কথারও দাম হয় অতি কয় যদি মহামতি

96

কথা! মাশাল্লাহ্ বিশাল এক ব্যাপার, নানা কথা চালু আছে সমাজে এই কথা নিয়ে। কথা কম বলো, বেশি বললে দাম থাকে না, না বললেও আবার নাম থাকে না। একটা বিপদ, বেশি বললে পাগল না বললে ছাগল অর্থাৎ কথা বললেও জ্বালা না বললেও জ্বালা। কিন্তু কথা যে হয় গলার মালা কখনো কি তা ভেবে দেখেছি? আমি কিন্তু ভাবি আর ভাবতে গিয়ে প্রথম যে নামটি আমার মাথায় আসে তা হল প্রখ্যাত ইংরেজ ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্সের নাম। মা গো মা, কি কপাল নিয়ে যে জন্মেছিলেন, ১৮১২ হতে ১৮৭০ পর্যন্ত ছিল তাঁর জীবনকাল। হায়রে আল্লাহ্ কি ভাগ্য, সেই সময়ে তিনি প্রতিটি শব্দের জন্য ১৫ ডলার পারিশ্রমিক নিতেন! ভাগ্য আর কাকে বলে, আহা ভাগ্য যদি হয় ডিকেন্স খেতে পারে চিকেন্স, আমরা তো পোড়া কপাইল্যা লাখ শব্দ লিখেও দুই টাকা পাই না। বাদ দেন আমাদের কথা, আমরাও একটা মানুষ আমাদের দেশও একটা দেশ। তবে যা’ই বলুন লিখা যেমন তেমন কথার কিন্তু অনেক দাম আমাদের দেশে, বলতে পারেন কোটি টাকা। সে কথায় আসব, তার আগে বিদেশ শেষ করি। আবুল কাশেম ফেরদৌসী, বিশাল বিদগ্ধ এক কবি, সুলতান মাহমুদের সাথে হাজার বছর আগে বাইন্ডিং করেছিলেন ‘শাহনামা’র প্রতিটি শ্লোকের জন্য একটি করে স্বর্ণমুদ্রা নিবেন। ষাট হাজার শ্লোকের সেই শাহনামা, ভেবে দেখুন লিখার কি মূল্য তখন? এখন কেউ কেউ বলতে পারেন সেটাতো কথা’না হয়েছিল কাজতো হয় নাই, সুলতান প্রতিশ্রæতি রক্ষা করেননি। সেটা অন্য কথা, মূল্যতো নির্ধারণ হয়েছিল এবং তা সুলতান মেনেও নিয়েছিলেন। তাছাড়া প্রতিশ্রæতি রক্ষা করেননি সেটিও ঠিক না। সুলতান পরবর্তীতে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন এবং প্রতিশ্রæত অর্থ প্রদানও করেছিলেন। সেই অর্থ কবি ব্যবহার করেছিলেন কি করেননি তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও, কবির স্মৃতি রক্ষার্থে যে সে অর্থ ব্যবহার হয়েছিল তাতে কোন মতভেদ নেই। কবির নামে বিবিধ স্থাপনা স্থাপিত হয়েছিল গজনিতে।
লিখার মূল্যের সাথে সাথে বিদেশে কিন্তু কথারও প্রচুর মূল্য আছে। বিল ক্লিনটন আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট, তিনি নাকি প্রেসিডেন্টকালীন আয় হতে এখন অনেক বেশি কামাই করছেন। বিভিন্ন সভা-সেমিনারে ভাষণ দিয়ে বেড়ান আর প্রতি ভাষণের জন্য নাকি দুই লক্ষ ডলার করে নেন মাশাল্লাহ্। কথার এত দাম, ঈশ যদি এদেশে হত তাহলে বাঙালি আর ভাতে মরত না কারণ সব কিছুতে লাস্ট হলেও বাঙালি কিন্তু ঐটাতে ফার্স্ট। তবে লাইট এ্যাট দ্য অ্যান্ড অব দ্য টানেল দেখা গেছে, আল্লাহর রহমতে আমাদের দেশেও কথার মূল্য স্থাপিত হয়েছে। আমাদের মহান নির্বাচন কমিশন আমাদের সে পথ করে দিয়েছে ‘বক্তৃতা ভাতা’র মাধ্যমে। মাশাল্লাহ্ আর