আলিয়া ও তার মুক্তিযুদ্ধ

130

অঝোর বৃষ্টি রাত। মন ভাল নেই কিশোরী আলিয়ার। চারিদিকে থমথমে পরিবেশ। সময়টা দেশের জন্য বড্ডই আকাল।মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের কথা। বর্ষাকাল, অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে। জানালার গ্রিলে কে যেন বন্দুক ধরে বসে আছে।এই বুঝি এক্ষুণি মরে যাবে আলিয়া, কেউ মেরে ফেলতে চাই তাকে। কিন্তু এটা আলিয়ার মনের ভয়। তবুও আলিয়ার মনে একটি সুখকর অনুভ‚তি কাজ করছে তা হলো ঐ ভয়ের চেয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি বৃষ্টি খেলতে ইচ্ছে করছে। এক ফোঁটা বৃষ্টির পানি ও ঠান্ডা বাতাসে নিজেকে ভিজিয়ে যেন বাড়ির উঠোনের সবুজ ঘাসে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি ফোঁটা গুনতে মন চাইছে। মন ছুটছে আর ছুটছে। এমন বৃষ্টি ভেজা রাতে তার বন্ধু গোলবাহার, সখিনা, বানু, রানু ও বুবুর কথা ভীষণ মনে পড়ছে।আগামী মাসে হলো বুবুর বিয়ে তাই বুবু নানুর বাড়ীতে নাইর গেছে। তাই এদিকে মায়ের ব্যস্ততা বেশি। কাজের চাপ, মাটিঘর। দেয়ালগুলো খসে গেছে। লেপন-পোঁচনের দরকার। এই জন্য মায়ের দম ফেলার সময় নেই। তবুও মা কেন যেন আনমনা ও উদাসীন থাকে। অভাবের সংসার, একজনের কাঁধ।সেই কাঁধ (বাবা)…..
আর বাবার কথা কি বলব? সে তো কবে গেছে আর ফিরে এলো না। যাওয়ার সময় মায়ের হাতে কিছু বন্ধকী টাকা, চিঁড়া – গুড়, মুড়ি, বিস্কুট, কিছু চাউল ও লাল টুকটুকে একটি বেনারসি শাড়ি কিনে দিয়ে আমার কপালে চুমু এঁকে চলে যায়। তবে যাওয়ার সময় মা,কে বলে গিয়েছিল – আমি যদি ফিরে আসি তাহলে পাড়া-মহল্লায় সবাইকে মেমানি (দাওয়াত অর্থ্যাৎ গণ খাওয়া ) খাওয়াতে হবে
তোমার থেকে। মা বলল, আচ্ছা, আপনি যান, আমাদের জন্য চিন্তা করবেন না। আলিয়া তখন মায়ের আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে ছিল পাশে, কেন যেন মায়ের চোখের দিকে নজর পড়ে। মা কাঁদছে। মা কে কাঁদতে দেখে মনে মনে বললো- মা, কেন কাঁদছে? সাহস করে মাকে জানতে চাইলো মা – কেন কাঁদছে তুমি ? আলিয়ার আওয়াজ শুনে তার মাযের সম্বিৎ ফিরে এলো এতক্ষণে।কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল তিনি? ঐদিকে তার মায়ের কলিজা ধরে মোচড় দিয়ে উঠলো। বুকটা ধড়ফড় ধড়ফড় করা শুরু হলো।অসহায় ভাবে টিপটিপ চোখের পানি ফোঁটা ঝরে পড়ছে । আলিয়াকে কিছু বলছে না। কিন্ত এভাবে মা কাঁদছে কেন? আলিযার মনে মনে কত প্রশ্ন জাগছে। তারপর তার মাকে জড়িয়ে জানতে চাইলো –
মা : তুমি কাঁদছো কেন? বাবা কোথাও গেলে কি এভাবে কাঁদতে হয়? এই কথা শোনার পর ছোট্ট আলিয়া কে জড়িয়ে হু হু কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে। এবং মনে মনে বলছে… মা গো তোর বাবার হয়ত এটা শেষ বিদায়। আর হয়ত ফিরেও আসবে না। তুই তো জানিস না – দেশে যুদ্ধ চলছে। আর আমার কাছে তুই, তোর বুবু আর আমার অনাগত শিশুর দায়িত্ব দিয়ে চলে গেছে। আরও দিয়ে গেছে তোর বুবু বিয়ের দায়িত্ব।
