করোনাকালীন শিক্ষাবর্ষের এসএসসি পরীক্ষার ফল : জিপিএ ৫ এর রেকর্ড

38

বিলাস কান্তি দাস

২০২২ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থীরা নবম শ্রেণিতে উঠেছিল ২০২০ সালে। সে বছর মাত্র আড়াই মাস ক্লাস হওয়ার পরই করোনার সংক্রমণ শুরু হয়। ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ হয়ে যায় দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ১৮ মাস পর গত বছরের(২০২১ সাল) সেপ্টেম্বরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সীমিত আকারে ক্লাস শুরু হয়। পরে তা আবারো বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সব মিলিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সশরীরে ক্লাস একেবারেই কম হয়েছে, অনলাইনে বেশি। সাধারণত বছরের ফেব্রæয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হয় এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। চলতি বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল ১৯ জুন। কিন্তু পরীক্ষা শুরুর দুই দিন আগে সিলেটসহ কয়েকটি জেলায় স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কারণে তা স্থগিত করা হয়েছিল। এর পর আগস্টে এই পরীক্ষা নেয়ার পরিকল্পনা করা হলেও তা সম্ভব হয়নি। আবার পিছিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা শুরু হয় ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২। করোনার কারণে ২০২০-২০২১ শিক্ষাবর্ষে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান থেকে বঞ্চিত হয়েছে লাখো শিক্ষার্থী। সেজন্য ২০২২ সালের পরীক্ষার্থীরা ‘করোনার ব্যাচ’ হিসেবে পরিচিত।
এত সব অস্বাভাবিক পরিস্থিতি ও অনিশ্চয়তার মধ্যেও ২০২২ সালের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাসের হার কিছুটা কম হলেও রেকর্ড জিপিএ-৫ প্রাপ্তিসহ অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় ফল সন্তোষজনকই বলা যায়। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী এবার ৯টি সাধারণ শিক্ষাবোর্ডের অধীনে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল ১৫ লাখ ৮৮ হাজার ৬৫৭ জন। এর মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছে ১৩ লাখ ৯৯ হাজার ৫৭১ জন। গড় পাশের হার ৮৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ। সব বোর্ড মিলিয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ জন, যা গতবার ছিল ১ লাখ ৮৩ হাজার ৩৪০ জন। এ বছর জিপিএ-৫ বেড়েছে ৮৬ হাজার ২৬২ জন। (প্রথম আলো, ২৯ নভেম্বর-২০২২)। অর্থাৎ, এক শিক্ষাবর্ষের ব্যবধানে পূর্ণ জিপিএ প্রাপ্ত শিক্ষার্থী বেড়েছে ৪৭ শতাংশ।এসএসসি পরীক্ষায় গ্রেডিং পদ্ধতি চালুর পর (২০০১ সালে প্রথম বার সারা দেশে জিপিএ-৫ পেয়েছিল ৭৬ জন) এ বছরই সবচেয়ে বেশী জিপিএ-৫ পেয়েছে শিক্ষার্থীরা। বর্তমান পরীক্ষা পদ্ধতিতে জিপিএ-৫ এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় সর্বোচ্চ সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হয়। বৈশ্বিক মহামারি করোনাকালীন দুর্যোগকে কেন্দ্র করে স্বল্প সিলেবাসে অনুষ্ঠিত এমন ফল সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদের জন্য নয় শুধু, দেশের সবার জন্যই আনন্দের সংবাদ। তবে জিপিএ-৫ বৃদ্ধির পাশাপাশি পাশের হার বৃদ্ধি এবং শিক্ষার গুণগত মান বাড়ানোর বিষয়েও সংশ্লিষ্টদের পরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ দরকার।
