কাঁচের কারাগার

14

মো. আরিফুল হাসান

উত্তরদিক থেকে হাঁটা শুরু করে সে। হাঁটতে হাঁটতে আবার বটগাছটার কাছে ফিরে আসে, যেটি থেকে সে পথ হারিয়ে ছিলো। যাওয়া হচ্ছিলো সুরেশ্বর পুর। পথ মাঝে দীর্ঘ বিস্তৃত বটের ছায়ায় প্রাণ জুড়িয়ে নিতে দু পলক বসেছিলো। কখন যেনো ঘুম পেয়ে গেলো তার। এমন ঝিরি ঝিরি বাতাস, এমন গভীর সবুজ স্বর্গ ছায়া, চোখের পাতা কিনা লেগে আর পারে। আপনাতেই মুদে এসেছিলো দুই চোখ। তারপরে যখন সে ঘুম থেকে উঠলো এবং দেখলো সে সূর্য অস্ত যেতে আর বাকি নেই তখন থেকেই সে গন্তব্য হারা। সে ভুলে গেলো সুরেশ্বর পুরের নাম, সে ভুলে গেলো কোথা থেকে সে এসেছে। একটা স্মৃতিহীন বিভ্রান্তির ভেতর সে মাঠেরএপাশ থেকে ওপাশে, ও পাশ থেকে এ পাশে চক্কর কাটতে থাকলো। বারবার ঘুরে ফিরে শুধু বট গাছটার কাছেই সে ফিরে আসে এবং যখনই আসে দুদন্ড তার এখানে বসতে ইচ্ছে হয় এবং বসার পরেই তার চোখ লেগে যায়। ঘুম থেকে উঠে দেখে রাত্রি এক প্রহর হয়ে গেছে। সে তখন মরিয়া হয়ে আবারও তার একটি গন্তব্য খুঁজতে হাঁটতে থাকে এবং চাঁদের আলোয় বারবার সে ঘুরে ফিরে বট গাছটির তলায়ই ফিরে আসে। এ নিয়ে তিনবার সে চক্কর কেটেছে এবং চক্কর কাটতে কাটতে এখন রাতমধ্য প্রহর যাই যাই করছে, কিন্তু তার গন্তব্য খোঁজা হলো না। এমন কি মনেও পড়ছেনা সে ঠিক কোথা থেকে রওনা দিয়েছিলো। একটি মানুষ যে হঠাৎ করে তার সমস্ত স্মৃতি হারিয়ে ফেলতে পারে এ বিষয়টি তাকে আনন্দ দিচ্ছিলো আবার শঙ্কিতও করছিলো যুগপৎ। শেষমেশ চতুর্থ বার যখন যে গাছটার কাছে ফিরে আসে তখন ফিঁকে একটি চাঁদ পশ্চিম দিগন্ত থেকে ছুটে এসে পূর্ব দিগন্তে অস্ত যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলো। পথিক এবারও ঘুম ঘুম অনুভব করে। তার মনে হয়, দু-দন্ড যদি এখানে বসা যায়, এই অবারিত বৃক্ষ ছাউনির নিচে, যদি মনস্থির করে বসা যায়, তাহলে হয়তো সে তার গন্তব্য খুঁজে পাবে অথবা তার মনে পড়বে সে স্থানের কথা, যেখান থেকে সে যাত্রারম্ভ করেছিলো।
এবারও তার চোখ লেগে আসে এবং সে ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে পতিত হয়। সে দেখতে থাকে, একটি বিরাট বড় নেকড়ে তাকে তাড়া করছে আর সে প্রাণ বাঁচাতে এদিক সেদিক ছুটাছুটি করছে। বেপরোয়া নেকড়েটা কিছুতেই তার পিছু ছাড়ছে না এবং সে ছুটে যাচ্ছে মাঠের পর মাঠ, গ্রামের পর গ্রাম, জনপদ থেকে জনশূন্য অরণ্যের ভেতর দিয়ে সে ছুটে যাচ্ছে প্রাণ বাঁচাতে। চার পাশে বহমান সময় তার দিন রাত্রির ঈঙ্গিত নিশ্চিত করছে এবং সে দেখতে পাচ্ছে বড় একটি থালার মতো টকটকে লাল সূর্য উঠছে পূর্ব দিগন্তে। মানুষজন ঘুম থেকে উঠে আড়মোড়া ভেঙে ছাইয়ের মাজন হাতে নিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে নদীর দিকে যাচ্ছে, নদীতে স্নান করে ফিরে যাচ্ছে নববধূ কোনো ঘরের, কোনো ঘরের জেলেপুত্র হাতের জালটাকে আকাশে বার কয়েক দুলিয়ে ছুড়ে মারছে জলের মানচিত্রে। বৃহৎ একটি বৃত্ত রচনা করে জালটি টুপ করে ডুবে যাচ্ছে। জেলে টেনে তুলছে টেংরাপুটি মাগুর সমেত ভরপুর জাল। এসবের মধ্য দিয়ে, এই দিবসের শুরুর নির্মল চঞ্চল তার মধ্য দিয়ে সে শুধু প্রাণ বাঁচাতে তীব্রতর ছুটে যাচ্ছে আর আশপাশের মানুষ যেনো কেউই তাকে দেখছে না। সে চিৎকার করে সকলের সাহায্য চাইছে কিন্তু কেউ তার আহব্বানে সাড়া দিচ্ছেনা। এমনকি চিতাটিও যেনো কোনো মানুষজনকে দেখতে পাচ্ছেনা, না হলে এমন লোকজনের ভেতর দিয়ে সে তাকে দৌড়ে নিয়ে যাবে কেনো? লোকটি প্রাণ বাঁচাতে রুদ্ধশ্বাসে কোনো এক মানুষকে আঁকড়ে ধরছে, যে কিনা চোখের পিচুটি মুছতে মুছতে জলের কাছাকাছি এসে পড়েছে। কিন্তু কি হলো? কই লোকটি? একটি শূন্যতাকে জাপটে ধরে, অসীম শূন্যতার ভেতর হোঁচট খেয়ে তাড়া খাওয়া লোকটি আবার দৌড়াতে থাকে। এক নববধূ ভেজা বসনে নদী তীর থেকে ফিরছে, পথিকের হঠাৎ কেনো যেনো মায়া হলো নারীটির জন্য। সে ভাবলো, চিতাটি না আবার ওই বধূটিকেই কামড়ে দেয়। সে প্রাণপণে সরুন সরুন চিৎকার করতে করতে দৌড়াচ্ছে কিন্তু নব বধূটি তার কথা শুনছে বলে মনে হচ্ছেনা। অগত্যাচিতা, পথিক ও নব বধূটি একই পথ রেখার মধ্যে এসে পড়লে পথিক অবাক হয়ে লক্ষ করে সে বধূটির ভেতর দিয়ে কেমন জল কেটে চলে যাওয়ার মতো চলে গেলো। চিতাটিও বধূটির ভেতর দিয়ে অবলীয়ায় এ পাশেএসে পৌঁছলো। লোকটি আশ্চর্য হলো যখন সে ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখলো, বধূটিও তেমনি পূর্ব চলে তার পথ চলছে ভেজা বসনে। পথিত তিলেক মাত্র না থেমে আবারও দৌড়াতে শুরু করলো এবং তার পেছনে আগের মতোই ধাওয়া করতে থাকলো চিতাটি।
আবারও ঘুম ভেঙে গেছে। রাত্রি এখন কতটা তার জানা নেই। শেষবার যখন চোখ লেগে আসছিলো তখন দেখেছিলো ফ্যাকাসে চাদটি পূর্বের আকাশে ডুবে যাবে বলে ভেঙে ভেঙে পড়ছিলো। চাঁদটি ডুবে গেছে। কিন্তু রয়ে গেছে অসংখ্য তারা। তারার আলোয় এক ধরনের মায়াময় একটি দৃষ্টি ক্ষেত্র তৈরি হলে সে দেখলো, সে যেই গাছটির নিচে বসেছিলো সে গাছটি কোথায় যেনো হঠাৎ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ভালোভাবে চোখ কচলে আবারও সে চারপাশে তাকালো। না, নেই। মাথার উপর ঝকঝকে আকাশ তারার আলো বুকে ধরে জেগে আছে। সে আকাশের দিকে তাকায়। বট গাছটা থাকলে এতোটা স্বচ্ছভাবে আকাশ দেখার সুযোগ ছিলোনা। পাতার ছাউনিতে আলো ও জলরোধক যে ছাতের নিচে সে বসেছিলো এখন সেখানে শুধুই খোলা আকাশ। সে আবার পূর্ব পশ্চিমে তাকায়। না, দিকটা সে নির্ণয় করতে পারছেনা। আবার সে আকাশের দ্বারস্থ হয়। কোনো একটি তারাকে নিশানা করে দিক ঠিক করার চেষ্টা করে। কিন্তু তারার মানচিত্র তার কাছে দুর্বোদ্য ঠেকে। বিস্তৃত প্রান্তরের মাঝে তার দশদিগন্ত কোনো এক দিগন্ত হীনতায় মুছে যায়। সর্বশেষ ঘুমের ঘোরে যে স্বপ্নটি সে দেখেছিলো তা নিয়ে কিছুক্ষণভাবে। না কোনো চিতাটিতা আশেপাশে নেই। সে আবারও ডানে বামে তাকায়, না, কোনো ক্ষুধার্ত পশু আশে পাশে উৎ পেতে নেই। হাহাকার ভরা বিস্তীর্ণ মাঠটি শুধুমাত্র তাকে শূন্যকোলে করে পড়ে আছে। মাটি বোধয় ঘুমায়। সে মাটির বুকে কান পাতে। একটি কেমন যেনো নিঃশ্বাসের শব্দ টের পায়। সে বুঝতে পারে, সারাদিন রৌদ্র দাহে দগ্ধ হয়ে এই রাতের মাটি এখন গভীর ঘুমের ভেতর নিস্পন্দ হতে চাইছে। সে নাক ডুবিয়ে ঘুমন্ত মাটির গন্ধ নেয়। ঘাসের শিশির ভেজা ডগা তার নাকের ভেতর গিয়ে সুরসুরি দেয়। হেচ্ছো করে হাঁচি আসে তার। সারা শরীরটা একটা ঝাকুনি দেয়। মাথাটা কেমন যেনো লক থেকে খোলে। হ্যা, রাত এখন গভীর; আর সে মাঠে আছে এও সত্য। কিন্তু তার মাথার উপরে যে বট গাছটা থাকার কথা ছিলো সেটি সে এখনো দেখে না। আবারও সে এদিক ওদিক চায়। দূরে আব ছায়ার মতো কি যেনো একটি চোখে পড়ে। সে বসা থেকে উঠে। চোখের উপরে কপালে হাত রেখে সে দৃষ্টিকে নিবদ্ধ করার চেষ্টা করে। হ্যা, আব ছায়াটি সে চিনতে পেরেছে। বিকেল থেকে এই রাত শেষের কাহন অবধি বার বার ঘুরে ফিরে সে সেই ছায়াটির কাছেই ফিরে গেছে। আবার ছায়াগাছটির ভেতর থেকে গন্তব্য ও যাত্রারম্ভ খুঁজে পেতে পন্থমেলা দিয়েছে এবং নিস্ফল হয়ে সে আবারও ফিরে এসেছে বট গাছটির কাছেই। পথিকতার কাঁচের কারাগার ভেঙে আবারও এগিয়ে যেতে থাকে বটগাছটির দিকে।