একটি সুশীতল বটবৃক্ষের নাম বাবা

45

মুহাম্মদ এনামুল হক মিঠু

শুধু দুটি অক্ষরে গঠিত বাবা শব্দটির মর্মার্থ এত বিশাল যে, তা কোনো ভাষায় আবদ্ধ করা যায় না। বাবা মানেই একটি হিম ছায়ার বটবৃক্ষ। বাবা তো সেই জন, যার হাত ধরে শেখা যায় জীবনে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে ও কীভাবে উঠে দাঁড়াতে হয়, কীভাবে স্বপ্ন পূরণের দুর্গম পথে পাড়ি দিতে হয়।
সন্তানের জন্য পরম আদর্শ আর নির্ভরতার অন্য নাম বাবা। তিনি ছায়া হয়ে আমাদের আগলে রাখেন আমৃত্যু। বাবাদের ভালোবাসা মায়ের মতো প্রকাশিত হয় না। নিজের সুখ বিলিয়ে দিয়ে তাঁরা সন্তানের সুখ কেনেন। কাউকে না জানিয়ে নিজে কষ্ট করে শুধুমাত্র পরিবারের সবার মুখে হাসি ফোটাতেই বাবারা থাকেন সদা ব্যস্ত। অথচ, জীবনের পড়ন্ত বিকেলে আমাদের বিশিষ্ট শিল্পী নচিকেতার সুরে সেই বাবারা মনে একবুক চাপা কষ্ট নিয়ে অনেকটা বাকশক্তিহীন হয়ে আত্ম চিৎকার দিয়ে বলেন:
“ছেলে আমার মস্ত মানুষ,মস্ত অফিসার, মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার আর ওপার। নানান রকম জিনিস আর আসবাব দামী, সবচেয়ে কম দামী ছিলাম একমাত্র আমি। ছেলের আমার, আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম,আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম—
সেই আদরের সন্তানের কাছে হয়ে ওঠেন বোঝা , বাড়তি ঝামেলা। এমনকি শেষ আশ্রয়স্থল হয় বৃদ্ধাশ্রম ! আচ্ছা, আপনি কি কখনো ভেবেছেন যে আপনাকে বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে হবে ? উত্তর অবশ্যই হবে, না ! বৃদ্ধাশ্রম মূলত বৃদ্ধদের আশ্রয়স্থল বা আবাসস্থল! এর উৎপত্তি সম্ভবত অসহায় দরিদ্র সহায়-সম্বলহীন, সন্তানহারা বৃদ্ধদের শেষ জীবনে বিশেষ সেবা নিশ্চিত করার জন্য। কিন্তু বর্তমানে এর সংজ্ঞা পুরোপুরি ভিন্ন। এখন বৃদ্ধাশ্রমগুলো হলো পরিবার–পরিজন থেকে বৃদ্ধ পিতা-মাতার পৃথক নিবাস বা আশ্রয়ের নাম। সন্তানদের অবহেলা অবজ্ঞার কারণে সেই বাবাটি মনে নিদারুণ ব্যথা নিয়ে নিঃশব্দে বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে বৃদ্ধাশ্রমকে বেছে নেন। যাহা কখনও কাম্য নয়।
মহান আল্লাহ পৃথিবীতে তাঁর সৃষ্টিকে পাঠিয়ে দেন বাবা নামক মানুষের কাছে। বাবা তার সন্তানের ভরণপোষণ, ইচ্ছা, আশা-আকাক্সক্ষা, ভালো-খারাপ সকল দিক দেখভাল করার নিঃস্বার্থ দায়িত্ব পালন করে থাকেন। এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিজের সুখ, ইচ্ছা, আশা-আকাক্সক্ষা , ভালোলাগা, পছন্দের সবকিছু হাসি মুখে নির্দ্বিধায় বিসর্জন দিতে সামান্যতম কুণ্ঠাবোধ ও করেন না। তার বিপরীতে আমরা এটাও দেখেছি, চট্টগ্রামে অবসরের টাকার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে দ্ব›েদ্ব বাবার লাশ দাফন আটকে রেখেছে সন্তানরা। ঘটনাটি ঘটেছে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার বড়উঠান ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কেরানী বাপের বাড়িতে, যাহা সন্তান হিসেবে লজ্জাবোধ হওয়া দরকার।।