জিপিএ-৫ বৃদ্ধির নেপথ্য কারণঃ পরীক্ষাসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে নি¤েœাক্ত কয়েকটি কারণে এবছর(২০২২) জিপিএ-৫ বেড়েছে। ১. অধিক সংখ্যক বিকল্প থেকে পছন্দের সুযোগ ছিল। স্বাভাবিক সময়ে সৃজনশীল অংশে ১১টি প্রশ্নের মধ্যে ৭টির উত্তর করতে হতো। এবার ১১টি প্রশ্নই ছিল। কিন্তু উত্তর করতে হয়েছে ৩টির। আবার এমসিকিউ অংশে ৩০টির মধ্যে সব ক’টির উত্তর দিতে হতো। কিন্তু এবার প্রশ্ন ৩০টি ঠিকই ছিল, উত্তর করতে হয়েছে ১৫টির। ২. তিন ঘণ্টার পরিবর্তে দুই ঘণ্টা সময়সীমায় পূর্ণমান ৫০ নম্বরে পরীক্ষা দিলেও সেটিকে ১০০ ধরে প্রাপ্ত নম্বর দ্বিগুণ করে দেওয়া হয়। ফলে তুলনামূলক চাপমুক্ত থেকে পরীক্ষা দিতে পেরেছে তারা। ৩. তিন বিষয় অর্থাৎ বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বা সাধারণ বিজ্ঞান, ধর্ম ও নৈতিকশিক্ষা এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ের পরীক্ষা বাদ দেওয়া হয়। এগুলোর মূল্যায়ন হয়েছে জে এস সি ও সমমানের পরীক্ষার মূল্যায়ন (সাবজেক্ট ম্যাপিং) এর ভিত্তিতে। ফলে ঐ সকল বিষয়ে জে এস সি তে যারা জিপিএ-৫ পেয়েছিল তারা নির্বিঘেœ এস এস সি তে তার সুফল পেয়েছে। ৪. সৃজনশীল পদ্ধতিতে উত্তরের আংশিক নম্বর প্রদানের সুযোগ থাকায় তুলনামূলক কঠিন বিষয় হিসেবে বিবেচিত গণিত ও ইংরেজিতে এবার ভাল ফলাফল করায় জিপিএ-৫ প্রাপ্তিতে শিক্ষার্থীদের সহায়ক হয়েছে। ৫. করোনাকালীন ‘শিখনঘাটতি’ পূরণে অনলাইন ক্লাসের পাশাপাশি সরকারের ইতিবাচক পদক্ষেপ বিশেষ করে ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ করতে গিয়ে তাদের পাঠ্যবইয়ে কম বেশি মনোনিবেশ করতে হয়েছে। সামগ্রিক ফলাফলে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ৬. সর্বোপরি উত্তরপত্র মূল্যায়নের ব্যাপারে পরীক্ষকদের প্রতি শিক্ষাবোর্ড সমূহের উদার নীতি প্রদর্শনের পরামর্শ শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ জিপিএ প্রাপ্তিতে সহায়তা করেছে বলে প্রতীয়মান হয়।
এবারের ফলাফলের উল্লেখযোগ্য দিক- ১. বিগত কয়েক বছর ধরেই পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলে তুলনামূলকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে মেয়েরা। গতবারের মতো এ বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাশের হার ও জিপিএ-৫ প্রাপ্তির দিক দিয়ে ছাত্রদের পেছনে ফেলেছে ছাত্রীরা। ৯টি সাধারণ শিক্ষাবোর্ডে ছাত্রীদের পাশের হার ৮৮ দশমিক ৪২ শতাংশ। ছাত্রদের পাশের হার ৮৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এসএসসিতে মোট জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রী ১ লাখ ৩১ হাজার ৩০৪ জন এবং ছাত্র ১ লাখ ২ হাজার ৪৫৯ জন। ২. ৯টি সাধারণ শিক্ষাবোর্ডের অধীন এসএসসি পরীক্ষায় এবার পাশের হারের দিক দিয়ে সবচেয়ে এগিয়ে আছে যশোর শিক্ষাবোর্ড (৯৫ শতাংশ)। সবচেয়ে পিছিয়ে সিলেট (৭৯শতাংশ)। (প্রথম আলো, ২৯ নভেম্বর-২০২২)। সিলেটে ভয়াবহ বন্যার কারনে শিক্ষার্থীদের ফলাফল ভালো হয়নি বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন। ৩. এবার একজনও পাশ করেনি, এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা গতবারের চেয়ে ৩২টি বেড়ে ৫০টি হয়েছে। শতভাগ পাশের হার অর্জন করেছে ২ হাজার ৯৭৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। গত বছর এমন প্রতিষ্ঠান ছিল ৫ হাজার ৪৯৪টি। অর্থাৎ শূন্য পাশ এবং পাশের হারের অবনতি ঘটেছে। ৪. এসএসসিতে এবার বান্দরবান জেলায় পাশের হার ও জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেড়েছে বটে তবে জেলার কোনো বিদ্যালয়ে শতভাগ শিক্ষার্থী পাস করেনি (প্রথম আলো, ২৯ নভেম্বর-২০২২)। ৫. এস এস সি ও সমমানের পরীক্ষায় এবার প্রায় সাড়ে ১৭ লাখ শিক্ষার্থী পাশ করেছে। এর পরও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অন্তত ১৬ লাখ আসন শূন্য থাকবে। শিক্ষার্থী পাবে না অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর তুলনায় এই স্তরে কলেজ, মাদ্রাসা, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসন বেশি থাকার কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হবে (দৈনিক যুগান্তর, ৩০ নভেম্বর, ২০২২)। ৬. সর্বোচ্চ জিপিএ-৫ পাওয়ার পরও অনেক শিক্ষার্থী আসন স্বল্পতার কারণে প্রত্যাশিত সরকারি কলেজে ভর্তির সুযোগ পাবে না।
