কলা রুয়ে না কেটো পাত, তাতেই কাপড় তাতেই ভাত

1097

মছিউদ্দৌলা জাহাঙ্গীর

শিরোনাম দেখেই বুঝতে পারছেন খনার বচন, বড়ই বিদুষী মহিলা ছিলেন। রাজা বিক্রমাদিত্যের রাজসভার নবরত্নের একজন ছিলেন রাজজ্যোতিষ, জ্যোতিষশাস্ত্রে ছিলেন ভীষণ পারদর্শী। এখন কোন বিক্রমাদিত্য তা নিয়ে একটু সংশয়ে আছি, কারণ বলা হয় খনার বচনগুলো ৮ম থেকে ১২শ শতাব্দীতে রচিত। কিন্তু আসল বিক্রমাদিত্য তো ছিলেন দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত, সমুদ্রগুপ্তের পুত্র আর তা হল ৩৮০ খৃঃ’র কথা, আজ থেকে অন্তত ১৬’শ বছর আগে। আবার বাতাপির চালুক্য রাজারাও বিক্রমাদিত্য ছিলেন, ৭ম থেকে ১১শ শতাব্দীর মধ্যে অন্তত ৬ জন রাজার এ নাম ছিল। সে হিসেবে তাঁদের সাথে মিলে যাচ্ছে। তাহলে খনার সময়কাল ছিল প্রায় ১২’শ বছর পূর্বে। সে সময় তিনি বলেছেন, কলা রুয়ে না কেটো পাত, তাতেই কাপড় তাতেই ভাত- বরাবর মিলেগেছে আজ ১২’শ বছর পর ২০২০ সালে এসে, হেহেহে। ভাবুন তাহলে কত জ্ঞানী, পন্ডিত মহিলা ছিলেন তিনি। তাঁর কথার মর্মার্থ হল, কলা গাছ লাগিয়ে পাতা কেটো না, যত্ন করবে, তাহলে কলার ফলন বাড়বে, অভাব থাকবেনা। ভাবতাম কলা বেচে কয় পয়সা আসবে, ফলন বাড়লে কি আর না বাড়লে কি? কাক পক্ষীতে খায় ফল, পচে পায়ের তলে পড়ে। ওমা- সেদিন’না বুচ্ছি কলার আসল ছলাকলা, কি- ফলন বাড়লে কি, না বাড়লে কি? অবশ্যই কি, সব কি তো তার ভেতরে, হেহেহে।
এ সময় যদি কলার ফলন না বাড়ে, তবে আর বাড়বে কখন? দুই হাজার টাকা একেকটি কলার দাম, তা কি যে সে কথা? এ কারণেই তো খনা বার শ বছর আগে সেই কথা বলেছেন। কলার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তিনি তখন দেখে ফেলেছেন। অবশ্য বছর খানিক আগে আমরাও দেখেছি, কিন্তু গুরুত্ব দিই নি। গেল রমজানের আগের রমজানে আপনাদের নিশ্চয় মনে আছে ৫০ টাকার বাংলা কলা ৩০০ টাকা ডজন হয়ে গিয়েছিল। আমরা পাত্তা দেইনি, ভেবেছিলাম বাংলা, হলেও আর কি হবে? কারণ যেসব জিনিসের নামের আগে বাংলা আছে সব হল তিন নম্বর। যেমন- বাংলা কদু, বাংলা সাবান, বাংলা মদ সবই নিম্ন মানের। আসল মদ তো হুইস্কি-ব্র্যান্ডি, বাংলা কলাকেও তেমন সাড়ে তিন নম্বর ভেবে আর এগুইনি। কিন্তু না ভুল ভেবেছি, বাংলা ইংরেজি যাই হোক কলা কলাই, সব কলাকৌশল তো ঐ কলার ভেতরই। খনা ভেবেছেন সঠিক বাত, কলার ভেতর কাপড়-ভাত। অতি বুদ্ধিমতি মহিলা যা বলেছিলেন তা-ই ঠিক। যেমন যদি বর্ষে মাঘের শেষে ধন্যি রাজা পুণ্যি দেশে, ওরে ও চাষার পো শরতের শেষে সরিষা রো, না হয় অঘ্রাণে বৃষ্টি হয়না কাঁঠাল সৃষ্টি, ইত্যাদি। এমন হাজার হাজার শ্লোক রয়েছে খনার, কোনটাই খিল যায়নি। আমরা বুঝলাম না, রোজা আমাদের রুজির সন্ধান দিয়েছিল আমরা ধরতে পারিনি। কলার দাম যে আকাশ ছুঁবে পূর্বাভাস পেয়েও বুঝলাম না, অথচ ১২শ বছর আগে বুঝেছেন খনা, হাহাহাহা।
আচ্ছা খনা এত কিছু নিয়ে এত কথা বলেছেন, রুটি-ডিম নিয়ে কি কিছু বলেন নি? কি জানি, হয়তো বললেও বলতে পারেন, না বললেও ক্ষতি নাই ডিমের ঘটনা অনেক জানি। সোনার ডিমপাড়া হাঁস, আরো জানি বিশ্বসুন্দরী হেলেনের মা একটি ডিম প্রসব করেছিলেন, সেই ডিম থেকে তাঁর জন্ম। এমন অনেক সুন্দর সুন্দর কাহিনী ডিম নিয়ে আছে, আর সে সব যেহেতু প্রাগৈতিহাসিক, তাই মানলাম। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে এসে ঢাকা মেডিকেলের ন্যায় একটি সায়েন্টিফিক জায়গায় ডিমের দাম ২ হাজার টাকা তা মানি কেমনে? অবশ্য সোনার ডিম হলে সে অন্য কথা, কিন্তু সোনার ডিমপাড়া সেই হাঁস তো জবেহ হয়েগেছে, হেহেহেহে। তাহলে সোনার ডিম আর আসবে কোত্থেকে? ফলে ২ হাজার টাকা ডিমের দাম হওয়া তো কথা না। তবে পথ একটা আছে, অতএব সেটি এখন দেখি। কি জানি আপনাদের চয়েস হয় কিনা, তথাপি শুনুন। অনেক বছর আগের কথা, হয়রত দাউদ (আ:)’র জামানায় রায়হান নামে এক লোক সরাইখানায় খাবার খাচ্ছেন। পাশে বসে তার সে একই সরাইতে আরেকজন লোকও খাবার খাচ্ছেন, ধরি তার নাম ফারহান। ফারহানের পাতে একাধিক ডিম দেখে রায়হানের খেতে সাধ হল তাই তিনি একটি ডিম তার কাছে চাইলেন। অর্থের বিনিময়ে ফারহান ডিমটি রায়হানকে দিতে রাজি হলেন, রায়হান পরবর্তীতে মূল্য পরিশোধে স্বীকৃত হয়ে ডিমটি নিলেন এবং ভোজন করলেন।
ঘটনার তিন বছর অতিক্রান্ত হল একদিন তাদের দেখা, ফারহান রায়হানের কাছে ডিমের টাকা চাইলেন। রায়হান বললেন, হ্যাঁ মনে আছে আপনার কাছ হতে একটি ডিম খেয়েছিলাম, বলুন দাম কত দিতে হবে? ফারহান বললেন, ৭৬২ টাকা ৭৩ পয়সা। হাহাহা ডিমের দাম শুনে তো রায়হানের দম বন্ধ হওয়ার জোগাড়। চোখ কপালে তুলে রায়হান; বলেন কি আধপয়সা দামের একটি ডিম অত হয় কেমনে? ফারহান ঠাÐা মাথায়; ‘দেখুন আপনি যদি ডিমটি না নিতেন তাহলে তা থেকে একটি বাচ্চা হত। সে বাচ্চাটি বড় হয়ে অনেক ডিম পাড়ত, সেই ডিম হতে অনেক বাচ্চা হত। সেই বাচ্চাগুলি আবার অনেক ডিম পাড়ত, সেই ডিমগুলো থেকে আবার অনেক বাচ্চা হত। এভাবে হিসেব করে দেখলাম, তিনবছরে টাকা আরো বেশী হয়।কিন্তু আপনার কাছ থেকে আমি কিছু কম নিচ্ছি।’ ফারহানের ব্যাখ্যা শুনে রায়হান; এমন হিসাব তো বাপের জনমে শুনি নাই। মীমাংসার জন্য উভয়ে হয়রত দাউদের (আ:) নিকটে গেলেন তারা। ফারহানের ব্যাখ্যা শুনে দাউদও (আ:) দ্বিধাদ্ব›েদ্ব পড়ে গেলেন। যেহেতু তখনও সুদের প্রচলন ছিল, বন্ধ তো হয়েছে আমাদের নবীর সময়। অতএব দাউদ (আ:) সিদ্ধান্তে আসিলেন ফারহানের দাবী ঠিক, তাই তিনি রায়হানকে বললেন ফারহানের দাবীকৃত অর্থ পরিশোধ করতে। হযরত দাউদের (আ:) রায় শুনে রায়হানের প্রাণ যাওয়ার অবস্থা। কেননা অত টাকা তিনি দেবেন কোত্থেকে?
প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে রাস্তায় বসে রায়হান কান্না করতে লাগলেন। সেখানে হযরত সোলায়মানের (আ:) সাথে তার দেখা। সোলায়মান (আ:) তার কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে, রায়হান সমস্ত ঘটনা তাঁকে খুলে বললেন। সোলায়মান (আ:) জিজ্ঞেস করেন; ডিমটি কাঁচা ছিল, না পাক করা ছিল? রায়হান বললেন, পাক করা ছিল। সোলায়মান (আ:) তখন চুপি চুপি তাকে কিছু পরামর্শ দিলেন। পরদিন ভোরে রায়হান জমি কর্ষণ করে তাতে ভাত ছিটানো শুরু করলেন। তা দেখে লোকজন তাকে ধরে হযরত দাউদের (আ:) কাছে আনলেন। দাউদ (আ:) তাকে একীর্তির কারণ জিজ্ঞেস করলেন। রায়হান বললেন, ফসল ফলানোর জন্যে হুজুর। দাউদ (আ:) তখন রুষ্ট কণ্ঠে বললেন; রান্না করা বীজ থেকে কি ফসল হয়? তখন হযরত সোলায়মান (আ:) বললেন, রন্ধন করা ডিম থেকে যদি বাচ্চা হতে পারে তবে রান্না করা বীজ হতে ফসল হতে পারবে না কেন? দাউদ (আ:) সেই কথার ব্যাখ্যা চাইতেই সোলায়মান (আ:) রায়হান ও ফারহানের ঘটনাটা তাঁর সম্মুখে উপস্থাপন করলেন। দাউদ (আ:) তখন সমস্ত বিষয়টা বুঝে দেনার দায় থেকে রায়হানকে মুক্তি দিলেন, কৌশল করার কারণে ফারহানকে শাস্তি দিলেন। রায়হান প্রাণে বাঁচলেন হযরত সোলায়মানের (আ:) বুদ্ধির জোরে। ভাবছি ঢাকা মেডিকেলের ডিমে তেমন হিসেব নিকেশ কিছু আছে নাকি কোন? থাকলে রায়হানকে তো হযরত সোলায়মান (আ:) বাঁচালেন, ঢাকা মেডিকেলকে বাঁচাবে কে?
আবার রুটির হিসাবেও দেখলাম একই কারিগরি, এক পিস রুটি ৩ হাজার টাকা, মাশাল্লাহ্। আচ্ছা ঠিক আছে, সে হিসাবও না হয় ফারহান নিয়মে মিলালাম। রুটি না বানিয়ে সেই গম চাষ করলে তা থেকে আরো গম হত। সেই গম আবার চাষ করলে তা থেকে আবার অনেক গম হত। এভাবে ১ পিস রুটির গম থেকে যে গম উৎপন্ন হবে তা ৬ হাজার টাকা বিক্রি করা যাবে বুঝলাম। কিন্তু এই গোঁজামিল হিসাব আর কত দিন, এভাবে দেশ আর কয় বছর চলবে? বালিশের দাম ৬ হাজার, পর্দার দাম ৩৭ লাখ, ২ হাজার টাকা আন্ডা, পানির জন্য উগান্ডা, হাহাহাহা। কৃষক দেয় ধানে আগুন, কাঁচাধান কেটে মন্ত্রী আর এমপি ফটোসেশন করেন দ্বিগুণ। কেউ তাড়ান কালো বিড়াল, কেউ ধরেন চোর, কেউ গিয়ে ক্যাসিনোতে রাত করে দেন ভোর। দিনদুপুরে প্রশাসনের নাকের ডগায় সন্ত্রাসী ঘুরে বেড়ায় পুলিশ দেখে না। আবার হজ্বে গিয়ে কে ককটেল মারল, কবর থেকে মুর্দা পাথর ছুঁড়ল সেসব ঠিকই দেখে ফেলে। দেশে এসব আসলে স্বাভাবিক বিষয় হয়ে গেছে, না ঘটাটা যেন অস্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে ২০০ ডাক্তারের ১ মাসের খানার বিল ২০ কোটি টাকা করবে?তাও এ করোনা দুর্যোগে, যখন সবার মাঝে আসা দরকার মনুষ্যত্ব, পরস্পর সহমর্মীতা? দেখুন মানুষ কি পিশাচ, এ ভয়ানক বিপর্যয়েও কোন অপরাধ বোধ নেই তাদের মনে। এর কি কোন প্রতিকার নাই, আমরা কি মুক্তি পাব না এই ড্রাকুলাদের হাত থেকে?
লিখা শুরু করেছি খনাকে নিয়ে, রাজা বিক্রমাদিত্য ভীষণ মূল্যায়ন করতেন তাঁকে। কারণ তাঁর গণনা ও ভবিষ্যদ্বাণী বরাবর সঠিক হত। বরাহর পুত্র মিহিরের স্ত্রী ছিলেন খনা। বরাহ ছিলেন রাজাবিক্রমাদিত্যর রাজসভায় রাজজ্যোতিষী। খনার কারণে রাজার নিকট তাঁর প্রতিপত্তি বিঘ্ন হচ্ছিল। এ অপমান সইতে না পেরে বরাহ পুত্রকে নির্দেশ দিলেন খনার জিহ্বা কেটে নিতে। মিহির তাই করলেন, আহ্ কি নির্মম! হীনস্বার্থ চরিতার্থে মানুষ কি নিষ্ঠুর হতে পারে এ ঘটনাই তার নিদর্শন। হীন প্রেস্টিজ পাঙ্কচারের অপরাধে আপন পুত্রবধূকে যদি এ নিঠুর শাস্তি দেয়া যায়, দেশের বিশাল ক্ষতির দায়ে, জড়িতদের বিচার কি হওয়া দরকার সে কথাই তাহলে ভাবুন এবার।