কাজি রশিদ উদ্দিন

110

গুজব, আজাব ও গজব। তিনটি শব্দই জনস্বার্থের পরিপন্থী। গুজব মানুষ সৃষ্টি করে, গজব ও আজাব আসে প্রকৃতি বা সৃষ্টিকর্তা থেকে। বিভিন্নভাবে গজবের আবির্ভাব ঘটে থাকে। যার পেছনে শুধু গোষ্ঠীগত স্বার্থ কাজ করে। অনেক সময় জটিল পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্র থেকেও গুজব ছড়ানো হয়। আবার রাষ্ট্রযন্ত্রকে বেকায়দায় ফেলার জন্যও গজব রটানো হয়, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধসহ যুগে যুগে বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক ঘটনা রটনা এর সাক্ষ্য দেয়। গুজবে কান দেবেন না। গুজব থেকে সাবধান বা গুজব ছড়াবেন না বা গুজব ছড়ালে কঠিন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এমন বাক্য রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে আগেও বলা হতো এবং এখনো তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। তবে গুজব একটি মারণাস্ত্রের চেয়ে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ অস্ত্র। যা দিয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রভাবশালীদের হয়তো উপকারে এসেছে, কিন্তু বিপর্যস্ত হয়েছে গণমানুষ। গুজব ছড়ানো বা ছড়ানোর কাজে সহযোগিতা করাও জনস্বার্থবিরোধী।
‘গজব’ শব্দটিও বহুপ্রচারিত ও প্রচলিত। মসজিদে বা কোনো দোয়ার মাহফিলে প্রতিনিয়ত গজব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা করা হয়। ধর্মগ্রন্থে সৃষ্টিকর্তা নিজেও স্বীকার করে বলেন, তাঁর (সৃষ্টিকর্তা) দেয়া গজবে অনেক জাতি ধ্বংস হয়েছে। ‘গজব’ বা আজাব প্রকৃতিগত, ধর্মগ্রন্থের মর্মবানি মোতাবেক মানুষ যখন সীমালংঘন করে তখনই প্রকৃতি প্রতিশোধ নেয় এবং এ প্রতিশোধ নেয়ার জন্য প্রকৃতির ইচ্ছায় যথেষ্ট। প্রকৃতির বিশেষ পরিবেশ নষ্ট বা ধ্বংস করা এই সংখ্যায় পড়ে। মানুষকে সতর্ক করার জন্য ‘সীমালংঘন’ সম্পর্কে ধর্মগ্রন্থে বিস্তারিত তথ্য দেয়া আছে, তারপরও সীমালংঘন হচ্ছে অব্যাহতভাবে। রাজ্য শাসনে যেকোনো দেশের জবাবদিহি অনেক জবাবদিহির পরিবর্তে যদি জনগণকে জিম্মি করে শাসকের সব ইচ্ছার বাস্তবায়ন করা হয়। সেখানেই জবাবদিহি বাধাগ্রস্ত হয়। অনেক শাসকদল আত্মপ্রশংসায় মগ্ন থাকার কারণে সীমালংঘনের বিষয়টি তাদের কাছে ধরা পড়ে না, আর যখন ধরা পড়ে তখন সময় পার হয়ে যায়। ‘সীমালংঘন’ সামাজিক ও ধর্মীয় স্বীকৃতি মতে, অগ্রহণযোগ্য এবং কারণেই পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক বিপর্যয় ঘটেছে।
সীমালংঘন বলতে কী বুঝায়? মোটা দাগে বলতে হয়, শপথ ভঙ্গ করা বা ওয়াদা বরখেলাপ একটি স্পষ্ট সীমালংঘন। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মিথ্যাচার ও শপথভঙ্গের পর্যায়ভুক্ত মিথ্যাকে সত্যে পরিণত করার প্রচার গুজবেরই নামান্তর, তারপরও বিষয়টি চলছে বিনাবাধায়। জনগণকে দেশের মালিক যখন তাদের অধিকারের ব্যাপারে তুচ্ছতাচ্ছিল্যে পরিণত হয়, তখন মিথ্যার প্রতিবাদ করার জন্য মেরুদন্ড সহজে আর সোজা রাখতে পারে না। মেরুদÐ সোজা রাখার জন্য যে সাহসী নেতৃত্ব প্রয়োজন। তার ক্ষুদ্র ব্যতিক্রম ছাড়া এর অভাবটাও এখানে অন্যতম কারণ। সব দেশেই সৎ সাহস এবং শক্তি বিবেকসম্পন্ন একটি মানুষ নিজে অন্যায় করবে না এবং কোনো অন্যায় কাজ ওপর চাপিয়ে দিবে না, অন্যদিকে, যেকোনো অন্যায় শত্রু মিত্র যার ওপরই হোক না কেন জুলুম নির্যাতনের প্রতিবাদে পাথর ও পাহাড়ের মতো প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করে যাবে, এমন ব্যক্তিকেই গণমানুষ নেতা হিসেবে তালাশ করে। কিন্তু নেতার মাঠের বক্তব্য ও ব্যক্তি চরিত্রের সাথে যখন গরমিল দেখা দেয়, তখনই গণমানুষ আর আস্থা রাখতে পারে না। তখন থেকেই শুরু হয় নেতৃত্বের বিপর্যয়। একটি রাষ্ট্রের জনমানুষ যদি অহরহ খুন, গুম, ধর্ষণ, শিশু ধর্ষণ, পিতার হাতে পুত্র খুন, পুত্রের হাতে পিতা খুন, মায়ের হাতে শিশু সন্তান খুন, সন্তানের হাতে মা খুন, প্রেমিকার হাতে প্রেমিক খুন, প্রেমিক কর্তৃক প্রেমিকা খুন, শিক্ষকের হাতে সিরিজ আকারে ছাত্রী ধর্ষণ, বিশেষ করে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রী ধর্ষণ, শিশু ধর্ষণ করে হত্যা-ইত্যাদি চলতে থাকে। তখন মনে হয় ভারসাম্য রক্ষার্থে প্রকৃতিকে এগিয়ে আসা ছাড়া অন্য কোনো রাস্তা খোলা থাকে না বলেই প্রকৃতিকে এগিয়ে আসতে হয়, কারণ ‘প্রকৃতি’ তখন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে পারে না। কারণ প্রকৃতির (সৃষ্টিকর্তা) দয়াতেই মানুষ, পৃথিবী ও সভ্যতার সৃষ্টি। বিষয়টি নিয়ে আমি অতি উচ্চমাত্রায় দার্শনিক তত্তে¡র দিকে ধাবিত হলাম কিনা জানি না। তা পাঠকদের জ্ঞান, বিচার বুদ্ধির উপর ছেড়ে দিলাম।
মশা একটি অতি ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র প্রাণী। একটি লেংড়া অর্থাৎ বিকলাঙ্গ মশা দিয়ে তৎকালীন সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ স্বৈরাচারকে ধ্বংস করার ইতিহাস জানার পরও ডেঙ্গু নামক মশাকে ছোট করে দেখার কোনো কারণ খুঁজে পাই না। ডেঙ্গু সমাধানে সিটি করপোরেশন ব্যর্থ বরং এ ব্যর্থতার দায় অন্য কারও ওপর বা প্রতিপক্ষের নিকট চাপানোই এর সমাধান নয়, বরং জনগণের নিকট হাসির খোরাকে পরিণত হতে হয়। প্রতিদিন হাসপাতাল থেকে বলা হচ্ছে রোগী ভর্তি হওয়ার জায়গা নেই, বলা হচ্ছে প্রায় সব জেলাতেই ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় ডেঙ্গু মশা যেন আমাদের ধ্বংসের কারণ হয়ে না দাঁড়ায়। এ জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। পাশাপাশি সবধরনের পাপাচার থেকে মুক্ত থাকার ওয়াদা করে পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার কাছে তওবা করার এখনই সময়।
বিশেষ করে যারা শপথ করে সাংবিধানিক দায়িত্বে আসন গ্রহণ করে জনগণের অধিকার সংরক্ষণ না করে বরং মিথ্যাচার দিয়ে মিথ্যাকে সত্যে পরিণত করতে চান, তাদেরও তওবা করা অত্যন্ত জরুরি। ভবিষ্যতে শপথপূর্বক জনগণের অধিকার সংরক্ষণে সাংবিধানিক পদে যারা অধিষ্ঠিত হবেন। এ তওবা যেন তাদর যাত্রাপথের পাথেয় হয়ে থাক।
