ইসলামি চেতনার বিকাশ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

808

অধ্যক্ষ কাযী আবুল বয়ান হাশেমী

বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- একটি নাম। একটি ইতিহাস। বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রটির সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িয়ে রয়েছে এই নামটি। বহুমুখী কর্মক্ষমতারর অধিকারী এ মানুষটির সকল প্রকার মানবীয় গুণ-ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দান করার পাশাপাশি একজন মুসলিম হিসেবে তাঁর ইসলামপ্রীতি ছিল অতুলনীয়। আলেম-ওলামাদের সাথে সম্পর্ক এবং তাদের প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি ছিলো স্বভাবসুলভ। ধর্মকে কখনো তিনি রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে নয়, একটি সুন্দর ও আদর্শ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। একজন মুসলিম হিসেবে শুধু মুসলমানদের সঙ্গে নয়, সকল ধর্মের সকল মানুষের সঙ্গে সু-সম্পর্ক বজায় রেখেছেন তিনি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান ছিলেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত ‘ইসলাম ও বঙ্গবন্ধু’ গ্রন্থে’ বলা হয়েছে ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর পূর্বপুরুষ দরবেশ শেখ আউয়াল হযরত বায়জীদ বোস্তামি (র.)-এর সঙ্গী হিসেবে বাগদাদ থেকে এ বঙ্গে আগমণ করেছিলেন। পরবর্তীতে তাঁরই উত্তর পুরুষেরা বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় বসতি স্থাপন করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন ইসলাম প্রচারক শেখ আউয়ালের সপ্তম বংশধর। বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমান ছিলেন একজন সূফি ও ইসলামের প্রচার ও প্রসারের অন্যতম ধারক। তিনি শামসুল হক ফরিদপুরীর খলিফা ছিলেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে পাকিস্তান বেতার ও টেলিভিশনে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “আমাদের ইসলাম হযরত রাসূলে করিম (স:)-এর ইসলাম, যে ইসলাম জগতবাসীকে শিক্ষা দিয়েছে ন্যায় ও সুবিচারের অমোঘ মন্ত্র। ইসলামের প্রবক্তা সেজে পাকিস্তনের মাটিতে বারবার যারা অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ-বঞ্চনার পৃষ্ঠপোষকতা করে এসেছেন আমাদের সংগ্রাম সেই মুনাফিকদের বিরুদ্ধে।” বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে মাওলানা শেখ উবায়দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদীর কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ শুরু হয়েছিল। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জেলখানা থেকে মুক্ত হয়ে দেশে এসে সর্বপ্রথম ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমি বাঙ্গালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান। মুসলমান দুইবার মরে না একবারই মরে। বাংলাদেশকে সব ধর্মের সব মানুষের জন্য শান্তির দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে তিনি ছিলেন সদা সচেষ্ট। বঙ্গবন্ধুর স্বল্পকালীন শাসনামলে দেশ ও জাতির সার্বিক কল্যাণার্থে গৃহীত নানামুখী পদক্ষেপগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং ভৌত অবকাঠামোগত পদক্ষেপ যেমন ছিল, তেমনি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি ও মূল্যবোধের বিষয়াদি বিবেচনায় রেখে তিনি ইসলামের প্রচার-প্রসারে গ্রহণ করেছিলেন বাস্তবভিত্তিক ও কার্যকরী নানা ব্যবস্থা। তিনি যেমন একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের মহান স্থপতি, তেমনি বাংলাদেশে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলামের প্রচার-প্রসারের স্থপতিও তিনিই। এ দুটি অনন্য সাধারণ অনুষঙ্গ বঙ্গবন্ধুর জীবনকে দান করেছে উজ্জ্বল মহিমা। তিনি তাঁর সংক্ষিপ্ত সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে ইসলামের স¤প্রসারণ, ইসলামী মূল্যবোধ প্রচার-প্রসারে যে সীমাহীন অবদান রেখে গেছেন, তা সমকালীন মুসলিম দুনিয়ার ইতিহাসে অনন্য দৃষ্টান্তহয়েই থাকবে চিরকাল। এ ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু ইসলাম শিক্ষা সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠান ও মুসলমান সম্পর্কীয় বিষয়গুলোর ওপরই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব ও মনোযোগ দিয়েছেন। ইসলাম সম্পর্কে গবেষণা, প্রচার-প্রসার ও এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সামগ্রিক জীবনকে মহান ধর্ম ইসলামের কল্যাণময় গ্রোতধারায় সঞ্জীবিত করার লক্ষ্যে ১৯৭৫ সালের ২২ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক অধ্যাদেশ জারি করে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। বঙ্গবন্ধু ইসলামী শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং এর সফল প্রচার-প্রসারের জন্য মাদ্রাসা বোর্ড পুনর্গঠন করে এই শিক্ষাবোর্ডের প্রথম চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়েছেলেন বিশ্বস্ত সহচর মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশকে। বঙ্গবন্ধু দেশের দায়িত্বভার গ্রহণের পরই তাঁর কাছে অভিযোগ এসেছিল, ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসাসহ আলেম-ওলামারা মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে। সে কারণে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু এ কথা শুনে ঢাকা আলিয়া মাদরাসার মাঠে শিক্ষকদের নিয়ে বসে বিস্তারিত জানলেন। এরপর তাৎক্ষণিকভাবেই তিনি মাদ্রাসা-ই-আলিয়া খুলে দেয়ার নির্দেশ দেন এবং মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতি সন্তুষ্ট হয়েই মাদ্রাসা বোর্ডের অনুমতি দিয়েছিলেন। বর্তমানে এমপিওভুক্ত এসব আলিয়া মাদ্রাসার সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার। প্রসঙ্গক্রমে একটি কথা উল্লেখ না করলেই নয়; জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে যেভাবে ভালোবাসতেন বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তা লালন করেন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি মাদরাসা শিক্ষার্থীদেরও সমান সুযোগ সৃষ্টির পক্ষে সেখানে আলীয়া মাদরাসা তথা ওলামা-মাশায়েখ বিদ্বেষী এক শ্রেণীর রাজনীতিক ও আমলাদের যোগসাজশে বারবার মাদরাসা পড়ুয়াদের সুযোগ-সুবিধা সংকোচনের মাধ্যমে জাতিরজনকের নীতি ও আদর্শের বিপরীতে অবস্থান নিতে দেখা যায়। অবিভক্ত বাংলার তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা একে ফজলুর হক ১৯৩৭ সালে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (আলীয়া নেসাবের মাদরাসাসহ) শিক্ষকদের জন্য ভাতা চালুর যে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সেই অনুদান শতভাগে উন্নীত করে জাতীয় গ্রেডভূক্ত করেছেন এবং পৃথক মাদরাসা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ভৌত অবকাঠামো ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নয়ন করে যাচ্ছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একান্ত ইচ্ছায় ঢাকায় “ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়” নামকরণ করে একটি এফলিয়েটিংসহ পরিপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে দেশের আলেম-ওলামাদের বড় একটি অংশে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে স্বাধীনতার বিপক্ষে ভূমিকা পালন করলেও উল্লেখযোগ্য একটি অংশ মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে এই অধ্যায়টি বরাবরই আড়ালে থেকে গেছে। জাতীয় পর্যায়ে আলোচনায় স্থান না পেলেও চট্টগ্রামের অনেক মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের গবেষক ও লেখকের লেখায় আমার শতবর্ষী আব্বা হুজুর ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা কাযী মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম হাশেমী মু.জি.আ এর সক্রিয় ভূমিকার কথা তুলে ধরেছেন। ঐ সময়কার তাঁর সহযোগী হিসেবে হালিশহরের মাওলানা ইলিয়াছ, ফটিকছড়ির মাওলানা মুহাম্মদ মিয়া প্রকাশ তলোয়ার বাংলা, মাওলানা আব্দুর রহমান আলকাদেরী, মাওলানা সৈয়দ নুরুল মুনাওয়্যার প্রমুখ আলেম-ওলামার নাম প্রণিধানযোগ্য। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তার জন্য আমার মুহতরাম পিতা তদানীন্তন দেশের একদল স্বনামধন্য আলেম-ওলামাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সত্তর লক্ষ টাকার ফান্ড তৈরি এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের হাতে হস্তান্তরের কথা ইতিহাসের কোথাও স্থান না পেলেও এই ঘটনার জ্যান্তসাক্ষী দু’জন যথাক্রমে আওয়ামীলীগের নেতা তোফায়েল আহমদ এবং ভোলার অশীতিপর মাওলানা আবু সাঈদ এখনও বেঁচে আছেন। ঐ ফান্ড তৈরির উদ্যোক্তাদের অন্যতম ছিলেন পাকিস্তান আমলের রাষ্ট্রায়াত্ব প্রতিষ্ঠান ইসলামী একাডেমীর এবং স্বাধীনতাত্তোর বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া ইসলামিক ফাউন্ডেশনে বঙ্গবন্ধুর নিয়োগকৃত প্রথম মহাপরিচালক মৌলভী আবুল হাশিম, ঢাকা হাই কোর্ট মাজারের খতিব হাফেজ মাওলানা মঈনুল ইসলাম, সিলেটের মাওলানা এমদাদুল্লাহ ও মাওলানা হরমজুল্লাহ, বরিশালের মাওলানা ফজলুল করিম প্রমুখ।
বঙ্গবন্ধু বাঙালি মুসলমানদের সমাজ জীবনে ইসলামী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় যেসব অবদান রেখেছেন, পাকিস্তান সরকারের ২৪ বছরে এর এক ভাগও সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কাকরাইল মসজিদের জন্য জায়গা প্রদান, টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমার জন্য সরকারি জমি প্রদান করেন এবং ইজতেমার পরিধি আরো বড় করেছিলেন। বাংলার মাটিতে একজন রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (দ:) অনুষ্ঠানের উদ্বোধন প্রথম বঙ্গবন্ধুই করেন। তিনি ১৯৭৩ সালে সর্বপ্রথম দেশের হকপন্থী আলেম সমাজ কর্তৃক ‘সীরাত মজলিশ’ গঠন করে প্রথম পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (দ:) মাহফিল উদযাপনের এক ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। জিন্নাহর নেতৃত্বাধীন কথিত ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশে মদ, জুয়া, লটারি এসব ইসলাম বিরোধী কাজ আইনগতভাবে বৈধ ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরের সরকার দেশ পরিচালনার সময় আইন পাস করে মদ, জুয়া, লটারি প্রভৃতি ইসলামবিরোধী কার্যকলাপ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছিলেন।
ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা গোড়দৌড় প্রতিযোগিতা বন্ধ করেই ক্ষান্ত হননি, রেসকোর্স ময়দানের নাম পরিবর্তন করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নামকরণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। এ ছাড়া ধর্মীয় দিবস হিসেবে শবে বরাত, শবে কদর ও ঈদে মিলাদুন্নবী (দ:) উপলক্ষে সরকারি ছুটি ঘোষণাও বঙ্গবন্ধু সরকারই করেছিল। বেতার ও টিভিতে কোরআন তিলাওয়াত ও তরজমা পেশের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু।
