উপমহাদেশে প্রথম হাদীসচর্চার বিদ্যাপীঠ

23

শেখ বিবি কাউছার

সাহাবারা হলেন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সহযোদ্ধা ও বাণীর ধারক। যাঁরা শান্তি ও কল্যাণ, সাম্য, ন্যায়বিচারের বাণী নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছিলেন দেশ- দেশান্তরে ও উড্ডয়ন করেছিলেন সাম্য, ন্যায়বিচার ও মানবিকতার পতাকা।
সাহাবার পরের প্রজন্ম তাবেঈন। তার পরের প্রজন্ম তাবে-তাবেঈন। যারা নবীজীর সত্যজ্ঞান ধারণ করে গড়ে তুলেছিলেন এক আলোকোজ্জ্বল সভ্যতা। আর সেই সত্যজ্ঞান আহরণের ফসল হলো হাদীসের লিখিত রূপ।
তবে আপনি কি জানেন, আমাদের উপমহাদেশে প্রথম হাদীস চর্চার বিদ্যাপীঠ গড়ে উঠেছিল তৎকালীন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁওয়ে।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর পর থেকে বাংলাদেশে যে সকল সুফী সাধক,ধর্ম প্রচারক ও আধ্যাত্মিক সাধক এসেছেন তার মধ্যে ইয়েমেনের অধিবাসী শেখ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা (রহ:) ছিলেন অন্যতম। সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের আমলে ১২৭৭ সালে তিনি দিল্লিতে আসেন।এসেই অবস্থান নেন ছোট্ট এক মসজিদের পাশে । কোনো বাসভবন ছিল না তাঁর, খুপরি ঘরে থাকতেন। বছরের পর বছর ইতেকাফে রত থাকতেন আর ইলম পিপাসুদের মাঝে রুহানি মধু বিলাতেন । তিনি সপ্তাহে একদিন ধর্ম ও সংস্কৃতি নিয়ে আমজনতার উদ্দেশে কথা বলতেন। এ দিনটিতে সারা দিল্লি ভেঙে পড়ত তাঁর মহল্লায়। রাজা, রাজপুত্র থেকে নিয়ে ভিখারি, সর্বহারা সকলেই ধূলির আসনে সাম্যের জলসায় বসে যেতো। তিনি রাজাদেরও ভুল ধরিয়ে দিতেন; তাদের করণীয় নির্দেশ করতেন। আমির-নবাবদের উচ্চাবিলাসের সমালোচনা করতেন; দেখাতেন সুপথ। কারো ভালোলাগা-মন্দলাগার কোনো পরোয়াই ছিল না তাঁর।
দিল্লিতে বসবাসের কয়েক বছরের মধ্যে তিনি হয়ে উঠেন ভারতের শীর্ষ আলেমে দ্বীন। তাঁর জনপ্রিয়তা ও প্রভাবশালী বক্তব্যের প্রতাপ এতোটাই শক্তিশালী ছিল যে, এক ঘোষণায় তিনি দিল্লির রাজসিংহাসন গুঁড়িয়ে দিতে পারতেন। অথচ তিনি ছিলেন একেবারেই দুনিয়াবিমুখ।
মামলুক সুলতান প্রথম নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহ (রাজত্বকাল ১২৪৬ – ১২৬৫) তাঁর প্রতি কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাননি। তার মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী উলুঘ খান বলবন (রাজত্বকাল ১২৬৬ – ১২৮৭) সুলতান গিয়াসুদ্দিন নাম ধারণ করে রাজ্যের শাসনক্ষমতা গ্রহণ করলে তিনি বিত্তহীন দ্বীন এই ফকিরের সর্বব্যাপী প্রতাপকে সাম্রাজ্যের জন্য ঝুঁকি মনে করে আতঙ্কিত হলেন। অতঃপর তাঁকে কৌশলে নির্দেশ দিলেন দিল্লি ত্যাগের। সুলতান গিয়াসুদ্দিনের নির্দেশে বিনাবাক্য ব্যয়ে তিনি বেরিয়ে পড়লেন নিরুদ্দেশে। হাজার হাজার অনুসারী তাঁর পিছু নিল; ছদ্মবেশী সুলতান গিয়াসুদ্দিন বলবনও সামিল হলেন সে কাফেলায়।
একসময় উত্তেজিত অনুসারীগণ তাঁর চারপাশে ভিড় করল। ছদ্মবেশধারী সুলতান তাদের হয়ে আওয়াজ তুললেন, ‘আপনি আদেশ দিন, আজই আমরা আগুন লাগিয়ে দিব বলবনের সিংহাসনে।
অনুসারীগণ সমস্বরে চীৎকার দিয়ে বলল, ‘তা-ই হবে! আমরা আপনাকে ক্ষমতায় বসাব, অথবা আপনি যাঁকে চান তাঁকে।’
এবার আবু তাওয়ামা সুস্থির, ধীর স্বরে বললেন- ‘থামো! আমি আল্লাহর এক ইচ্ছা থেকে অন্য ইচ্ছার দিকে যাচ্ছি।’
‘আমি, আমরা এমন নই; যাদেরকে আঘাত করলে প্রতিশোধ নেয়।
হ্যাঁ, বিদ্রোহ করো সেই চরিত্রের বিরুদ্ধে, যে চরিত্রের কারণে তোমরা এক আবু তাওয়ামার জন্য এক সাম্রাজ্যকে বিরান করতে চাও।…
আমার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ো না। উদ্বিগ্ন হও সেই ভ্রষ্টতার বিরুদ্ধে; যা তোমাদের ও তোমাদের শাসকদের দায়িত্বহীন করে রেখেছে।
তিনি ঘোষণা দিলেন, ‘ক্ষমতা আমরা চাই না। যখন চাইতে থাকব, তখন আমরা আর আমরা থাকব না। ক্ষমতাকে সুপথে চালানোর চেষ্টা আমাদের। দিল্লিতে থাকতে এটা (রাজ্য) যেমন চলেছে, দূরে গেলেও চলবে। আমি চললাম। তোমরা ফিরে যাও। দিল্লি ও দিল্লির সুলতানের জন্য দোয়া থাকবে আমার।’
খোদাভীরু জাহেদের প্রকৃত অবয়ব নিজ চোখে দেখে ছদ্মবেশি সুলতান গিয়াসুদ্দিন বলবন অপরাধবোধ আর লজ্জায় মাটির সাথে নুয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি ছদ্মবেশ ত্যাগ করে সশ্রদ্ধ নিবেদন করলেন-
‘শায়খ! আমিই সুলতান বলবন। আমি অন্যায় করেছি। দিল্লি আপনার, ফিরে আসুন আমাদের মাঝে।’
মুহাদ্দিস আবু তাওয়ামা কিন্তু ফিরলেন না। তিনি সুলতান ও জনগণকে হিতোপদেশ দিয়ে বিদায় জানালেন, আর তিনি চললেন বাংলা অভিমুখে।
১২৭০ থেকে ১২৭৭ খ্রিস্টাব্দের কোনো একসময়ে শায়খ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা সোনারগাঁয়ে (মোগড়াপাড়া দরগাবাড়ি প্রাঙ্গণে) উপনীত হন, এবং এখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের সংকল্প করেন।
সোনারগাঁও আসার সময় তাঁর সঙ্গে আসেন বন্ধু ইয়াহিয়া মানেরির ছেলে শরফুদ্দিন ইয়াহইয়া মানেরি। বাবার বন্ধুর আধ্যাত্মিক শক্তি ও অসাধারণ ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়ে শিষ্যত্ব গ্রহণে আগ্রহ প্রকাশ করেন।
অতঃপর প্রিয় শিষ্য শরফুদ্দিন ইয়াহইয়া মানেরিকে দিয়ে শুরু করেন ভারতভূমিতে ইলমে হাদিস চর্চার প্রথম বিদ্যাপীঠ। গড়ে তোলেন সমৃদ্ধ একটি মাদ্রাসা ও খানকা।
সেখানে গুরুর নিদের্শে সাধনা করে লাভ করেন শরফুদ্দিন ইয়াহহিয়া মানেরি। সোনারগাঁওয়ে ও আশেপাশের এলাকায় তিনি ছড়িয়ে দেন ইসলামের শান্তির অমীয় বাণী।
শায়খ শরফুদ্দিন আবুতাওবামা শুধু আরবি শিক্ষা নয় আরো বহু বিষয় যেমন ভাষা ও সাহিত্য, রসায়ন শাস্ত্র, চিকিৎসাবিজ্ঞান ইত্যাদি পড়ানোর ব্যবস্থা করেন। কোনো বিষয় ছিল না; যা এখানে পড়ানো হতো না।ফলে তাঁর প্রতিষ্ঠানগুলো দেশ বিদেশের শিক্ষার্থীর জ্ঞানশিক্ষার কেন্দ্র হয়ে ওঠে। এখানে সুদূর বোখারা, কান্দাহার, খোরাসান, সিরিয়া, ইয়েমেন, বিহার ও দাক্ষিণাত্য থেকে ছুটে আসেন শিক্ষার্থীরা। ধারণা করা হয়, তখন এ বিদ্যাপীঠের ছাত্রসংখ্যা ছিল দশ হাজার। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বিশ্বকোষ মতে, তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিদ্যাপীঠ থেকেই উপমহাদেশে প্রথম ইলমে হাদিসের আনুষ্ঠানিক শিক্ষাদান শুরু হয়।