বহুল প্রচারিত জাতীয় পত্রিকা বলেছেন, ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা নিয়ে সঠিক তথ্য দেয়া হচ্ছে না। চক্ষু বন্ধ করে রাখলে তো আর প্রলয় বন্ধ হবে না। প্রকৃত সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে। কিন্তু মেয়রদের হামবড়া ভাব দেখে মনে হচ্ছিল, তাদের হাকডাকেই ডেঙ্গু মশা দেশ থেকে পালাবে। কিন্তু কার্যত এটাই প্রমাণিত হলো, যে মশার ঔষধ আমদানি করা হয়েছে তা মানসম্মত নয় বা এর কোনো কার্যকারিতা নেই। এখন সবকিছুতেই শাক দিয়ে মাছ ডাকার চেষ্টা করা হচ্ছে।
প্রকৃতি বলতে সমগ্র সৃষ্টিজগতকে নির্দেশ করে। এই বিশ্বচরাচর ‘মানবসৃষ্ট’ নয়। এমন দৃশ্য অদৃশ্য বিষয় এবং জীবন ও প্রাণ নিয়েই প্রকৃতি। সাধারণভাবে অনুভূতি প্রকাশ করে না বলেই প্রকৃতিকে প্রাণহীন মলে করা হয়। সৃষ্টির সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী জীব হচ্ছে মানুষ। প্রকৃতির চিরন্তন নিয়মে কখনো ব্যত্যয় ঘটে না। সূর্য পূর্ব দিকে ওঠে আবার পশ্চিম দিকে অস্ত যায়-এই নিয়মে কোনো হেরফের নেই। মানুষের পক্ষে কোনোভাবেই স্বেচ্ছাচারী হওয়ার সুযোগ নেই। মানুষ যখন সৃষ্টির প্রথাগত নিয়মে প্রকৃতির বিরুদ্ধে না গিয়ে নিজেদের কর্মকাÐ পরিচালনা করে, তখন এই বিশ্বচরাচর গতিশীল, শান্তিময় ও আনন্দঘন হয়ে ওঠে। কিন্তু যখন এর অন্যথা ঘটে তখনই তা ছন্দ হারিয়ে ফেলে। ভারসাম্য নষ্ট হয় এই সৃষ্টি বলয়ের। এটি নদী, নালা, পাহাড়, পর্বত, বন জঙ্গল ইত্যাদি আরও অনেক ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আর এই নিয়মভঙ্গকে পরিবেশবাদীরা অপরাধ বলে গণ্য করে।
আমাদের সমাজ নানাবিধ প্রতিক‚লতা ও সীমাবদ্ধতার কারণে অপরাধের প্রতিবিধান করতে পারে না। ধমন বা নিয়ন্ত্রণে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সাফল্যও আহামরি নয়। ক্ষেত্রবিশেষে মামলা হলেও প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত ও সাক্ষীর অভাবে আদালতও অপরাধীদের শাস্তি দিতে পারে না অনেক সময়ে। অনেক ক্ষেত্রে সমাজের ক্ষমতাশালী বিত্তশালী ও প্রভাবশালীদের কারণে সাধারণ মানুষ ন্যায়বিচার থেকে দূরে থাকে। অপরাধীরা অপরাধ করে পার পেয়ে নতুন উদ্যমে অপরাধপ্রবণতা চালিয়ে যায়। কিন্তু ওরা কখনো প্রকৃতির রূঢ়তা ও নির্মম প্রতিশোধ থেকে বাঁচতে পারে না, কোনো-না কোনোভাবে প্রকৃতিগতভাবেই অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত হয়। অপঘাত-অপমৃত্যু, দীর্ঘ যন্ত্রণাদায়ক ও দুরারোগ্য রোগভোগ, দুর্ঘটনা, পারিবারিক ও সামাজিক কলহবিবাদ, গণমানুষের রুদ্ররোষ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি নানাবিধ প্রতিকূলতায় শাস্তি পায়। আর এই প্রাপ্য শাস্তি হয় মানুষের কল্পনারও অতীত। এই দুনিয়ায় যারাই দম্ভভরে চলেছে ক্ষমতার দম্ভে ধরাকে সরাজ্ঞান করে অপকর্মে লিপ্ত হয়েছে তাদের পরিণতি মোটেইও সুখপ্রদ হয়নি। প্রকৃতি তাদেরকে ছেড়ে কথা বলেনি।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট