একের খোঁজে মিলল ২৪

22

নিজস্ব প্রতিবেদক

গত ১৫ মার্চ দিবাগত রাত ১২টা। সিটি কর্পোরেশনের হেলদি ওয়ার্ডের তকমা লাগানো জামালখানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এলাকা প্রেসক্লাব ভবনের সামনের ‘সুরক্ষিত’ পার্কিং অনেকটাই ফাঁকা। সেখান থেকে চোখের পলকেই হাওয়া হয়ে যায় চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ম. শামসুল ইসলামের মোটরসাইকেল। ক্লাব ভবনের প্রবেশপথে দায়িত্বরত প্রহরীর চোখ ফাঁকি দিলেও চুরির এই দৃশ্য ‘গোপন চোখের’ নজরদারি এড়াতে পারেনি। থানায় মামলার পর সেই গোপন চোখে ধারণকৃত ফুটেজের সূত্র ধরে তদন্তে নামে পুলিশ। একের খোঁজে নেমে পুলিশ দশদিনের মাথায় নগরী ও সন্দ্বীপ থেকে ২৪টি চোরাই মোটরসাইকেলসহ চোরচক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। পুলিশ বলছে, দেশের ইতিহাসে এক অভিযানে এত বেশি সংখ্যক চোরাই মোটরসাইকেল জব্দের ঘটনা এটাই প্রথম।
চোরাই মোটরসাইকেলের সবচেয়ে বড় ‘চালান’ জব্দের পর গত ২৬ মার্চ দুপুরে সিএমপির দক্ষিণ জোনের উপ-কমিশনারের (ডিসি) কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনের হাজির হন পুলিশের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। ডিসি মোস্তাফিজুর রহমান ছাড়াও একই জোনের এডিসি নোবেল চাকমা, এসি অতনু চক্রবর্তী, কোতোয়ালী থানার ওসি জাহিদুল কবিরসহ অভিযানে অংশ নেয়া পুলিশ সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। অভিযানে যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তারা হলেন, লোহাগাড়ার আমিরাবাদ এলাকার বাসিন্দা মিটন ধর (২৯) ও খোরশেদ আলম (২৯) এবং সন্দ্বীপের বাবর ওরফে বাবুল (৩৫), শাহেদ (২৬) ও রিপন (৪০)। গত ২৬ মার্চ তাদেরকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তাদের কাছ থেকে জব্দকৃত ২৪টি চোরাই মোটরসাইকেলের মধ্যে গত ১৫ মার্চ দিবাগত রাতে প্রেসক্লাবের পার্কিং এলাকা থেকে চুরি হওয়া সাংবাদিক ম. শামসুল ইসলামের মোটরসাইকেলটিও রয়েছে। তবে তার পক্ষকাল আগে গত ২৮ ফেব্রæয়ারি এম আজিজ স্টেডিয়ামের জিমনেসিয়াম চত্বরের মসজিদের সামনে থেকে চুরি যাওয়া প্রেস ক্লাবের প্রচার সম্পাদক খোরশেদুল আলম শামীমের মোটর সাইকেলটির হদিস মিলেনি। পুলিশের দাবি, তার মোটরসাইকেলটিও এই চক্রের সদস্যরাই চুরি করেছে বলে জিজ্ঞাসাবাদে তারা তথ্য পেয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনে ডিসি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, সম্প্রতি নগরী ও আশপাশের বিভিন্ন স্থানে বেশকিছু মোটরসাইকেল চুরির ঘটনা ঘটেছে। যেগুলোর বিষয়ে বিভিন্ন থানায় মামলাও হয়েছে। এর মধ্যে কোতোয়ালি থানায় মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগে মামলা করেন সিইউজের সাধারণ সম্পাদক ম. শামসুল ইসলাম। অন্যান্য মামলার পাশাপাশি এটির তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ মোটরসাইকেল চোরচক্রের হোতা মিটন ধরের সন্ধান পায়। তার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে চক্রের অপরাপর সদস্যদের সন্ধান মেলে। মোটরসাইকেল চুরির মামলায় ইতিপূর্বে দুই দফায় হাজতবাস করা