সন্তানকে জিতিয়ে দেয়ার জন্য বাবা হারতেও রাজি থাকেন সবসময় । সন্তানের সুখই যেন বাবার সুখ। সারাদিন কর্ম ব্যস্ততা শেষে বাড়ি এসে সন্তানের মুখে হাসি দেখলে নিমিষেই তার সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। বাবা মানে উত্তপ্ত রৌদ্রে মাথার উপর বটবৃক্ষের ছায়া, বাবা মানে আকাশ সমান মায়া। “বাবা” শব্দটি উচ্চারণ করলে মনটা কোমল হয়ে ওঠে। এ যেন আস্থায় উচ্চারিত এক প্রিয় শব্দ। বাবার ভালোবাসার কাছে পৃথিবীর সকল ভালোবাসা ম্রিয়মাণ হয়। তাই বাবার কথা মনে হলে আনমনে বলি : বাবা আমায় দেখাত যে সত্য পথের আলো , বাবা আমায় বুঝিয়ে দিতো মন্দ আর ভালো । দেখলে বিপদ ঝাপিয়ে পরে আমার প্রিয় বাবা, আসুক যত ঝড় বাদল কিংবা কালো থাবা ।
আমরা জানি, একজন বাবার যদি দশটি সন্তানও থাকে, তাদের সমানভাবে দেখেন এবং অর্থনৈতিক দিক দিয়ে চরম দুঃখে থাকলেও সন্তানদের নিয়ে হাসিখুশির মাধ্যমে জীবন যাপন করেন। কিন্তু সে দশটি সন্তান যখন বড় হয়, তাদের কাছে বাবা মায়ের জায়গা হয় না, যাহা সেই সন্তান হিসাবে আমাদের চরম লজ্জা থাকা উচিত। অনেক সময় দেখা যায়, কোনো কোনো সন্তানের স্ত্রীরা শশুর শাশুড়ীদেরকে নিয়ে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে একসাথে বসবাস করতে চাই না। ঠিক ঐ মুহুর্তে তারা ভুলে যায় যে তারাও একদিন শাশুড়ি হবে তারা তাদের স্বামীকে নিয়ে একা থাকতে চাই। কিন্তু, তারা বুঝে না ঐ স্বামীটিকে আল্লাহর সৃষ্ট পৃথিবীটা দেখিয়েছেন ঐ শ্বশুর শাশুড়িই। এসব স্বার্থবাদী স্ত্রীদের প্রাকৃতিক অবলীলায় অনুরূপভাবে তাদের কর্মফল ভোগ করতে হয়।
আমাদের বাবারা শুধু দিয়ে যাচ্ছেন, কখনো পাওয়ার আশা করেন না। কখন কি প্রয়োজন তা বলতে হয় না, তিনি নিজে থেকেই সময়ের আগে তা নিয়ে আসেন। আমি একজন মধ্যবিত্ত, আদর্শবান ও সেরা বাবার কথা বলছি। সন্তানকে ভালো রাখার জন্য বাবা নামক মানুষটি সীমাহীন কষ্ট করে যান প্রতিনিয়ত । লক্ষ করে দেখুন, মাথার ঘাম পায়ে ফেলা এই মানুষটি দিন রাত এক করে খেয়ে না খেয়ে পরিশ্রম করেন শুধুমাত্র সন্তানের সুখের জন্য। কখনো ভালো কিছু তিনি গলাধঃকরণ করেন না, সন্তানের জন্য রেখে দেন, সন্তান খেলে তাতেই তার মন ভরে, পেট ভরে। এমন বাবারা ঈদের দিনে নতুন বস্ত্রে নিজেদের আবৃত করেন না, পুরনো বস্ত্রেই মুখে তৃপ্তির হাসিতে ঈদের মতো নানা উৎসবের দিন পার করে দেন। কারণ, সন্তানকে খুশি করতে নতুন পোশাক কিনে দিতে পেরেছেন। অর্থাৎ সন্তানকে খুশি করতে পেরেছেন। দুপুরে খাবার না খেয়ে টাকা বাঁচিয়ে সন্তানের জন্য মজার কিছু নিয়ে আসেন। কারণ একটাই, সন্তানের মুখের হাসি দেখা। বাবারা কোনো কোনো সময় “চোখ বন্ধ ক..রো” বলে কখনো জাদুকরী সারপ্রাইজ দেয়। একজন বাবার তৃপ্তি এখানেই যখন সন্তানরা মন ভরে হাসে। কখনো নিজের জন্য আনা প্যাকেটটি খুলে দেখায় তার সন্তানের জন্য এনেছেন। সন্তান মানুষ করতে বহু কষ্ট, ত্যাগ-তিতিক্ষা করে থাকেন। একজন আদর্শ বাবাই হোন এমন মহৎ হৃদয়ের অধিকারী।
সন্তান যখন দীর্ঘদিন অসুস্থ হয়, আর বাবা যদি চাকরিজীবী হয়, সন্তানকে চিকিৎসার জন্য ছুটি নিতে নিতে একসময় অফিসে চরম বদনামের ভাগিদার হয়ে অবশেষে চাকরি হারায়। সুস্থ হওয়ার পর সন্তানরা যখন বড় হয় সে সন্তানপাগল বাবাটাকে কতটুকু মনে রেখেছেন ? বাবা যখন অসুস্থ কিংবা কোনো কারণে সাময়িক কিংবা দীর্ঘসময়ের জন্য চলাফেরায় অক্ষম হয় তখনও বাবার মাথায় একটা কাজ করে, আর সেটা হলো তাঁর সন্তান ভালো আছে কিনা !! সন্তান যতক্ষণ পর্যন্ত লেখাপড়া শেষ করে ভালো কোনো ব্যবসা বা চাকরী করছেন না, ঠিক ততক্ষণ পর্যন্ত মাথায় অনেক চাপ থাকে যে সন্তানকে কিভাবে ভবিষ্যতের জন্য দাঁড় করিয়ে দিবেন। সে বাবার প্রতি আমরা সন্তানেরা কতটুকু দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি?
