আল মাহমুদের “ডানাঅলা মানুষ”

112

খোরশেদ মুকুল

জীবন মানেই সম্পর্ক। সম্পর্ক মানেই জীবন। বিচিত্র সম্পর্কে আটকে আছে আমাদের জীবন। জীবনের তাগিদে গড়ে উঠা এসব সম্পর্কের ধরনও ভিন্ন ভিন্ন। কারো সাথে রক্তের। কারো সাথে আত্মীয়ের। কারো সাথে বিশ্বাসের। কারো সাথে প্রেমের। কারো সাথে ভালোবাসার। কারো সাথে বন্ধুত্বের। কারো সাথে সাহায্যের। এছাড়াও নিরেট সার্থের কাতিরে গড়ে উঠে কিছু কিছু সম্পর্ক। এসব সম্পর্কের দায় এবং দায়িত্বও ভিন্ন। যত্নের অভাবে হারিয়ে যায় অনেক সম্পর্ক। কেউ আবার আকড়ে ধরে আমৃত্যু। সময় ও সুযোগ পেলেই কৃতজ্ঞতার ফুলঝুড়ি উগলে দেয় উদারতার আত্মগুণে। এই তো স¤পর্কের সফল স্বীকৃতি। আল মাহমুদের জীবনেও এমন কিছু মানুষ ছিল যাঁদের কাছে তিনি সবসময় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেন। তাঁদের ঋণ স্বীকার করতেও কার্পণ্য করতেন না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তাঁদের মধ্যে অন্যতম।
মুক্তিযোদ্ধা কবি মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সরকারেরর রোষানলে পড়ে দীর্ঘ কারাভোগ করেন। মুক্ত হয়ে শেখ মুজিবের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় তিনি শিল্পকলা একাডেমিতে চাকরি পান। এছাড়াও তিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন গঠিত মুজিবনগর সরকারের ৮নং থিয়েটার রোডে প্রতিরক্ষা বিভাগের স্টাফ অফিসার হিসেবে নিয়োগ পান। এই ঋণের তাড়নায় আল মাহমুদ লিখেছেন মুক্তযুদ্ধ ভিত্তিক কালজয়ী উপন্যাস “কাবিলের বোন”। লিখেছেন “নিশিডাক” নামের কালোত্তীর্ণ কবিতা।
কবিরা স্বপ্ন দেখায়। স্বপ্নের সিঁড়িতে হাঁটতে শেখায়। জাতিকে পথ দেখায়। আল মাহমুদ বলেছেন, কবি না থাকলে স্বপ্ন থাকবে না, সবুজ থাকবে না, সঙ্গীত থাকবে না। আর থাকবে না ভালোবাসা। যার কথা তোমরা দিবস রজনী বলতে সবচেয়ে বেশি আনন্দ পাও। তাই যাঁরা জাতিকে স্বপ্ন দেখায়। সংকট থেকে উত্তরণের পথ দেখায় তাঁদের সাথে কবির সখ্য গড়ে উঠে। এমনই এক তেজোদীপ্ত স্বাপ্নিক পুরুষ বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও সাবেক সেনা প্রধান বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান বীর উত্তম। যাঁকে আল মাহমুদ “ডানাঅলা মানুষ” বলে আখ্যায়িত করেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও স্বনির্ভরতা অর্জন এবং বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় যাঁর অবদান অনস্বীকার্য। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীরউত্তম খেতাবে ভ‚ষিত করে। তিনি ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল বাংলাদেশের বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হন এবং ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী গঠন করে। চার বছর দেশ শাসন করার পর ১৯৮১ সালে ৩০ মে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে তিনি নিহত হন।
একবার দেশের মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের জাহাজে করে বঙ্গোপসাগরে নিয়ে গেলেন প্রেসিডেন্ট জিয়া। সমুদ্রের স¤পদ-গভীরতা এবং সমুদ্রাকাশের উদারতা মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের দেখানোর অভিপ্রায় ছিল জিয়াউর রহমানের। তিনি তাই দেখিয়েছেন। তাই নিয়ে বক্তৃতা শুনিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট জিয়া সেই জাহাজেও তুলেছিলেন কবি আল মাহমুদকে। সমুদ্রের কোলে বসে