‘ব্যক্তিগত জীবনে বঙ্গবন্ধু সেসময় প্রখ্যাত আলেম ওলামাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতেন। তৎকালীন প্রায় সব বিজ্ঞ আলেম-ওলামার সাথে বঙ্গবন্ধুর হৃদ্যতা ছিল। আলেম ওলামাদের সাথে হৃদ্যতার ফলে বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে সৃষ্টি হয়েছিল ইসলামের প্রতি এবং পীর আউলিয়াদের প্রতি গভীর অনুরাগ। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু ইরাক সফরকালে বাগদাদে গাউছে আজম আব্দুল কাদের জিলানী (রাঃ) এর মাজার যেয়ারত করতে দেখা যায় অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে। মাজার কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত গিলাফটি বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত যতœসহকারে দেশে এনে সংরক্ষণ ও সমগ্র মুসলিম মিল্লাত ঐ গিলাফ থেকে বরকত হাসিলের জন্য জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে তাঁরই নিয়োগকৃত প্রথম খতীব ও সরকারি ঢাকা আলীয়া মাদরাসার হেড মাওলানা মুফতিয়ে আজম আল্লামা সৈয়দ আমিমুল এহসান (রাঃ) হাতে হস্তান্তর করেন। ছৈয়দ মুফতি সাহেবও তা মসজিদে সুন্দরভাবে বাঁধাই করে এক পাশে প্রতিস্থাপন করেছিলেন । সৌভাগ্যক্রমে ঐ হস্তান্তর অনুষ্ঠানে মুফতি সাহেবের স্নেহধন্য ছাত্র আমার আব্বা হুজুর ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা কাযী মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম হাশেমী উপস্থিত ছিলেন। আল্লামা শাসমসুল হক ফরিদপুরী বঙ্গবন্ধুর আধ্যাত্মিক সূত্রে দাদা ছিলেন। তিনি যখন লালবাগ মাদরাসার মুহতামিম, তখন বঙ্গবন্ধু ঢাকার রাজনীতিতে তরুণ নেতা। সপ্তাহে কয়েকবার দাদা হুজুরকে দেখতে তিনি লালবাগে যেতেন। ফলে ফরিদপুরী হুজুরের সমসাময়িক অনেক আলেমকে তিনি দাদাজি বলে সম্বোধন করতেন। তাঁদের সঙ্গে সুগভীর এক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল বঙ্গবন্ধুর। সে ইতিহাস কেউ লেখেন না। মাওলানাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর এই প্রেমময় ভালোবাসা আড়ালেই রয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুর গায়ের মুজিব কোট ফরিদপুরী হুজুর তাঁকে প্রথম পরিয়ে দিয়েছিলেন। এটাকে তিনি সারা জীবনই বহন করেছেন। তিনি সবসময় পাঞ্জাবির উপরে কালো কোট পরতেন। একদিন লালবাগে হুজুরের কামড়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বসা ছিলেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘দাদা আপনার কোটটা আমার খুব ভাল লাগে।’ সাথে সাথে সদর সাহেব হুজুর নিজের পরনে থাকা কালো কোটটি খুলে নাতি মুজিবকে পরিয়ে দিলেন এবং বললেন, ‘নাতি গায়ে দাওতো দেখি, তোমাকে কেমন লাগে।’ এরপর ফরিদপুরী বললেন, ‘দারুণ তো লাগছে নেতাকে। এখন তোমাকে সত্যিকারের জাতীয় নেতা মনে হচ্ছে। ঠিক আছে এটা তোমাকে দিয়ে দিলাম। তুমি সব সময় এটা পরে মিটিং মিছিলে যাবে।’ দাদা হুজুরের সেই কালো ওয়ায়েজ কোটটি বঙ্গবন্ধুর আমৃত্যু নিত্য সঙ্গী ছিল। পরবর্তীতে এই কোটটি মুজিবকোট হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে। মূলতঃ ফরিদপুরী সাহেবের ঐ ওয়ায়েজ কোট ছিলো ১৭ বার ভারত বর্ষ আক্রমনে বিজয়ে ব্যার্থ সুলতান মাহমুদ গজনবী কর্তৃক বিশ্ব বিখ্যাত দরবেশ হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (রঃ) এর একমাত্র খলিফা হযরত আবুল হাসান খিরকানী (রঃ) এর জুব্বা মুবারক হাতে নিয়ে ভারত বর্ষ বিজয়ের মতই। তাই বলেই তো ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ১৮ মিনিটের ভাষনের সময় বঙ্গবন্ধুর শরীরে পাঞ্জাবির উপরে ছিলো ফরিদপুরী সাহেবের দেয়া সেই ওয়ায়েজ কোট। তাই বলেই তো মাত্র ৯ মাসে স্বাধীন হয়েছিল বাংলাদেশ।
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে পিতাতুল্য মনে করতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। রাষ্ট্রপ্রতি হওয়ার পরেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে মওলানা ভাসানী ছিলেন পিতার মতো। বঙ্গবন্ধুকেও তিনি পুত্রসম স্নেহ করতেন। উল্লেখ্য, মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের সভাপতি থাকাকালেই বঙ্গবন্ধু তাঁর সাধারণ সম্পাদক হয়ে ছিলেন। মওলানা ভাসানীকে তিনি একজন রাজনৈতিক গুরু হিসেবে যতটা মানতেন ঠিক ততটাই তাকে একজন ধর্মীয় পথ-নির্দেশক হিসেবে মান্য করতেন।
আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন ছিলেন মাওলানা ইয়াকুব শরীফ। আরেকজন ছিলেন মাওলানা শহিদ ওয়ালিউর রহমান। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর একান্ত সহচর ও শহিদ বুদ্ধিজীবী। যে মাওলানাকে দায়িত্ব দিয়ে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী ওলামা লীগ গঠন করেছিলেন তিনি হলেন, মাওলানা অলিউর রহমান। মাওলানা অলিউর রহমান ছিলেন আওয়ামী ওলামা পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। বঙ্গবন্ধু যখন ১৯৬৬ সালে ৬ দফা ঘোষণা করেন তখন পাকিস্তান সরকারের বেতনভুক্ত বহু আলেম উলামা ৬ দফাকে ইসলাম বিরোধী বলে ঘোষণা দেয়। সেই সময় মাওলানা অলিউর রহমান ‘ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে ৬ দফা’ নামক একটি বই লিখে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার কোন দাবিই যে ইসলামি শরিয়াহর বিরোধী নয় তা প্রমাণ করেন। ‘মুক্তিযুদ্ধা শহীদ মাওলানা অলিউর রহমান: জীবন ও সাহিত্য’ গ্রন্থে আবদুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী লিখেছেন, অলিউর রহমান ছিলেন ধর্ম মন্ত্রণালয়ের স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রস্তাবকারী। তিনি এ ব্যাপারে একটি গ্রন্থও লিখেছিলেন, স্বতন্ত্র ধর্ম দপ্তর একটি জাতীয় প্রয়োজন। তিনি ছিলেন স্বপ্ন সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ সহযোদ্ধা।
বঙ্গবন্ধু ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের সাথে যুক্ত হন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও নেজামে ইসলামের নেতা মাওলানা আতহার আলী ও ফজলুল হক সাহেব এ ফ্রন্ট গঠন করেন। এটাকে বলা হতো হক-ভাষাণী-আতহার আলী ফ্রন্ট। ওই যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু প্রথম এমপি হন। যে সংসদে ৩৬ জন আলেম ওলামা এমপি হয়েছিলেন। ওই যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভায় জীবনের প্রথম বঙ্গবন্ধু প্রতিমন্ত্রীর পদ পান। তিনি কিশোরগঞ্জের মাওলানা আতহার আলীকে অত্যন্তভক্তি ও শ্রদ্ধা করতেন। তাঁকেও ডাকতেন ‘দাদা ছাহেব’ মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে তিনি ছিলেন অত্যন্ত আন্তরিক। তিনি স্বপ্ন দেখতেন শান্তিও সৌহার্দপূর্ণ একটি বিশ্ব ব্যবস্থার। আন্তর্জাতিক সম্পর্কোন্নয়নে বঙ্গবন্ধু ছিলেন অত্যন্ত তৎপর। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মাত্র সোয়া দুই বছরের মধ্যে স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বের ১২১টি দেশের পূর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক স্বীকৃতি অর্জন করে। এর মাঝে মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নকে বেশ গুরুত্ব দিয়েছিলেন তিনি এবং তাঁর নেতেৃত্বে বেশ কিছু মুসলিম দেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কে উন্নয়ন সাধিত হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে সরকারি বিবৃতির মাধ্যমে ইসরাইলের বিরুদ্ধে নিন্দা জ্ঞাপনের পর আরবদের শুভেচ্ছার নিদর্শনস্বরূপ ২৮ সদস্যের একটি চিকিৎসক দল প্রেরণ করেন। পাঁচ হাজার সদস্যের স্বেচ্ছাসেবী মুক্তিযোদ্ধা প্রেরণ করেন, মিসরের জন্য এক লাখ পাউন্ড চা প্রেরণ করেন। আরবদের এসব সহযোগিতা প্রদান করে বঙ্গবন্ধু খাঁটি মুসলমানের পরিচয় দিয়েছিলেন। তাতে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কূটনৈতিক সাফল্য বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে, সম্মান ও মর্যাদা বাড়িয়েছে। এককথায় বঙ্গবন্ধু ছিলেন খুবই উদার, মহৎ, আন্তর্জাতিক দূরদর্শী দেশনায়ক।

লেখক : অধ্যক্ষ আহছানুল উলুম জামেয়া
গাউছিয়া কামিল (এম.এ) মাদরাসা, চট্টগ্রাম