মিটনের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে কোতোয়ালি থানা পুলিশ দ্বীপ উপজেলা স›দ্বীপের স্থানীয় পুলিশের সহায়তায় অভিযান চালায়। সেখান থেকে একে একে ২৩টি চোরাই মোটরসাইকেল জব্দ করা হয়। মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হওয়ায় চোরচক্র চোরাই মোটরসাইকেলগুলো সেখানে নিয়ে নম্বর প্লেট পরিবর্তন করে স্থানীয় লোকজনের কাছে কম দামে বিক্রি করে। সেখানকার বাসিন্দাদের কাছে মোটরসাইকেল অন্যতম বাহন। এমনকি স্থানীয় প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করে গণপরিবহন হিসেবেও সেখানে এই দ্বিচক্রযানটি ভাড়ায় চলে।
ধরপাকড়ের পরও মোটরসাইকেল চুরি থামছে না কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে ডিসি মোস্তাফিজ বলেন, আসলে নোয়াখালী, হাতিয়া ও পাবর্ত্য চট্টগ্রামসহ অপেক্ষাকৃত দুর্গম এলাকাগুলোতে চোরাই মোটরসাইকেলের অবাধ চলাচল রয়েছে। এই কারণে ওসব অঞ্চলে এগুলোর চাহিদা রয়েছে। গণমাধ্যম কর্মীসহ আমরা সবাই মিলে যদি চোরাই মোটরসাইকেলের চাহিদা ও অবাধ চলাচলের জায়গায় কিছু করতে পারি, তাহলে এটা অটোমেটিক্যালি বন্ধ হয়ে যাবে।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) নোবেল চাকমা বলেন, মূলত মিঠন ও খোরশেদ মিলে সুবিধামত জায়গা থেকে টার্গেট করা মোটরসাইকেল চুরি করে। প্রেসক্লাবের সামনের সিসি ক্যামেরার ফুটেজের সূত্র ধরে তাদের শনাক্ত করার পর গত ২৫ মার্চ সকালে পুরাতন স্টেশন এলাকা থেকে মিঠন ও বাবরকে একটি চোরাই মোটরসাইকেলসহ আটক করা হয়। পরে জিজ্ঞাসাবাদে মিটন বিভিন্ন মোটরসাইকেল চুরির তথ্য দেয় এবং সেগুলোর অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত জানায়। মিটন ও খোরশেদ বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ায়। সুবিধাজনক স্থানে রাখা কারও মোটরসাইকেল তাদের কাছে থাকা মাস্টার চাবি দিয়ে খুলতে পারলে সেটি তারা চালিয়ে নিয়ে চলে যায়। যেসব মোটরসাইকেল তারা চুরি করে, সেগুলো বাবরের কাছে ১০/১৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে। হাতবদল হয় পুরাতন স্টেশন ও ফৌজদারহাট টোল রোড এলাকায়। আর বাবর ওইসব মোটরসাইকেল কুমিরা অথবা বাঁশবাড়িয়া ঘাট দিয়ে ট্রলারে করে সন্দ্বীপ নিয়ে শাহেদ ও রিপনসহ আরও কয়েকজনের কাছে বিক্রি করে। সন্দ্বীপের আকবর হাট এলাকায় শাহেদের একটি মোটরসাইকেল গ্যারেজ আছে। তিনি বাবরের কাছ থেকে কম দামে চোরাই মোটরসাইকেল কিনে নিয়ে নম্বর প্লেটসহ কিছু জিনিস পাল্টে বিভিন্ন জনের কাছে বিক্রি করেন। এই অভিযানে সন্দ্বীপ থেকে জব্দকৃত ২৩ মোটরসাইকেলের মধ্যে ১১টিই মিলেছে শাহেদের গ্যারেজে।
কোতোয়ালি থানার ওসি জাহিদুল কবির বলেন, এ চক্রটি গত কয়েক বছরে অনেক মোটরসাইকেল চুরি করেছে। চোরচক্রের হোতা মিটন এবং বাবর এর আগে আরও দু’বার পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে এবং প্রত্যেকের বিরুদ্ধে মোটরসাইকেল চুরির মামলা রয়েছে। মোটরসাইকেল জব্দের ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা করেছে। এর বাইরে চুরির ঘটনায় পৃথক আরও দুটি মামলায় তাদেরকে গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করা হবে।