সময়ের ব্যবধানে এটি কেবল বিদ্যাপীঠই থাকেনি, হয়ে উঠেছিল সমাজ-রাজনীতির শোধনাগার। তাঁর ছিল নিজস্ব নৌবাহিনী, প্রবল ও অপ্রতিরোধ্য বাহিনী। ছাত্ররা ইলমচর্চার পাশাপাশি ছিল বাংলার জনগণের নিরাপত্তার আমানতদার। ‘বাংলার ধর্মজীবনের শুদ্ধি ও সুরক্ষা, সাংস্কৃতিক সচেতনতা, স্বাধীনতা ও জাতীয় সংহতি রক্ষা, হিন্দু-মুসলিম স¤প্রীতি, হানাদারদের প্রতিরোধ ইত্যাদি বিষয়ে নির্ভরতার কেন্দ্র ছিল এই বিদ্যাপীঠ। দীর্ঘ ২৩ বছর ইলমের খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন মুহাদ্দিস শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা। পাশাপাশি জনসাধারণের আত্মশুদ্ধির মানসে একটি খানকাও (আশ্রম) প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন সোহরাওয়ার্দি তরিকার পীর।
মুহাদ্দিস আবু তাওয়ামা ‘মানজিলে মাকামাত’ নামে অধিবিদ্যা (তাসাওফ) সম্বন্ধে একটি কিতাব লিখেছিলেন বলে জানা যায়।
এ ছাড়াও সোনারগাঁ বিদ্যাপীঠে অবস্থানকালে শায়খ ছাত্রদের উদ্দেশে আইনশাস্ত্রবিষয়ক যেসব বক্তৃতা দিয়েছেন, সেগুলোর সংকলন নিয়ে ফারসি ভাষায় রচিত ‘নামায়ে হক’ নামে একটি কাব্যগ্রন্থের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এ গ্রন্থে ১৮০টি কবিতা আছে। কেউ কেউ তা ‘মসনবি বনামে হক’ নামে অভিহিত করেছেন।
গ্রন্থটি ১৮৮৫ খ্রিষ্টীয় সনে বোম্বে (বর্তমান মুম্বাই) থেকে এবং ১৯১৩ অব্দে কানপুর থেকে প্রকাশিত হয়। জানা যায়, শায়খ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামার লিখিত পাÐুলিপি ব্রিটিশ জাদুঘরের আর্কাইভ ভবনে রক্ষিত আছে। মহান এই সাধক ১৩০০ খ্রিস্টাব্দে সোনারগাঁয়ে দেহত্যাগ করেন। সোনারগাঁওয়ের মোগড়াপাড়ায় তাঁর মাজার অবস্থিত।
হাদিসশাস্ত্রের সঙ্গে এ অঞ্চলের সম্পৃক্ততার সাক্ষী হয়ে আছে অসংখ্য প্রতœতাত্তি¡ক নিদর্শন। সেগুলোর মধ্যে শায়খ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা (রহ.)-এর প্রতিষ্ঠিত বিদ্যাপিঠের ধ্বংসাবশেষ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ঐতিহ্যবাহী সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রায় সবকিছুই কালের গর্ভে বিলিন হয়ে গেলেও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে চুন-সুরকির গাঁথুনির প্রধান ফটকটি। যদিও যতেœর অভাবে তা এখন জরাজীর্ণ।
ইতিহাস সমৃদ্ধকারী ঐতিহ্যবাহী ও স্মৃতিবিজড়িত এই প্রতœতাত্তি¡ক নিদর্শনটির কোনো সংস্কার বা রক্ষণাবেক্ষণের ব্যস্ততা করা গেলে সুন্দর একটি পর্যটন কেন্দ্র হতে পারে। আর হয়ে উঠতে পারে হাদিসশাস্ত্রবিদদের গবেষণার কেন্দ্রস্থল।

লেখক : প্রভাষক, নোয়াপাড়া ডিগ্রি কলেজ