আমরা খবরে জেনেছি, রাজশাহীর বাঘায় নিখোঁজ সন্তানের জন্য ৩ দিন ধরে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে বাবা-মা কান্নাকাটি করছেন। বাবার হাতে ছেলের ছবি। বাকপ্রতিবন্ধী যুবক লিটন হোসেন (৩০) ১১ মার্চ ২০২২ আড়ানী বাজার থেকে হারিয়ে গেছে। নিখোঁজ লিটন হোসেন বাঘা উপজেলার আড়ানী পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের গোচর গ্রামের আকরাম আলীর পুত্র। ছেলে নিখোঁজের পর থেকে পাগল প্রায় বাবা-মা। ছেলের সন্ধানে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে কান্নাকাটি করে বেড়াচ্ছেন। রাস্তায় যাকে পাচ্ছেন তার কাছে ছেলের সন্ধানের অনুরোধ করেছেন। একইভাবে বাবা যখন বৃদ্ধাশ্রমে কিংবা হারিয়ে যায় তখন বর্তমান সন্তানেরা বাবা-মাকে তেমন দরদ দিয়ে খোঁজার বা বৃদ্ধাশ্রম থেকে নিয়ে আসার প্রবণতা দৃশ্যমান নয় ।
সকালে সূর্যের আলো যেভাবে তার দীপ্তি ছড়ায় বিকেলে সেভাবেই তা হ্রাস পেতে থাকে। মানব জীবনটা ও সেই সূর্যের মতো, জীবনের শুরুতে রঙিন হলে ও জীবন সায়াহ্নে তা ক্রমশ সাদামাটা হতে থাকে। একটা সময় বাবারা বৃদ্ধ হতে থাকে সন্তানরা বড় হতে থাকে। তখন তাদের ভালোবাসা শৈশবকালের মতো প্রকাশ পায় না। তাতে কি ভালোবাসা কমে যায়? না, বরং তা সুপ্ত অবস্থায় থাকে। বাবাদের মনের চাপা কষ্ট পরিবারের কেউ কি একবার বুঝার চেষ্টা করেছেন ?
ছোট বেলায় সামান্য অসুখ হলেও বাবা পেরেশানিতে থাকতেন, ওষুধ এনে দিতেন সেবা যতœ করে সুস্থ করে তুলতেন। সেই বাবা যখন বৃদ্ধ হবে তখন প্রত্যেকটা সন্তানের কর্তব্য হবে বাবার সেবা যতœ করা। ঠিক যেমনটা সন্তানের জন্য বাবা করে ছিলেন। সন্তানের কটুকথায় বাবার মনে কষ্ট আসলে সেই সন্তান কখনো বড় কিছুতে সফল হতে পারে না।
আবার সন্তানের কাজে খুশি হয়ে বাবা দোয়া করলে সন্তান সফল হলে বাবার মুখে হাসি ফোটে। বাবা কেমন আছেন সেটা জিজ্ঞেস না করে সন্তানের উচিত বাবাকে ভালো রাখার দায়িত্ব নেয়া। বাবার মন কি চায় তা জেনে বাবার মন ভালো রাখার দায়িত্ব নেয়া, বাবাকে ভালোবেসে পরিবারের সবাই মিলে সুখে শান্তিতে থাকা। বাবার সন্তুষ্টিতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টি নিহিত। ইহকাল ও পরকালের সফলতার জন্য আসুন বাবার সন্তুষ্টি অর্জন করি। এটাই হোক প্রতিটি সন্তানের প্রত্যাশা ।
লেখক: কলামিস্ট