এইদিকে আগামী মাসের দু তারিখ বড় মেয়ের বিয়ে, অন্যদিকে বিয়ের পরের মাসে আমার অনাগত সন্তানের ডেলিভারি দিন। পাশের পাড়া ছলিম উদ্দীনের বড় ছেলে কুদ্দুস মিয়ার ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছে। ছেলে নাম করা চাষী পরিবারের। শিক্ষা – দীক্ষা কিছু নাই। আছে শুধু ধানের চাষের পয়দা। ওরা মাইলকে মাইল ধান চাষ করে। বড় পরিবার। এতবড় পরিবারের সাথে সম্পর্ক করা ভাগ্যের ব্যাপার। নতুন ধানের যখন থোড় আসে তখন ওদের বাড়ীতে অন্যরকম উৎসব হয়। বিভিন্ন জেলা থেকে নামকরা পূঁথি পাঠক এনে পাঠের আসর বসায়। পুরানোর ধানের চাউল দিয়ে বিভিন্ন রকমের রসনা বিলাস পিঠাপুলি বানিয়ে খাওন-দাওন করায়।গ্রামের মুরব্বিদের আলাদা ভাবে দাওয়াত দিয়ে কাপড়চোপড় দিয়ে খুশি করে। খুশি করা মানেই মুরব্বিদের দোয়া নেওয়া অর্থ্যাৎ তাদের বিশ্বাস ওদের দোয়া- বরকতে ধানের ফলন বেশি হবে সেই আশায় বুক বাঁধে।
হঠাৎ আলিয়ার মন ভারী হয়ে গেল। বৃষ্টির মত করে কাঁদতে চাইছে তার মন। চোখের কোণে ঘোর বৃষ্টি। বৃষ্টির সাথে মিশে একাকার হয়ে গেছে জীবনের সব রঙ। সে ভাবছে এই জগৎ সংসারে তাদের কেউ নেই। বাবা যে গেলো আর এলো না, আর এদিকে বুবুর বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসছে। মা একা। তাছাড়া সন্তানসম্ভবা। বাবা আসছে না, কোথায় গেছে? তা মা কিছু বলে না। সারারাত এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লো বুঝতে পারেনি।
বৃষ্টি সকাল, মা এসে ঘুম ভেঙে দিলো। মা বললো উঠো- সকাল হলো। আলিয়া উঠে মুখ পরিস্কার করে – মায়ের কাছে গেলো। তখন সে দেখতে পাচ্ছে – তার মা ছোট ছোট টেংরা মাছ কাটছে। মাকে জানতে চাইলো -মা, এইগুলো কোথায় পেলে? বাবা এনেছে বুঝি ? বাবা নিশ্চয়ই ঘুমাচ্ছে। ঠিক আছে বাবাকে এখন ঘুম থেকে ডাকবো না। পরে দেখা করবো। আবোল – তাবোল সে বিড়বিড় করছে। মা শুনে চুপ, শুনছে তবে কোন উত্তর দিচ্ছে না। অনেকক্ষণ পর মা বললো – আলিয়া হাঁড়িতে বাসিভাত আছে, খেয়ে নাও। আচ্ছা মা…..
আলিয়া খাওয়া শেষে করে মায়ের পাশে এসে বসলো। সেই আবার জানতে চাইলো – মা বাবা কে কি ঘুম থেকে ডেকে দিবো? তখন মা বললো – তোর বাবা আসেনি। তাহলে তুমি এই মাছ কোথায় পেলে? এইগুলো বাড়ির পেছনে নালার উজানি মাছ। সারারাত আমি উজান স্রোতে বসে এই মাছ ধরেছি। ও আচ্ছা, তাই। তাহলে আমাকে নিয়ে যাওনি কেন? তুমি তো ছোট তাই বলিনি। আলিয়া বললো – তুমি ও তো অসুস্থ। মা গো অসুস্থ হলেও ব্যবস্থা তোদেরকে খাওয়া তে হবে। এই সময় বাইরে থেকে আওয়াজ আসলো – এই বাড়ীতে কেউ আছেন? আলিয়া জবাব দিলো – জ্বি! কে আপনি? আমি চাষী বাড়ী থেকে এসেছি। আমাকে ছলিম চাষী পাঠালো। তোমার বাবাকে ডাকো। কথা আছে তার সাথে। বাবা তো নেই। শহরে গেছে। তখন আলিয়ার মা এই শুনে দেয়ালের ফোঁকরে এসে দৌড়ে দাঁড়ালো, শাড়ির আঁচল টেনে ধরে অনেক কথা বললো। বিয়ের ব্যাপারে সব সারলো। নাস্তা দিলো চাউল ভাজা ও মুড়ির মোয়া।তারপর উনি চলে গেল। স্বামীর দেওয়ার বন্ধকী টাকাগুলো কোনমতে মেয়ের বিয়ে সারলো।
দিনের পর দিন যায়। আলিয়ার বাবা আসে না। গভীর রাতে শহর থেকে পাকিস্তানি লোকজনের এলোপাতাড়ি বন্দুকের আওয়াজ শুনা যায়। একটি নদী পারপারা শহর। আলিয়ার মায়ের ঘুম আসে না। ছটফট করতে থাকে। এদিক-সেদিক ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে বাইরে কান লাগিয়ে শুনে। কোথায় কি হচ্ছে? এভাবে সারারাত কাটে। সকালবেলা ঘুম থেকে মুখ – হাত ধুয়ে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে হাঁটছে। ঐ সময় পাশের বাড়ির জলিল এসে বললো – আলিয়ার মা জানেন, শহরে কড়া গন্ডগোল লেগেছে। ও তাই। অসহায় আলিয়ার মা, ভেতরে ভেতরে কাঁদছে। মুখফোটে কিচ্ছু বলছে না। পাকবাহিনীরা দেশের ছড়িয়ে গেছে। সাবধানে থাকিয়েন ভাবী। দোয়া করবেন… আল্লাহ হাফেজ।
আলিয়ার মা দুচোখ দিয়ে তার চলে যাওয়া দেখছে। মনে মনে বলছে – আল্লাহ তুমি তাকে হেফাজত রাখ।একমাত্র বিধবা মায়ের ছেলে সে। সে ছাড়া তার মায়ের কেউ নেই। দুরে মসজিদ থেকে আওয়াজে ভেসে আসছে… দেশে যুদ্ধ লেগেছে। গ্রাম- প্রতিবেশী সাবধান থাকো, হাতে কাস্তে, কোদাল রেখো। নিজেদের নিরাপদে রেখো।পাকিস্তানিরা সবাইকে মেরে ফেলবে। ওরা মানুষ নয়, ওরা বৈঈমান…
এ কথা শোনার পর আলিয়ার মায়ের ভয় বেড়ে গেছে। হাত- পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। হঠাৎ বুঝতে পারলো – তার অধরে গোমরে কাঁদছে কে যেন? তাকে বলছে..আমি আমার বাবাকে দেখতে চায়। ওরা বাবাকে মেরে ফেলবে। মা মা মা….. । (ঐ সময় আলিয়ার বাবা পাকিস্তানির বন্দুকের নলে পিষ্ট হয়ে গেছে।)
রাতে আলিয়াকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। এপাশ-ওপাশ করছে। ব্যথা বাড়ছে- প্রসব যন্ত্রণা। কেউ নেই, বাড়ীতে আলিয়া ছাড়া। ছোট্ট আলিয়াকে মা জড়িয়ে ধরে প্রসব যন্ত্রণা মোকাবিলা করছে – তার মা। না, পারছে না। বেড়েই চলছে। অবশেষে কান্নাকাটি আওয়াজে আলিয়ার ঘুম ভেঙে গেলো…. মা, মা… তোমার কি হলো মা? মায়ের আওয়াজ নেই, কষ্টে কিটকিট করছে। বত্রিশ দাঁতের ফালি বের করে হাঁপাচ্ছে। না, পারছে না… এসব দেখে আলিয়া ঘরের কোণে বসে দু,হাঁটু ভাঁজ করে কাঁদছে আর কাঁদছে । ছোট্ট আলিয়া নিরুপায়। কিচ্ছু জানে না, বুঝে না প্রসব ব্যথা কি? থর থর করে কাঁপছে আর কাঁপছে। আলিয়া দেখছে তার মা – ঘরের চালের খুঁটিতে শাড়ির আঁচল পেছিয়ে যুদ্ধ করছে । এভাবে যুদ্ধ করছে, কোনমতেই থামছে না। অবশেষে এই অবস্থায় আলিয়া উঠে এসে মাকে জড়িয়ে ধরলো… হায়রে মা ! সেই অবস্থায় আলিয়াকে চুমু খেয়ে বললো – মা আমি আর বাঁচবো না। আমি জানি, তোর বাবা যুদ্ধে মারা গেছে। দেশের জন্য মরে গেছে। পাকিস্তানি মিলিটারিরা মেরে ফেলছে তোর বাবাকে। দেখ আমিও প্রসব ব্যথা থেকে মৃত্যুশয্যায়। তবে আমি জানি না আমার এই সন্তানে মৃত বা জীবিত হবে কিনা বা ছেলে কিবা মেয়ে? তুই তো ছোট্ট…..তুই কার কোলে মানুষ হবি তাও আমি জানি না। কে আগলে রাখবে তোকে ও আমার সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুকে। কে বুকের দুধ খাওয়াবে। আরও বললো আমার যদি ছেলে হয় তাহলে ও বড় হলে যদি তোর সাথে যোগাযোগ থাকে তাহলে বলবি….. তার মায়ের আদেশ কথা। তা হলো – ওকে বলবি দেশের জন্য সৎ থাকতে, দেশ রক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়তে, দেশ কে পরিস্কার – পরিচ্ছন্ন রাখতে এবং প্রতি বছর প্রভাত-ফেরী, স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসে শহীদ মিনারে গিয়ে বাঙ্গালি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান জানাতে। এই বলে আলিয়ার মা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো। পাশে পড়ে কাঁদছে সদ্য জন্ম নেওয়া শিশু ও আলিয়া……
এরপরের টা পুরো ইতিহাস।