কখন পাওয়া যাবে সেই নিরাপদ সড়ক! প্রয়োজন আইনের কঠোর প্রয়োগ ও সচেতনতা

2

 

সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনার লাগাম যেন টানাই যাচ্ছে না। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মৃত্যুও কোলে ঢলে পড়ছে অসংখ্য মানুষ। সেই সাথে বিষাদ আর সারা জীবনের কান্না ভর করছে ভুক্তভোগী পরিবারের উপর। ঘটনার প্রকাশ, গত বুধবার হাটহাজারি সড়কে একটি দ্রæতগামী বাস দুইজন শ্রমিককে ধাক্কা দিলে তাৎক্ষণিক তারা মৃত্যুবরণ করেন। এ ঘটনায় আরো একজন আহত হন। এর আগে চট্টগ্রাম কক্সবাজার সড়কে একটি বেপরোয়া পিকআপ পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে একজন মোটর সাইকেল আরোহীকে হত্যা করে। চট্টগ্রামের বাইরে গত শনিবার ময়মনসিংহের ত্রিশালে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাকে বাসের ধাক্কায় একই পরিবারের চারজনসহ সাতজন নিহত এবং ১০ হন আহত হয়েছেন। সেদিন অন্য কয়েকটি স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন আরও ছয়জন। এদিকে গত এক সপ্তাহে বিভিন্ন সংবাদপত্রে দেশের নানা স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় অন্তত ২৩ জনের প্রাণহানির খবর রয়েছে। বস্তুত সড়ক দুর্ঘটনা পরিণত হয়েছে নিত্য ঘটনায়। আর এতে প্রাণ হারানো ছাড়াও অনেকে পঙ্গু হয়ে কাটাচ্ছেন তাদের বাকি জীবন। প্রাণ হারানো বা পঙ্গু হওয়া লোকটি যদি পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তি হয়ে থাকেন, তাহলে সেই পরিবারটির অবস্থা কী হয়, তা সহজেই অনুমেয়। প্রকৃতপক্ষে সড়ক দুর্ঘটনা শুধু একটি দুর্ঘটনাই নয়, এর আর্থিক ক্ষতি বিপুল। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে সড়ক দুর্ঘটনা এবং এর প্রভাবে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। এসব দুর্ঘটনার কারণে বছরে জিডিপির ২ থেকে ৩ শতাংশ হারাচ্ছে দেশ। কাজেই সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করতে হবে যে কোনো উপায়ে। গবেষণায় আরও দেখা গেছে, ৯০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী যানবাহনের অতিরিক্ত গতি এবং চালকের বেপরোয়া মনোভাব। মহাসড়কে অপরিকল্পিত স্পিডব্রেকার বা গতিরোধকগুলোও দুর্ঘটনার জন্য অনেকাংশে দায়ী। এছাড়া ত্রæটিপূর্ণ যানবাহন, সড়কের পাশে হাটবাজার বসা, চালকদের পর্যাপ্ত বিশ্রামের অভাব ইত্যাদি কারণেও দুর্ঘটনা ঘটছে। মহাসড়কে যান চলাচলের সর্বোচ্চ গতি বেঁধে দিয়ে এবং গতি পরিমাপক যন্ত্র ব্যবহার করে চালকদের ওই নির্দিষ্ট গতি মেনে চলতে বাধ্য করা হলে দুর্ঘটনা অনেক কমে আসবে বলে মনে করি আমরা। তাছাড়া চালকদের দক্ষতার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে। মহাসড়ক নির্মাণ ও সংস্কারের কাজটি করতে হবে সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী। যত্রতত্র গতিরোধক নির্মাণ রোধে নিতে হবে কার্যকর ব্যবস্থা। অভিযোগ আছে, অনেক পরিবহণ মালিক চালকদের পর্যাপ্ত বিশ্রামের সুযোগ দেন না। ক্লান্ত-শ্রান্ত চালক গাড়ি চালালে স্বভাবতই তাতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
আশা করা হয়েছিল, নিরাপদ সড়কের দাবিতে বিশেষত শিক্ষার্থীদের দেশ কাঁপানো আন্দোলনের পর সড়কে নিরাপত্তা ফিরবে। বাস্তবে তা হয়নি। আমরা মনে করি, এই আইন বাস্তবায়ন করতে হলে মূলে হাত দিতে হবে। বিআরটিএ স্বচ্ছ হলে সড়ক-মহাসড়কে নৈরাজ্য প্রায় কমে আসবে। হয়রানি, অনিয়ম ও নানামাত্রিক দুর্নীতির কারণে অনেকে এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হন। আধুনিক, মানসম্পন্ন ও নিরাপদ সড়ক পরিবহন যেকোনো দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকেও গতিশীল করে। পরিবহন খাত এখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আঞ্চলিক যোগাযোগ ছাড়াও আন্তর্জাতিক অনেক বিষয় এখন পরিবহনে যুক্ত। তাই সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং এজন্য সময়ের ধারাবাহিকতায় সড়ক পরিবহন আইনে যে বিষয়গুলো সংযোজিত হয়েছে, তার কঠোর বাস্তবায়ন জরুরি মনে করছি। সড়কে মৃত্যুর মিছিল আর যেন দীর্ঘ না হয়। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় সবরকম ব্যবস্থা নিতে হবে। দায়ীদের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনার কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে নানা ধরনের পরামর্শ ও সুপারিশ করা হলেও তা যে অরণ্যে রোদনে পর্যবসিত হচ্ছে, দেশে প্রতিদিন ঘটা সড়ক দুর্ঘটনাগুলোই এর বড় প্রমাণ। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আইনের প্রয়োগ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ চালক এবং সড়কে চলাচল উপযোগী ভালো মানের যানবাহন অবশ্যই প্রয়োজন। তবে একইসঙ্গে জনগণকেও হতে হবে সচেতন।