বলেছিলেন- কবি এই তরুণ-তরুনীরাই আগামী দিনের বাংলাদেশ। এদের বুকে স্বপ্ন জাগিয়ে দিতে হবে। কবিরা স্বপ্নদ্রষ্টা। কবির স্বপ্ন রুয়ে দিতে চাই ওদের বুকে। এভাবে আল মাহমুদ সম্মানিত হয়েছেন একজন রাষ্ট্রপতির কাছে। তিনিও জিয়াউর রহমানকে নিয়ে লিখেছেন গল্প- “তৃষিত জলধি” এবং একটি কবিতা “ডানাঅলা মানুষ”। সফরে প্রেসিডেন্ট কবির নদী কেন্দ্রিক লেখার ভ‚য়সী প্রশংসা করলেও সাগর নিয়ে না লেখার কারণে আফসোস করেন। সমুদ্রের অভিজ্ঞতা না থাকাটা বেদনাদায়ক বলেও উল্লেখ করেন। কারণ বাংলাদেশ নদী মাতৃক হলেও এর অর্ধেক জুড়ে রয়েছে সাগর। আর সাগর ছাড়া আমাদের জীবন অনেকটাই অর্থহীন। এমন প্রেক্ষিতে বাস্তব অবিজ্ঞতার আলোকে “জলধি” গল্প সত্যিই ঋণশোধ আর প্রেরণার সিগনেচার।
“ডানাঅলা মানুষ” কবিতাটির তৃতীয় ও চতুর্থ স্তবক ব্যাখ্যা করলে মূলত “জলধি” গল্পটা পাওয়া যায়। প্রথম দুই স্তবকে কবি নিজের সাথে প্রেসিডেন্টের স্বপ্নের মিল খুঁজে বের করে গল্পের প্রস্তুতি পর্ব এবং শেষ স্তবক প্রেসিডেন্টের অন্তিম মুহূর্তের আখ্যান বললে অত্যুক্তি হবে না বলেই মনে করি। আল মাহমুদের ছোটোগল্পকে যারা ফ্রয়েডীয় যৌন চেতনার নিঁখুত রূপায়ন বলে উল্লাস করেন তারা ‘ইভের ছাঁয়া’ কিংবা ‘রুহানীর রুদ্ধশ্বাস’ অথবা ‘সৌরভের কাছে পরাজিত’, ‘তৃষিত জলধি’, ‘হলুদ বাড়ির আগন্তুক’, ‘পারাপার’, ‘অগস্তাযাত্রা’ ও ‘বকুল ঝরার ভোর’ পড়লে ভড়কে যাবেন বলেই আমার বিশ্বাস।
দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা কবি হিসেবে দেশকে নিয়ে দেশের মানুষকে নিয়ে কবির চিন্তার অন্ত ছিল না। দেশের উন্নতি, স্বনির্ভরতা নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন কবি। যদিও তখন দেশের অবস্থা আশানুরূপ ছিল না। তবুও স্বপ্ন দেখতেন স্বনির্ভর বাংলাদেশের। যেখানে মিলে যায় প্রেসিডেন্টের সাথে। কবির ভাষায়-
…পৃথীবির ক্ষুধার্ত মানচিত্রের প্রায় প্রত্যেকটি
প্রাণীরই যেমন অদৃশ্য ডানা থাকে, তেমনি। থাকে
স্বপ্নের অলীক পাখনা।
উপোসি পেটে পাথর বেঁধে তারা উড়াল মারে আকাশে
মেঘের গম্বুজে বসে ডাকে আল্লাহকে। হু হু শব্দের
ঘূর্ণিঝড়ে, এমনকি ফেরেশতারাও মানুষের ভাষা
শিখতে চায়। তাদের পাখার আওয়াজে নড়ে উঠে গাছপালা।
“তৃষিত জলধি” গল্প কবি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের দূরদর্শী চিন্তার বাস্তব প্রতিফলনের আগাম বার্তা নিয়েই এগিয়েছে। সারাদেশ থেকে মেধাবী শিক্ষার্থীর সঙ্গে বঙ্গোপসাগরের এই সফরে সংস্কৃতি অঙ্গনের বিভিন্ন খ্যাতিমান মানুষের সাথে ছিল কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ এবং কবি স্বয়ং। সফরে দেখা হওয়ার আগেও যুদ্ধের সময় একবার আলাপ হয়েছিল বলে কবি জানান। একটি সম্ভাবনাময় দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে প্রেসিডেন্ট এমন সফরের আয়োজন করেন। স¤পদে পরিপূর্ণ থাকলেও ক্ষুধা, দারির্দ্য, অসহায়তা আমাদের উদ্যমহীনতার কারণে বলেই মনে করেন প্রেসিডেন্ট। যাত্রা শুরুর দিনই নিঃসঙ্গ, স্বাপ্নিক, দেশপ্রেমিক প্রেসিডেন্ট সবার সামনে একটি প্রেরণাদায়ক বক্তব্য দেন। অসীম সাহস বুকে নিয়ে তিনি বাংলাদেশের জনগণকে আহবান করেন ‘সংকীর্ণতা ও কূপমন্ডূকতাকে পরিহার করে সমুদ্রের মত উদার ও ঝড়ো হাওয়ার মত সাহসী’ হওয়ার জন্য। পূর্বপুরুষদের শৌর্যবীর্য স্মরণ করে সকল দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করার কথাও বলেন তিনি। যিনি মনে করেন যে বঙ্গোপসাগরের তলদেশে ‘রয়েছে দশকোটি মানুষের উদরপূর্তির জন্য প্রয়োজনেরও অতিরিক্ত আহার্য ও মূল ভ‚মি ভেঙে আসা বিপুল পলিমাটির বিশাল দ্বীপদেশ যা আগামী দু’তিনটি প্রজন্মের মধ্যেই ভেসে উঠবে’, যাঁর বিশ্বাস, ‘বাংলাদেশের পেটের ভেতরে লুক্কায়িত সাতরাজার ধন, পেট্রোল। বিশুদ্ধ পেট্রোল…’ আল্লাহর শ্রেষ্ঠ নেয়ামত। এমন হাজারো সপ্ন আর সম্ভাবনার প্রদীপ মেধাবী শিক্ষার্থীদের মনে জ্বালিয়ে তিনি বিদায় নিয়ে নিজ কামড়ায় চলে যান।
