ওহীদুল আলম এভাবে যাওয়ার কথা ছিল না

27

সৈয়দ উমর ফারুক


বয়স ৮৭ হয়ে গেছে, তারপরও নগরীর বিভিন্ন সড়কে দৃপ্তপদে হেঁটে চলেন তিনি। সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবী, পায়ে পাম্সু আর মাথায় দশ বছরের পুরনো ধূসর ছাতা নিয়ে প্রতিদিনই তিনি ছুটেন আত্মীয়-স্বজন কিংবা পরিচিতদের বাসায়। খবরাখবর নেন, পথ চলতে দুর্বলতা কাটাতে এক গøাস চিনির শরবত আর একটি বেলা বিস্কুট খেয়ে দুপুর পর্যন্ত হাঁটেন তারপর বাসায় এসে নিজের হাতে ঘামে ভেজা কাপড়গুলো ধুয়ে শুকিয়ে নেন। মৃত্যুর পূর্বদিন পর্যন্ত এ ছিল তার রুটিন কাজ। তিনি খুব ভোরে পবিত্র কোরান তেলওয়াত করে প্রাতঃরাশ শেষ করে যখন কোন গন্তব্য ঠিক করে যাত্রা শুরু করেন, স্বাভাবিকভাবে সে গন্তব্যে যেতে যেখানে আধ ঘণ্টা সময় লাগে সেখানে তাঁর ক্ষেত্রে লাগত দু’ঘণ্টা। স্কুল-কলেজে চৌত্রিশ বছর শিক্ষকতা করেছেন। তাঁর ছাত্ররা ‘দেশের মাথা’ হয়ে ওঠেছেন, অথচ ‘স্যার’-কে দেখলেই গাড়ি থেকে নেমে পদধূলি নিতে কেউ ভুল করতেন না। অনেকে তাদের গাড়িতে তুলে ‘স্যার’-কে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করতেন। কিন্তু কখনো রাজি হননি তাতে। তিনি কখনো রিক্সায় চড়েননি, বলতেন মানুষ হয়ে আমি কিভাবে মানুষের কাঁধে চড়ব। কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক হয়ে তিনি ছাত্রদের যে শিক্ষা দিয়েছিলেন সে সময় সবাই তা মনে রেখেছিল বলেই কলেজিয়েটের ছাত্ররা দেশের সম্পদ হয়ে ওঠেছিল।
মুসলিম শিক্ষক হয়েও ওহীদুল আলমের পদধূলি নিতেন হিন্দু-বৌদ্ধ ছাত্ররা, কদমবুচি দেন মুসলিম শিক্ষার্থীরাও। মৃত্যুর পূর্বদিন পর্যন্ত এমন সম্মান উপভোগ করেছেন ফতেয়াবাদের নামকরা মৌলভী নছিহউদ্দিনের কনিষ্ঠপুত্র ওহীদুল আলম। শিক্ষক হিসাবে তাঁর পৃথক চিন্তা-ভাবনা ছিল, বাসায় পড়ানো কিংবা কোচিং করাকে তিনি মোটেই পছন্দ করতেন না। কলেজিয়েট স্কুলে তখন বড় বড় সরকারি কর্মকর্তাদের সন্তানরা লেখাপড়া করত। আমি দেখেছি সে সময়ে স্বয়ং চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ওহীদুল আলমের বাসায় এসে তাঁর ছেলেকে ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্য শেখাবার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁকেও ‘না’ বলেছিলেন। পেশার প্রতি দায়িত্বশীলতা ও অর্থের প্রতি লোভ না থাকায় তিনি কখনো মানসিক অশান্তিতে ভোগেননি। তিনি আমৃত্যু সুস্থ শরীর নিয়েই বেঁচেছিলেন। তবে ১৯৯৮ সালের ২৪ জানুয়ারি ফতেয়াবাদে এক সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে পরলোকে চলে যান তিনি। এটা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য যে, তাঁর আহত হওয়ার ঘটনা পরিবার থেকেই গোপন রাখা হয়েছিল। সেজপুত্র বধূ ছোট বোন ও ভগ্নিপতিকে নিয়ে হাসপাতালে দেখে আসলেও শ্বশুড়ের আহত হওয়াটা তেমন গুরুত্ব দেননি। এদিন ছিল সেজপুত্রের বিবাহ বার্ষিকী। ফলে একপ্রকার বিনা চিকিৎসায় নিভে গেল সমাজের এই বাতিটি।
রোজার দিনে সেহেরি খেয়ে ঘুমাতে গিয়েছিলাম একটু দেরিতে। ভোর সাতটায় গেইটের বেল বেজে ওঠল। বুঝতে পারলাম নানার আগমন ঘটেছে। দ্রæত পদে ঘর থেকে বেরিয়ে সম্ভাষণ জানালাম নানাকে। স্বভাবজাত ভাবেই ঘরে ঢুকতে ঢুকতেই গলা ছেড়ে গেয়ে ওঠলেন সেই প্রিয় রবীন্দ্র সংগীতের দু’টি চরণ ‘কী পাইনি তার হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজি’। আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘নাতি এবার একশ নিছি’। অর্থাৎ তিনি শতবর্ষ পূরণ করবেন। কে জানতো তাঁর এই স্বপ্ন পূরণ হওয়ার নয়। বাড়ি যাওয়ার পথে সিএনজি টেক্সীর আঘাতে আহত হয়ে হাসপাতালের বিছানায় একাকী মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে চিরবিদায় নিলেন। তাঁর চারপুত্র ছিল। বড়পুত্র জ্ঞান গরিমায় ভারি হওয়ায় ঢাকায় থাকতেন সপরিবারে। বাবা-মা যে বার্ধক্যের ঝুঁকিতে পড়ে গেছেন সে খবর রাখার সময় তিনি পাননি। সন্তান সমেত পার্থিব জীবন তিনি উপভোগ করেছেন। এনজিও’র উপদেষ্টা হয়ে ভুলে গেছেন স্বজনদের দুঃখ-দুর্দশা। মেজ ছেলে বুলগেরিয়া হয়ে সে-ই যে আমেরিকায় গেলেন আর ফিরলেন না। মা প্রয়াত হয়েছেন। খবর নিলেন না তাঁর অন্তিম যাত্রার। সেজ ছেলে কলেজে পড়তেই দুর্ঘটনায় চোখ হারিয়েছেন। দুর্বল স্বাস্থ্যের জন্য আয়ের তেমন উৎস নেই। স্ত্রীর পরামর্শের বাইরে যেতে পারেননি তিনি। ছোট ছেলে শিল্পী হলেও ছন্নছাড়া। সোলস প্রতিষ্ঠার সময় সে কঙ্গু বাজাতো এই ব্যান্ড দলে। ইংরেজি সাহিত্যে তুখোড় হলেও সঙ্গদোষে পথ হারিয়েছে সে। নানা সোফায় বসে এসব বলে কখনো অশ্রæসজল হন, কখনো রবীন্দ্র সংগীত গেয়ে শান্ত করেন অশান্ত মন। আমি বারণ করেছিলাম এই বয়সে একাকী বাসে চড়ে ফতেয়াবাদ যাওয়া উচিৎ হবে না। তবুও দৃঢ়পদে বেরিয়ে গেলেন বাসা থেকে। আমি দোতলা থেকে তাকিয়ে রইলাম তাঁর দিকে। আমার এই দেখাই যে নানার সাথে শেষ দেখা হবে কখনো কল্পনাই করিনি। নিরোগ স্বাস্থ্যের অধিকারী ওহীদুল আলম গর্ব করে বলতেন ‘আমার হার্টের রোগ নেই, প্রেশার নেই, ডায়াবেটিক নেই, ফ্যাটি লিভার নেই, রোগ আমার কাছে আসতে ভয় পায়’। সত্যি তা-ই, মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত কোন রোগই তাঁর শরীর স্পর্শ করতে পারেনি।
কলেজিয়েট স্কুল চট্টগ্রামের সেরা স্কুল। ডিসি-এসপিসহ গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কর্মকর্তাদের সন্তানরা এ স্কুলে পড়ত। শ্রেণিকক্ষে ওহীদুল আলমের পাঠদান ছিল রসাস্বাদনের ক্লাশ। চোখ রাঙানি নেই, বড় শব্দে শাসন করা নেই। নদীর ¯্রােতের মতো সাবলীল ভঙ্গিতে তাঁর পাঠদান ছিল বড়োই আকর্ষণীয়। ছাত্ররা তাই ওহীদ স্যারের ক্লাশ বাদ দিত না। তিনি যখন এই স্কুল থেকে বিদায় নিচ্ছিলেন তখন তাঁর সংবর্ধনাটা ছিল মনোমুগ্ধকর। সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী এই বিদায় সংবর্ধনায় গানের আয়োজন করেছিলেন নবম শ্রেণির ছাত্র সোলস’র প্রতিষ্ঠাতা সাজেদুল আলম, দশম শ্রেণির ছাত্র সোলস’র ড্রাম বাদক রনী বড়–য়া আরেকজন দশম শ্রেণির ছাত্র সোলস’র বেইজ গীটারিস্ট শাহেদুল আলম। (তখনও সোলস গঠিত হয়নি, ‘এই অনুষ্ঠানের পর পরই সাজেদুল আলমের বাসায় সুরেলা নামে ব্যান্ডদলের জন্ম হয় যা পরবর্তীতে ‘সোলস’ নাম ধারণ করে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ওঠে)। তাঁর বিদায় সংবর্ধনায় তিনি ‘আমার যাওয়ার সময় হলো দাও বিদায়’ গানটি গেয়ে ছাত্র-শিক্ষকদের অশ্রæসজল করেছিলেন। আমি তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। নানার এই বিদায় সংবর্ধনায় আমিও ভারাক্রান্ত হয়েছিলাম। কারণ টিফিন ছুটির পরের ক্লাশ যদি অংকের ক্লাশ থাকত তাহলে আমি নানার কাছ থেকে ছুটি নিয়ে বাসায় চলে আসতাম।
ওহীদুল আলম যেমন শিক্ষক হিসাবে সমাজে সমাদৃত হয়েছেন তেমনি কবি হিসাবে হয়েছেন সাংস্কৃতিক পরিমÐলের নক্ষত্র। তিনি যে কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গেলে অন্য কোন অতিথি কথা বলার সাহস পেতেন না। তিনি নানা বিষয়ে পÐিত ছিলেন। আলোচনা সভার বিষয়বস্তু থেকে বেরিয়ে গান ও কবিতা পাঠ করে এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ তৈরি করতেন। সমাজ যাতে কলুষিত না হয় তিনি বিভিন্ন ধর্ম থেকে বাণী শুনিয়ে শ্রোতাদের আলোকিত করতেন। মূলত: ওহীদুল আলম ছিলেন বহুমাত্রিক জ্ঞানের পÐিত। তিনি মুসলিম ধর্মাবলম্বী হলেও গৌতম বুদ্ধকে শ্রদ্ধা করে তাঁর বাণীগুলো একাকী বাসায় বসে আবৃত্তি করতেন।
তিনি অত্যন্ত সৎ জীবনযাপন করতেন। পেনশনের টাকা, আজাদী-পূর্বকোণে কলাম লেখার সম্মানি আর বই বিক্রি করে খরচ চালাতেন। তিনি কখনো তাঁর পুত্রদের কাছ থেকে নিজ খরচের জন্য একটাকাও নেননি। বরঞ্চ সেজপুত্র কাজীর দেউরীতে চলে আসার পর তিনি নিয়মিত বাজার করে দিতেন। সেজপুত্র কখনো কাঁচাবাজারে গেছেন কীনা আমরা দেখিনি। বড় আদরে লালন-পালন হওয়ায় বাজারের দায়িত্ব তার কাঁধে পড়েনি। মেজ ছেলেতো মা-বাবার সুখে-দুঃখে কখনো অংশীদার হননি। কোন খোঁজখবরও নেননি।
