধের এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে।
জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী ছিলেন একজন আপাদমস্তক ধর্মপ্রাণ মুসলমান। তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদের গিয়ে আদায় করতেন এবং প্রায়ই প্রতি শুক্রবার তাঁদের পারিবারিক মসজিদে জুমার নামাজে ইমামতি করতেন। তিনি সারাজীবন অত্যন্ত নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যে কাটিয়েছেন। সারা জীবন সামান্য সর্দি জ¦র ছাড়া তিনি অসুস্থ হননি বা ঔষধ খাননি। চলনে-বলনে, দৈহিক গড়নে, প্রবল ব্যক্তিত্বে, জীবন যাপনে কঠোর নিয়মানুবর্তিতায় তিনি যেমনি ছিলেন একজন অত্যন্ত সুপুরুষ, ঠিক তেমনি সততা, ন্যায়পরায়নতা ও জনমানুষের কল্যাণে তাঁর সকল কর্মকান্ড ছিল একজন নিখাদ সমাজহিতৈষীর।
১৯২৫ সালে তিনি মোহসেনা বেগমকে বিয়ে করেন। তিনি দুই কন্যা ও দুই পুত্রের পিতা। ১৯৯৫ সালের ২০শে ডিসেম্বর ১০৫ বৎসর বয়সে বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় তাঁর জীবনাবসান ঘটে। তাঁর ইচ্ছানুযায়ী তাদের পারিবারিক মসজিদের পাশে তাঁর অন্তিম শয্যা রচিত হয়েছে। দেশ ও জনগণের জন্য আবু সাঈদ চৌধুরীর অবদান বর্তমান এবং এর আগের প্রজন্মের অজানা। গণমানুষের নেতা, অজাতশত্রু আবু সাঈদ চৌধুরীর স্মৃতি আজ কালের ধূলায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। তাঁর স্মৃতির উপর জমাট বাঁধা ধূলার আস্তরণ সরিয়ে দিয়ে তাঁকে বর্তমান প্রজন্মের কাছে উপস্থাপন করতে হবে। দেশ ও দেশের মানুষ্যের জন্য তাঁর অবদানের কথা এই প্রজন্মকে জানাতে হবে। এই দায়িত্ব পালনে তাঁর উত্তরাধিকারীদের এগিয়ে আসতে হবে। এ পৃথিবী ছেড়ে তিনি আজ অন্য ভুবনের বাসিন্দা। সেই ভুবনে বসে তিনি হয়ত এটা জেনে আনন্দিত হবেন যে, তাঁর উত্তরাধিকারীদের অন্তরে তিনি এখনো জাগরুক। এখনও প্রতি বছর তাঁর মৃত্যুদিবসে তাঁর সকল উত্তরাধিকারীদের অন্তরে সমানভাবে বাজে তাঁকে হারানোর বেদনার ঐক্যতান।

লেখক : সমাজকর্মী