শুধু ভাবগম্ভীর কথাবার্তার মধ্য দিয়েই গল্প আগায়নি। সফদর আলীর মত রাজনৈতিক নেতার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে প্রচলিত সুবিধাভোগী নেতার নির্লজ্জ চরিত্র। যার নজর শুধু স¤পদ আর নারীতে সীমাবদ্ধ। আছে জাহানারা চৌধুরীর মত প্রতিভাবান শিল্পী। প্রেসিডেন্টের বক্তব্যের শেষে যে গেয়ে উঠে কাজী নজরুল ইসলামের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট…’ গান। যার মাধ্যমে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। এছাড়া কবিতাপ্রেমী নইমা খানের কথাও আসছে প্রসঙ্গক্রমে।
গভীর রাত। সবাই ঘুমিয়ে। কিন্তু কবির ঘুম আসছে না। কায়দা করে ছাদে গিয়ে দেখে সেখানে নিঃসংঙ্গ পথিক প্রেসিডেন্ট বসে আছে আধারকে আলিঙ্গন করে। সেখানে হয় তাদের অন্তরঙ্গ আলাপ। উঠে আসে নানা প্রসঙ্গ। সেখানেই সমুদ্র নিয়ে লেখার কথা ব্যক্ত করেন তিনি। বিদায় বেলার কথা- তাঁকে সালাম জানিয়ে সিঁড়ির কাছে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাঁকে আবার দেখার জন্য পিছনে ফিরলাম। এখান থেকে তাঁর চেহেরাটা পরিষ্কার দেখা না গেলেও চাঁদের ¯পষ্ট আলোয় নিঃসঙ্গ অবস্থানটি বোঝা যায়। বসে আছেন তিনি বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গের দিকে মুখ করে। নিঃসঙ্গ একজন মানুষ। এখন তাঁর চোখে কালো চশমা জোড়া থাকার কথা নয়, তবুও আমার মনে হল তাঁর বিষণ্ণ চোখ দুটি বুঝি এখনো কোনো কালো আবরণের ভেতর থেকে সন্ধানী দৃষ্টি ফেলে জলের ভেতর জেগে ওঠা বাংলাদেশের নতুন মাটিকে দেখছে। নতুন পলির মানচিত্র তৈরি হচ্ছে তাঁর হৃদয়ে।
এমন কথাটাই ডানাঅলা কবিতায় উল্লেখ করেন এভাবে-
আমি বললাম, মহামান্য প্রেসিডেন্ট, আপনি
এখানে কী খুঁজছেন? আপনার ঘুম পায় না।
-আমি তেল খুঁজছি। দেখতে পাচ্ছো না?
তরঙ্গের নিচে আমাদের জন্য তেলের শিরা বইছে?
তুমি কতদূর দেখতে পাও, সামনে তাকাও
যতদূর দেখা যায় সবটাই বাংলাদেশ।
আমি অভিভ‚ত হয়ে বললাম, মিস্টার প্রেসিডেন্ট,
মনে হয় আপনি আমার মতই উড়তে পারেন। কিন্তু আপনার
ডানা কই? ডানা দেখছি না কেনো?
-আছে। দেখো সমুদ্র তরঙ্গের মত লাফিয়ে ওঠে,
আর আকাশের মত নীল। ঘাতকের ভয়ে তা লুকিয়ে রাখি আড়ালে
কেউ দেখতে পায় না।
বেশিদিন লুকিয়ে রাখতে পারেননি সেই ডানা। তাঁর বিভিন্ন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক কর্মকান্ড শত্রুর মনে কাঁপন ধরিয়ে দেয়। শুরু হয় দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র। অবশেষে ভেঙে দেয় ডানা দুটি। কোথাও নেই। নেই জনসমুদ্রে- ‘ঘাম আর চোখের দরিয়ায়’।
আবার তাকে দেখেছিলাম আরেক সমুদ্রে। জনসমুদ্রে
মানুষের মিছিলের লবণাক্ত দরিয়া ছিলো সেটা।
তরঙ্গ উঠছিল মানুষের হাতের। একটি কামানধারী গাড়িতে
তার কফিন ফুলের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
আমি তার ডানা দুটি কী হলো-
খোঁজ করতে করতে মধ্য সমুদ্রের মধ্যে নেমে গেলাম।
নামলাম, ঘাম আর চোখের দরিয়ায়। কই সেই ডানা
যা আকাশের মতো নীল আর ঢেউয়ের মতো
লাফিয়ে উঠে বাতাসে?