চিন্তা নাই, আগে মাথা বেঁচে খেতাম এখন কথা বেঁচে খাব, ধন্যবাদ নির্বাচন কমিশন, তোমার নাম করে শেষ করা যাবে না। আমাদের তুমি বাঁচার রাস্তা দেখিয়েছ, আহা লিখতে লিখতে হাত ব্যথা করে ফেলেছি, কলম ভোঁতা করে ফেলেছি দুই পয়সার মুখ কিন্তু কখনো দেখিনি। আশা করছি কমিশনের কৃপায় কিছু পয়সার মুখ অন্তত এখন দেখব, দেখি বা না দেখি এটি বলার অন্তত নৈতিক অধিকার জন্মাবে- কমিশন পেলে আমরা কেন পাব না? দিনে কয়েক ঘন্টা বক্তৃতা করে মাত্র ১৮ দিনে কমিশন যদি সংসদ নির্বাচনে ৬১ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা এবং উপজেলা নির্বাচনে ৬১ কোটি ৭৫ লক্ষ টাকা পায়, আমরা মাসের পর মাস লিখে কি ৬১ হাজার টাকাও দাবি করতে পারি না? হিসাব করলে দেখা যাবে একেক জন কমিশনার কোটি টাকা করে পেয়েছেন। ‘কোর্স উপদেষ্টা’ হিসেবে কমিশন সচিব একাই নিয়েছেন নাকি ৪৭ লাখ টাকা, তিনি ‘বিশেষ বক্তা’ হিসেবেও টাকা নিয়েছেন। সেই টাকার অংক জানা যায়নি এবং তিনি এখন স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব। অতএব সচিব তত পেলে সহিস তথা সাহেব কত পাবেন তা তো সহজবোধ্য। ফলে ভরসা ছাড়া চিন্তা নাই, নিরাশ আঁধারে খোদা তুমি আশার আলো, অর্থ কষ্টে কমিশন ছাড়া জগত কালো। সুতরাং নির্বাচন কমিশন আমাদের শেষ ভরসার স্থল, পথ চলার শক্তি, নৈতিকতার যুক্তি, অর্থনৈতিক মুক্তি।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, ‘আমাদের সময় আমরা অনেক বক্তৃতা, প্রশিক্ষণ দিয়েছি কিন্তু কোন ভাতা নিইনি। অর্থাৎ তখন ভাতা প্রথা ছিল না, মাশাল্লাহ্ মাত্র দশ বছরের ব্যবধানেই কোটি টাকা ভাতা বাহ্ শূন্য হতে অসীম! অতএব আজ লিখার মূল্য শূন্য হতে পারে কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে সেটাও নিশ্চয় কোটি টাকা হবে তাই নয় বিষন্ন। আহা ভাবতে যে কি ভালো লাগছে, তখন আমাদের দিন কেমন কাটবে ভাবলে গায়ে শিহরণ জাগে। তখন আমরা প্রাণ খুলে গাইব আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে এখন থাকব মোরা অবকাশে। তবে অবাক হই চামড়ার কথা ভেবে, হায়রে খোদা চামড়ার কোন দামই নাই? আশ্চর্য, কথার দাম আছে, পানির দাম আছে কিন্তু চামড়ার দাম নাই! চট্টগ্রাম ওয়াসা নয় টাকার পানি নাকি ষোল টাকা মূল্য করল আর এবার ঈদে গরুর চামড়ার দামই থাকল না। কেউ এসে চামড়ার দামও যাচাই করল না ফলে অনেকে চামড়া হয় মাটিতে পুঁতে ফেলেছে নয় ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছে। আর ঐদিকে নির্বাচন কমিশন কথা বিক্রি করছে কোটি টাকা দাম দিয়ে। যে চামড়া একসময় ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছি সে চামড়া এবার ৩ টাকাও মুলালো না! চামড়া নিয়ে কিছু কথা আমার ১০/৮/১৯-এ প্রকাশিত ‘কোরবান: সেকাল একাল ও ভবিষ্যৎকাল’-এ লিখেছি কিন্তু লিখা শেষ হইয়াও হইলনা শেষ। লিখেছি কোরবান: সেকাল একাল ও ভবিষ্যৎকাল কিন্তু চামড়ার শুরু হয়েছে আকাল। কেমন কথা, গতবার ৩০০ টাকা বিক্রি করলাম এবার কিছু পেলামনা? ভাবছি নির্বাচন কমিশনের মত চামড়ার জন্য একটি কমিশন গঠন করতে হবে তাহলে কথার মত চামড়ার দামও বেড়ে যাবে। একটি প্রবন্ধ কমিশনও গঠন করব তখন আমাদের লিখাও মূল্যায়িত হবে, হাহাহা। আচ্ছা দেশে এসব কি হচ্ছে? যার মূল্য থাকার কথা তার কোন মূল্য নাই, যার কোন মূল্য না থাকার কথা তার দাম হয়ে যায় কোটি টাকা।
আসলে আমাদের দেশটা হল বড় হুজুগে দেশ, বছর কয় আগে লাল এক টাকার মুদ্রাটি হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। সকলের কি দৌড়াদৌড়ি তখন, ঘরের বিছানাপত্র, আলমারি-ডেস্ক, ঘরের আনাচ-কানাচ তন্নতন্ন করে ফেলেছে কোনখানে লাল টাকা পাওয়া যায় কিনা। এখন ভিক্ষুককে দিলে সে’ও নেয় না ঐ লাল টাকা। শেয়ার বাজার, মাগো মাÑ জমি-জায়দাদ, ভিটামাটি সহ বিক্রি করে সেখানে ঢুকিয়ে দিয়েছে সব টাকা, তারপর বাজার যখন গেলো আটকে সে তখন গেলো লটকে, ফাঁসি আরকি। ওদিকে আবার ডেস্টিনি গাছের বেষ্টনী দিয়ে সবাইকে চেঁছে ফেলেছে, সবার নামে নাকি গাছ লাগিয়েছে বড় হলে সবাই সে গাছের মালিক হবে। হায়রে বাঙালি, ‘গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল’Ñ জেনেও হলনা তোর আক্কেল বুঝলি না ডেস্টিনির খেল। তারপরও যখন ইউনিপে-টু এল সবাই গিয়ে আবার তাতে হুমড়ি খেয়ে পড়লিÑ এই হল আমাদের অভ্যাস। যা’ই ঘটুক কিছুক্ষণ পরেই সব ভুলে গিয়ে আবার নতুন ফাঁদে পা দেই। ছেলেধরা, কল্লাকাটা, গুজব, গণপিটুনির কথা কত আর বলব, কদিন আগে দেখলেন তো সব। আহা কত লোককে গণপিটুনি দিয়ে মারল, ছেলে ধরা সন্দেহে ছেলের মাকেই পিটুনি দিয়ে মেরে ফেলল। আজব সব কাÐ ঘটছে এই দেশে, চামড়ার দাম নাই তাই মাটিতে পুঁতে ফেলল। ধানের দাম নাই কেরোসিন ঢেলে আগুন দিল, আবার দেখলাম শিক্ষকের গায়েও কেরোসিন ঢেলে দিল ভাগ্য ভাল ম্যাচ ছিল না। যেখানে ধান অচল, চামড়া অচল, মানুষের সম্মান অচল সেখানে কথা আর পানির দাম প্রবল, অথচ সারা দেশ পানিতে টলমল। যেখানে পরামর্শ ফ্রিতে মিলে সেখানে লাখ টাকা পায় বক্তৃতা দিলে। এখানে চামড়ার জন্যে হচ্ছে গর্ত বক্তৃতা নিচ্ছে সকল অর্থ, মানুষ কষ্টে টাকা কামায় সরকার কেবল ট্যাক্স বাড়ায়। ঠিক আছে নির্বাচন কমিশন বক্তৃতা দিয়ে কোটি টাকা কামিয়েছে সমস্যা নাই, হতে পারে দামি কথা তাই লাখ টাকা। আমাদের মন্ত্রীগণও অনেক দামি কথা বলেন, কালো বিড়াল, ধাক্কামারা, স্পীড মানি, ব্লাউজ পরা, ইত্যাদি তো আছে। ইদানিং আবার শুনছি বিএনপি ধানে আগুন দিয়েছে, বিএনপি চামড়া কিনে মাটিতে পুঁতেছে, ডাস্টবিনে ফেলেছে। এখন নির্বাচন কমিশনের কথার দাম কোটি টাকা হলে মন্ত্রীদের কথার দাম কত?
