কবে পাবো নিরাপদ সড়ক?

15

 

সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা মহামারি রূপ নিয়েছে। এই কয়দিনে ঢাকার নটরডেম কলেজের এক শিক্ষার্থীসহ সারাদেশে প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে বহু মানুষ। ঢাকার রাজপথে নেমে আসে হাজারো শিক্ষার্থী। তারা তাদের সহপাঠী হত্যার বিচার চায়। এমনিতে পরিবহণে ‘হাফ পাস’ ভাড়া নিয়ে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ চালিয়ে আসছে। তার উপর সড়ক দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থীর প্রাণহানি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এদিন চট্টগ্রামেও কাভার্ড ভ্যানের নিচে চাপা পড়ে মারা গেছে আরো এক কলেজ ছাত্রী। বলা চলে সড়ক দুর্ঘটনা এখন একটি জাতীয় দুর্যোগে পরিণত হয়েছে! মানুষ মারা যাচ্ছে কেবল তা নয় দুর্ঘটনাগ্রস্ত পরিবারগুলোতেও চলে শোকের মাতম। স্বজন হারিয়ে বাকরুদ্ধ হন তারা। দেশে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ও মৃত্যুর হার দুই-ই বাড়ছে। করোনায় লকডাউনের সময় বেশকিছুদিন সড়ক দুর্ঘটনার হার কম ছিল। এখন আবার সড়কে নিয়মিত দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে।
অবস্থা এমন, সড়ক-মহাসড়কের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়াও নিরাপদ নয়। কখন চাকার নিচে চাপা পড়ে সে শংকায় থাকতে হয়। নিজের সচেতনতা নিজেরই হওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই! মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো। বাস, ট্রাক দুর্ঘটনার পাশাপাশি বাইক দুর্ঘটনাও ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। বিশেষ করে উঠতি বয়সের তরুণ, যুবকদের অনেকে শখের বশে বেপরোয়া হয়ে স্কুটার চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পতিত হয়।
প্রতিদিন অসংখ্য মানুষকে চাকরি, ব্যবসাসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজে বাইরে যেতে হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে হয় শিক্ষার্থীদের। পথে দুর্ঘটনার ভয় থাকলেও একপ্রকার জানবাজি রেখেই চলতে হয়। কোন উপায় নেই। গাড়িচালকদের কথা কী বলব! ‘যেভাবেই হোক অপর গাড়িকে ওভারটেক করে এগুতে হবে’-এমন মানসিকতা নিয়েই তারা গাড়ি চালান অনেক চালক।
সড়ক দুর্ঘটনা এদেশে একটি মানবসৃষ্ট মহাদুর্যোগ। যা প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে কোন পক্ষ থেকেই কার্যকর তেমন কোন পদক্ষেপ চোখে পড়েনা। দায়সারা কিছু ব্যবস্থা নিয়েই শেষ! বিভিন্ন বেসরকারি ও সামাজিক সংগঠন এ ‘দুর্যোগ’ থেকে মানুষকে রক্ষার জন্য জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করে থাকে। কিন্তু তা তেমন কার্যকরী নয়। এ অবস্থায় সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষকে কার্যকর ও দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশেষ করে গাড়ি চালকদের মাঝে সচেতনতা তৈরির পদক্ষেপ নিতে হবে। দায়ী চালকদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে। নিষিদ্ধ করতে হবে গাড়ি চালানোর সময় চালকদের মোবাইলে কথাবার্তা বলা। সড়কে দুর্ঘটনা রোধে জড়িত অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি ‘মৃত্যুদন্ড’র বিধান কার্যকর করতে হবে। রাস্তায় যেন কোন ধরনের লক্কর-ঝক্কর মার্কা কিংবা দুর্বল ইঞ্জিনের যান চলাচল করতে না পারে সে ব্যাপারে কঠোর হতে হবে। নিয়ন্ত্রণ করতে হবে যানবাহনের বেপরোয়া গতি। নেশা করে যেন কোন চালক গাড়ি চালাতে না পারে সেদিকেও দৃষ্টি রাখতে হবে। পাল্লা দিয়ে ‘ওভারটেকিং’ করা বন্ধ করা, চোখে ঘুম নিয়ে গাড়ি চালানো ইত্যাদি থেকে বিরত থাকতে ড্রাইভারদের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানের সময় চালকদের বাস্তব অভিজ্ঞতাকেই আমলে নিতে হবে। কোন অযোগ্য ও অদক্ষ চালক যেন লাইসেন্স না পায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি গাড়ি চালকদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করা গেলে ভালো হয়। যদিও এটি বাস্তবায়নের কথা শোনা যাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন সড়ক, মহাসড়কের পাশাপাশি স্টেশনগুলোকেও প্রশস্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক, মহাসড়ক সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে। একজন চালক কত মানুষের প্রাণ হাতে নিয়ে রাস্তায় গাড়ি চালান। সেই মানুষগুলোর প্রতি চালকদের দরদ থাকা উচিত। যেভাবেই হোক একজন চালককে মানুষের প্রাণ বাঁচাতে সম্ভব সবকিছুই করতে হবে। ‘সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য বেশি’- একথা চালকদের মাথায় রাখতে হবে। সবচেয়ে জরুরি হলো কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারি বৃদ্ধি।
মানুষের প্রয়োজনে বাড়ছে যানবাহনের সংখ্যা। প্রতিদিনই বহুসংখ্যক নতুন গাড়ি রাস্তায় নামছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দুর্ঘটনাও। এসব দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পাশাপাশি অসংখ্য মানুষ সারাজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করছে। এই মানুষগুলোর সাথে জড়িত পরিবার ও তাদের আত্মীয়-স্বজন অবর্ণনীয় কষ্টে পড়ে। বিষয়গুলো আমাদের ভাবা উচিত বলে আমি মনে করি। সরকারি, বেসরকারি সংস্থা এবং সংশ্লিষ্ট যানবাহন কর্তৃপক্ষকে নিহত ও আহত হওয়া পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। করতে হবে সব ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা। আমরা সড়ক দুর্ঘটনামুক্ত একটি বাংলাদেশ প্রত্যাশা করি। সড়কে এই মৃত্যুর মিছিল কবে থামবে? আর কত প্রাণ ঝরবে? কবে পাবো নিরাপদ সড়ক? মৃত্যুফাঁদে পরিণত হওয়া সড়কগুলোকে যেভাবেই হোক নিরাপদ করতে হবে সকলের জন্য।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট