ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ যুগে যুগে বাঙালিকে অনুপ্রেরণা যোগাবে

59

অ্যাড. সালাহউদ্দিন আহমদ চৌধুরী লিপু

৭ মার্চের রোববার বেলা ৩.২০ ঘটিকার সময় শুভ্র পাঞ্জাবি ও পাজামা আর হাতাকাটা কালো কোর্ট পরে দৃপ্ত পায়ে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানের মঞ্চে এসে মাইকের সম্মুখে দাঁড়ান মুক্তিকামি বাঙালির আরধ্যধন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তখন জনসভায় উপস্থিত দশ লাখ লোকের গগণ বিদারি শ্লোগান আর মুহূর্মুহূর করতালিতে মুখরিত হয়ে ওঠে সমগ্র রেসকোর্স ময়দান। এরপর তিনি আরম্ভ করেন তাঁর ঐতিহাসিক বক্তৃতা। মাত্র ১৮ মিনিটের এই অলিখিত ভাষণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে তুলে আনেন অন্যন্য উচ্চতায়। ১২৪১ শব্দের কবিতায় জড়িয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর প্রাণের আবেগ। এই কালজয়ী ভাষণে রয়েছে বাঙালির শত সহস্র বছরের প্রত্যাশার প্রাণের স্পন্দন। বঙ্গবন্ধুর শব্দচয়ন, বাক্য বিন্যাস ও মূল বক্তব্য পর্যলোচনা করলে সে কথাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই ভাষণ যেমনি সারগর্ভ, ওজস্বী ও যুক্তিযুক্ত তেমনি তির্যক, তীক্ষè ও সাবলীল বাচনভঙ্গি। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে রয়েছে অনেক বৈশিষ্ট্য এবং শক্তিশালী ও বহুমাত্রিক প্রভাব। ভাষণটি ছিল যেমন প্রেরণাদায়ী তেমনি কালজয়ী। এ ভাষণ একটি জাতি, জনগোষ্ঠির মুক্তির কালজয়ী সৃষ্টি এক মহাকাব্য। বঙ্গবন্ধুর এই মহাকাব্যের কোনো পান্ডুলিপি নেই। ঐতিহাসিক ৭ মার্চ বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় একটি দিন। বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠের এই ভাষণে ও তার সঠিক নির্দেশনায় বীর বাঙালি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে উজ্জীবিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি ছিল শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অলিখিত, স্বতঃস্ফুর্ত যা এই ভাষণকে বিশেষ বৈশিষ্ট্যমÐিত করেছে। জানা মতে, পৃথিবীর কেনো দেশে এত দীর্ঘ সময় ধরে কোনো নেতার ভাষণ সে দেশের মানুষ শ্রবণ করে আসছে তাঁর কোন নজির নেই। এটি এমনি ব্যঞ্জনাপূর্ণ ও গীতিময় যে, যতবার শ্রবণ করা হয়, ততবারই শুনার ইচ্ছা জাগে। এই ভাষণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু অনানুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান এবং দেশের আপামর মানুষকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতির প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। সর্বাধিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত পৃথিবীর হিংস্রতম সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে নিরস্ত্র বাঙালিকে ‘যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে’ ঝাঁপিয়ে পড়ার তার অমোঘ নির্দেশ যেন সব মারণাস্ত্ররের চেয়েও অধিক শক্তিশালী। নাতিদীর্ঘ ভাষণে উজ্জীবিত হয়ে একটি জাতি পশুশক্তির বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার শপথ নিয়েছিল। ভাষণের এসব দিক তথা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের দায়িত্ববোধের প্রকাশ ছিল সবার নজর কাড়ার মতো। বঙ্গবন্ধু ছিলেন বহুমুখি গুণের অধিকারি এবং অত্যন্ত মেধাবী ও বিচক্ষণ। তাঁর রাষ্ট্রচিন্তা ও রাজনৈতিক দর্শন অসাধারণ। নানা দিক হতে চাপ থাকা সত্বেও সেদিন তিনি সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি।
তিনি তাঁর ভাষণে স্বাধীনতার কথা এমনভাবে উচ্চারণ করেন, যাতে দেশের মানুষ সেটিকে ঘোষণা হিসেবে দেখে, কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার অভিযোগ উত্থাপন করা সম্ভব না হয়। বলা বাহুল্য, যদি এমনটি হতো, তাহলে তিনি বিচ্ছন্নবাদী হিসেবে চিহ্নিত হতেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের সূদুরপরাহত হতো। এমন সুপরিকল্পিত ও হৃদয় উৎসারিত ভাষণের উদাহরণ বিশ্ব ইতিহাসে আর একটিও খুজে পাওয়া যাবে না। ভাষণটি মুহূর্তের মধ্যে একটি নিরস্ত্র জাতিকে সশস্ত্র জাতিতে পরিণত করে তোলে। সেদিন সব বাঙালি জাতিকে নজিরবিহীনভাবে ঐক্যবদ্ধ করে এবং স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল। যা বাঙালির মুক্তির সনদ। এ ভাষণটি আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে একদিকে যেমন ছিল শত্রæর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহবান, অন্যদিকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে বাঙালিদের অধিকার আদায়ের প্রচেষ্টা, গণতান্ত্রিব মূল্যবোধ, অসাম্প্রদায়িক আদর্শ ও সম্প্রীতি।
বঙ্গবন্ধুর অন্যন্য ভাষণটি কালের যাত্রার ধ্বনি হয়ে মহাকালের পানে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। যা ছিল আমাদের হৃদয়ে গাঁথা তা আজ বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। শুধু বাঙালির জন্যই নয়, বিশ্ব মানবতার জন্যও অবিস্মরণীয়, অনুকরণীয় এক মহামূল্যবান দলিল বা সম্পদ। এই ঐতিহাসিক ভাষণ শুধু বাংলাদোশের মানুষদের হৃদয়কেই নাড়া দেয়নি, সারাবিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এ ভাষণ পৃথিবীর একাধিক ভাষায় মুদ্রণ হয়েছে। ২০১৭ সালে জতিসংঘের ইউনোস্কোর প্যারিসে অনুষ্ঠিত তাদের দ্বিবার্ষিক সন্মেলনে ৭৮টি দলিল মনোনয়ন দেয়া হলে তৎমধ্যে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ, যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিংকনের পেনসিলভানিয়া রাজ্যের গেটিসবার্গে ১৮৬৩ সালের ১৯ নভেম্বর প্রদত্ত বিশ্ববিখ্যাত এবঃঃুংনঁৎম অফফৎবংং মাত্র দুই মিনিটের ভাষণ ‘গভর্নমেন্ট অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল। যেটি তৎকালিন গৃহযুদ্ধ বিদীর্ণ যুক্তরাষ্ট্রের ভাগ্য নির্ধারণী বক্তব্য হিসেব বিবেচিত হয়ে থাকে এবং অপরটি যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদী নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের ও যধাব ধ ফৎবধস যে বক্তব্যের মাধ্যমে একটি জাতির আজন্ম লালিত স্বাধীনতার স্বপ্নের যে রূপরেখা তৈরি হয়েছিল, যা ইতিহাসে সম্ভবত অদ্বিতীয়। বিশ্বের বিখ্যাত ১৪ জন বিশেষজ্ঞ সদস্যবৃন্দের পর্যালোচনারক্রমে জতিসংঘের ইউনোস্কো এই তিনটি ভাষণকে চুড়ান্ত মনোনীত করে। ঐ বছরের ৩০ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে ‘ডড়ৎষফ উড়পঁসবহঃধৎু ঐবৎরঃধমব বা বিশ্ব ঐতিহ্য দলিল’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সংস্থাটির ওহঃবৎহধঃরড়হধষ সবসড়ৎু ড়ভ ঃযব ড়িৎষফ যবৎরঃধমব-এ অন্তর্ভুক্ত করেছে। জাতিসংঘের মতো বিশ্ব সংস্থার এ সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক ঘটনা ও বঙ্গবন্ধুর মহান কীর্তির অন্যন্য স্বীকৃতি। এটি বাঙালি জাতির জন্য এক সুমহান গৌরবের। এর ফলে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সারাবিশ্বকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সমানভাবে আলোড়িত করবে। আজ বিশ্ববাসির কাছে প্রতিয়মান হয়েছে, ৭ মার্চের ভাষণ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষণ। কারণ এ ভাষণের মাধ্যমে তিনি সমগ্র জাতিকে জাতীয় মুক্তির মোহনায় দাঁড় করিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক দিকনিদের্শনা দিযেছেন। এই স্বীকৃতির মাধ্যমে যুগান্তকারি এই ভাষণ নিজেদের পাশাপাশি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস সম্পর্কে বিশ্ববাসির মধ্যে নতুন করে জানার আগ্রাহ সৃষ্টি করবে। মানবজাতির বিকাশের পথ-পরিক্রমায় স্বাধীনতাকামি জাতিকে এই ভাষণটি সর্বদা অনুপ্রাণিত করবে ও সাহস যোগাবেএবং তা যুগে যুগে বাঙালি জাতিকে অনুপ্রেরণা যোগাবে। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ও সার্বিক মুক্তিসংগ্রামের বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই ভাষণটি নিপীড়িত মানুষকে দেখাবে মুক্তির পথ। এই ঐতিহাসিক ভাষণ কেবল বাঙালি জাতির নয়, বিশ্ববাসির জন্য অনুপ্রেরণার চিরন্তন উৎস হয়ে থাকবে।

লেখক : কলামিস্ট, রাজনীতিক