সম্প্রতি আমাদের র‌্যাবের ডিজি বেনজির সাহেব আরেক দামি কথা বললেন, কাশ্মীর নিয়ে কথা বললে নাকি আল্ট্রাইসলামিস্ট। মাগো আমাদের কি হবে? আমরা সাধারণ মানুষ, ধর্ম আমাদের সেন্টিমেন্টাল করে তুলে, সেই ঠেলাতে কাশ্মীর নিয়ে যদি মুখ ফস্কে কিছু বেরিয়ে যায় তো খবর আছে। ডিজির বলা কোটি টাকা তোলা অবস্থা মোদের করে দেবে ঘোলা, তাই সদা থাকতে চাই অবোলা। কিন্ত কাশ্মীরের যদি বিজয় হয় ডিজি-র মুখ কি রয়? বিষয় হল মন্ত্রী-এমপিগণ, নির্বাচন কমিশনারগণ, র‌্যাবের ডিজি, সকলে উচ্চপদস্থ ব্যক্তি, মহামতি। তাই উনাদের কথা অনেক দামি তবে তা অনেক সময় হানি করে সেকথাও আমরা জানি। রাজা বন্ধুকে বললেন উৎকৃষ্ট খাবার রান্না করতে, বন্ধু জিহবা রান্না করলেন। রাজা কারণ জানতে চাইলে বন্ধু বললেন;জিহবা ভাল ভাল কথা বলে মায়া-মমতা বাড়ায় ফলে জগৎ সুন্দর হয় তাই জিহবা উৎকৃষ্ট। রাতে রাজা নিকৃষ্ট খাদ্য খেতে চাইলেন, বন্ধু ফের জিহবা পরিবেশন করলেন। রাজা কারণ জানতে চাইলেন বন্ধু বললেন, জিহবা মিথ্যা ও কটু কথা বলেই মানুষে মানুষে দ্ব›দ্ব লাগায় ফলে যুদ্ধ হয় এবং পৃথিবী নরক হয়। রাজা বুঝলেন বন্ধু তাঁকে জ্ঞান দিচ্ছেন ফলে তিনি বন্ধুকে শূলে তুলার নির্দেশ দিলেন। দেখা যাচ্ছে কথার যেমন মূল্য হয় কোটি টাকা তেমনি তা কখনো আবার হয়ে যায় গলার কাঁটা, অতএব কথা থেকে সাবধান। তবে লিখা হতে সাবধান হওয়ার দরকার নাই, নির্বাচন কমিশনের সমাধানটা লিখার জন্য বলবৎ থাকুক। চার্লস ডিকেন্সের মতো শব্দ প্রতি ১৫ ডলার না হোক ১৫ টাকা অন্তত হোক, আমি কিন্তু লোভী না হাহাহাহা।
লেখক : কলামিস্ট