সবাই বলে কবি জসিমউদ্দিনের সত্যিকার উত্তরাধিকারী ছিলেন কবি ওহীদুল আলম। তাঁর ‘কর্ণফুলীর মাঝি’ পাকিস্তান আমলে সুধী সমাজে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল। ভাইপো শিল্পী সবিহ উল আলম কী নিপুণ কলমের টানে অঙ্গসজ্জা করেছিলেন এই সময়ে এসেও আমি অবাক হই। ভাবতে পারো অবাক লাগে এই কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদ, মুদ্রণ, বাইন্ডিং এবং স্কেচ সর্বকালের সেরা হয়ে আছে। ১৯১১ সালের ১ জানুয়ারি জন্ম নেয়া সমাজের এই আলোকিত মানুষটি সারাজীবন সাধনা করে যে পথ রচনা করে গেছেন তাঁর সন্তানরা না হোক আমরাতো সে পথে হাঁটতে পারি। কারণ এই পথই ‘সেরাতুল মুস্তাকিম’।
ওহীদুল আলম ছিলেন নীরব জ্ঞানতাপস। নিষ্পাপ, নিরীহ, নিরহংকারী এই মানুষটি সজ্ঞানে কাউকে মনে কষ্ট দেননি। আমি দেখেছি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তৎকালীন শিক্ষক ও বহু জনপ্রিয় গানের গীতিকার অধ্যাপক আবু হেনা মোস্তফা কামাল প্রায় সময় বিকালে তাঁর বাসায় এসে ‘স্যার’কে কদমবুচি করে পাশে বসে সাহিত্যের নানা বিষয় নিয়ে আলাপ করতেন। তাঁর আলমবাগে আরো আসতেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. আবদুল করিম, বাংলার অধ্যাপক চৌধুরী জহুরুল হক, চট্টগ্রাম কলেজের বাংলার অধ্যাপক, কবি আ.ফ.ম সিরাজউদদৌলা, ড. শামসুল আলম সাঈদ, গবেষক মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর। নিয়মিত আড্ডা দিতেন তাঁর সহপাঠি ও বামপন্থী নেতা অধ্যাপক আসহাবউদ্দিন। এছাড়া তাঁর মেজভাই সাহিত্যিক মাহবুব উল আলম প্রাতঃভ্রমণ শেষ করে বাসায় ফেরার পথে একবার আলমবাগের গেইটে ঢুকে ছোটভাই ওহীদুলের সাথে নানা বিষয়ে আলাপ করতেন। একইভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, ইউজিসি’র সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নানও দুপুর বেলায় বাসায় ফেরার পথে তাঁর বাসায় এসে কুশল বিনিময় করতেন। মৌলভী পুত্রের আধুনিক ধ্যান-ধারণা ও জ্ঞানের গভীরতার কারণে ওহীদুল আলম সর্ব মহলে সমাদৃত হয়েছিলেন। মহান আল্লাহ্ পবিত্র কোরানে বলেছেন ‘তোমরা মা-বাবার প্রতি যেমন আচরণ করবে তোমাদের সন্তানরাও তোমাদের প্রতি তেমন আচরণ করবে’। ¯্রষ্টার এই বাণী এখন দৃশ্যমান।
লেখক : সম্পাদক- দৈনিক বীর চট্টগ্রাম মঞ্চ