ফলাফল সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য : ২৮ নভেম্বর-২০২২ এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল হস্তান্তর অনুষ্ঠানে নিজের কার্যালয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘ফলাফলমুখী হয়ে স্কুল বাছাবাছির যে প্রবণতা, তা বন্ধের জন্য সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মান বাড়াতে হবে। তাঁর ভাষ্যে, ভালো শিক্ষার্থী নিয়ে ফল ভালো করায় কোনো কৃতিত্ব নেই, বরং অপেক্ষাকৃত দুর্বল শিক্ষার্থীদের নিয়ে ভালো ফল করানোয় কৃতিত্ব বেশি’। সন্তানের ভালো ফলের জন্য অভিভাবকদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাছাবাছির দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘ভালোভালোকতগুলো স্কুল আছে, আমাদের অনেকের ধারণা ওইসব স্কুলে না পড়লে নাকি পড়াশোনাই হয় না, ওখানে না পড়লে নাকি ইজ্জত থাকে না’। ভালো ভালো শিক্ষার্থী ভর্তি করে ভালো ফল দেখানো খুবই সহজ মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, এই মানসিকতাগুলো আমাদের একটু পরিবর্তন হওয়া একান্তভাবে দরকার। যদি কেঊ গাদা পিটিয়ে মানুষ করতে পারে, তাকে আমি ক্রেডিট দিই। যে কিছু জানে না, তাকে ভালো শিক্ষা যে দিতে পারবে, আমার মনে হয় তাদেরকে একটু বিশেষভাবে সমর্থন দেওয়া, পুরস্কৃত করা উচিত’। (দৈনিক পূর্বকোণ, ২৯ নভেম্বর-২০২২)। বর্তমানে সরকারি বেসরাকারি স্কুলে লটারির মাধ্যমে ভর্তির যে পদ্ধতি সরকার চালু করেছে তা যদি অব্যাহত থাকে স্বল্প সময়ের মধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য শতভাগ বাস্তবায়ন হবে-এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। আমরা আশা করবো, কোন ধরনের অজুহাতে যেন লটারি পদ্ধতি বন্ধ/ বাতিল না হয়। এর মাধ্যমে মামুলি ভর্তি পরীক্ষার নামে বাছাই করা শিক্ষার্থী নিয়ে ভালো প্রতিষ্ঠানের (?) কৃতিত্বের দাবীদার সরকারি/বেসরকারি হাতেগণা কিছু স্কুলের শিক্ষার্থী ভর্তির অশুভ প্রতিযোগীতা বন্ধ হবে এবং সারা দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পড়ালেখার গুণগত মান উন্নয়নের জন্য সঠিক ধারার প্রতিযোগিতার সুযোগ উন্মোচিত হবে।
যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে কেউ পাশ করেনি অর্থাৎ শূন্য পাশ, তাদের বিষয়ে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, ফল প্রকাশের দিন সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি জানান, ‘আমরা শাস্তি দিতে চাই না, বরং কীভাবে এ সমস্যা কাটিয়ে ওঠা যায়, সে ক্ষেত্রে সহায়তা দিতে চাই’। (প্রথম আলো, ২৯ নভেম্বর-২০২২)। একজন শিক্ষা ও শিক্ষক বান্ধব শিক্ষামন্ত্রীর পক্ষেই এধরণের কথা বলা সম্ভব। আমরা চাই শিক্ষামন্ত্রীর উপরোক্ত বক্তব্যের প্রতি সর্বোচ্চ সন্মান রেখে এ বছরের শূন্য পাশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকবৃন্দসহ সংশ্লিষ্ট সকলেই সতর্ক হবেন এবং পেশাদারিত্ব মনোভাব নিয়ে আন্তরিকতার সাথে দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হবেন। করোনাকালে অনেক বড় ধকল গেছে এবারের পরীক্ষার্থীদের ওপর। এরপরও তারা যে ফল করেছে সেটা খুবই সন্তোষজনক। শিক্ষার্থীদের জীবনে মাধ্যমিকের ফল অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে তারা উচ্চশিক্ষার বৃহত্তর জগতে প্রবেশের সুযোগ পায়, যা তাদের জীবন গঠন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেয়। এবার যারা এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে, তাদের সবার প্রতি রইল আমাদের অভিনন্দন। যারা অকৃতকার্য হয়েছে, তাদেরও হতাশ হওয়ার কারণ নেই। আগামীতে ভালো ফলের জন্য এখন থেকেই তাদের প্রস্তুতি নেয়ার পরামর্শ থাকল।
লেখক : প্রধান শিক্ষক, উরকিরচর উচ্চ বিদ্যালয়, রাউজান, চট্টগ্রাম