আবারও জঙ্গি তৎপরতা! কঠোর নজরদারি ও সতর্কতার বিকল্প নেই

5

ইসলামি জিহাদের নামে তরুণ ও যুবকদের আবারও হিজরত আবারও জঙ্গি তৎপরতার খবর আমাদের জন্য অশনি সংকেত তো বটে। গত সোমবার রাজধানী ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব জানিয়েছে, উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিভিন্ন জেলা থেকে অন্তত ৫৫ জন তরুণ নিখোঁজ হয়েছে। তাদের মধ্যে ৩৮ জনের নাম-পরিচয় পাওয়া গেছে। কথিত হিজরতের নামে ঘর ছেড়েছে তারা। যারা নিরুদ্দেশ হয়েছে, তাদের মধ্যে প্রায় সবাই নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’য় যোগ দিয়েছে। ইতোমধ্যে সংগঠনটির সমন্বয়কসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে র‌্যাব। তাদের কাছ থেকে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ করার কিছু পুস্তিকা ও লিফলেটও উদ্ধার করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরবচ্ছিন্ন অভিযানে দেশে জঙ্গি তৎপরতা স্তিমিত হয়ে এলেও তা যে পুরোপুরি বন্ধ হয়নি, এসব তথ্য তারই প্রমাণ। এটি একটি উদ্বেগের বিষয় অবশ্যই। গভীর উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার দুর্গম পাহাড়ে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) ক্যাম্পে প্রশিক্ষণশিবির পরিচালনা করছে। এ সংগঠনটি গোপনে অরণ্যঘেরা পাহাড়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণ দিচ্ছে-এমন খবরে সরকার নয় শুধু দেশবাসীকে নতুনভাবে উৎকণ্ঠায় ফেলেছে। অতীতে এসব জঙ্গি সংগঠন সম-আদর্শের লোকজনের সহায়তা নিলেও এখানে তারা ভিন্ন জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে সুবিধা পাচ্ছে। বম জাতিগোষ্ঠীর লোকজনকে নিয়েই মূলত কেএনএফ গঠিত। র‌্যাব যে ৫৫ জন তরুণের জঙ্গি সম্পৃক্ততা থেকে ঘর ছাড়ার কথা বলেছেন, তাদের দেশের ১৯ জেলা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এ ৫৫ জনের মধ্যে ৩৮ জনের পূর্ণ নাম-ঠিকানার একটা তালিকাও প্রকাশ করা হয়। ‘নিরুদ্দেশ’ বা ‘নিখোঁজ’ থাকা এই তরুণদের অনেকে বান্দরবানের দুর্গম এলাকায় কেএনএফের প্রশিক্ষণ শিবিরে আছেন। গত এক সপ্তাহে জামাতুল আনসারের যে ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ এবং প্রাপ্ত তথ্যাদি বিশ্লেষণ করে পাহাড়ের ওই জঙ্গি প্রশিক্ষণকেন্দ্র সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেছে। সেখানে এখনো জামাতুল আনসারের ৫০-এর অধিক সদস্য রয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। আবার কেউ কেউ নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে স্বেচ্ছায় বাড়ি ফিরেছেন, এরকম উদাহরণও আছে। জাতীয় ও স্থানীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নিষিদ্ধ তিন জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম, জেএমবি ও হরকাতুল জিহাদের কিছু নেতার উদ্যোগে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া (যার বাংলা অর্থ: পূর্ববর্তী হিন্দের সাহায্যকারী দল) গঠন করা হয়। ২০১৭ সালে এরা সংগঠিত হতে শুরু করলেও সংগঠনের নাম ঠিক করে ২০১৯ সালে। অতীতে দেশের বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন পাহাড়ে আস্তানা বা ঘাঁটি স্থাপনের চেষ্টা করেছিল।
তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠীর আস্তানায় ধর্মভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রশিক্ষণ নেওয়ার খবর আগে জানা যায়নি। কেএনএফের ক্যাম্পের এই জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ শুরু হয় চলতি বছরের শুরুতে। সেখানে একে-৪৭ রাইফেল, পিস্তল ও কাটা বন্দুক চালানো, বোমা (আইইডি) তৈরি এবং চোরাগোপ্তা হামলার (অ্যাম্বুশ) প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর জঙ্গিদের বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা ঘোষণা করে। ২০১৬ সালে হোলি আর্টিজান ট্র্যাজেডির পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে বহু জঙ্গি ধরা পড়ে। এর আগেও অভিযান চালিয়ে বহু জঙ্গিকে ধরা হয় এবং তাদের আস্তানা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এরপরও জঙ্গিদের তৎপরতা যে বন্ধ হয়নি, বিভিন্ন স্থান থেকে তরুণদের হিজরত করা এবং দুর্গম পাহাড়ে প্রশিক্ষণশিবির খুলে বসাই তার প্রমাণ। জঙ্গি দমনে সাময়িক সাফল্য নিয়ে আত্মতৃপ্তির কোনো সুযোগ নেই। নিরন্তর নজরদারি জারি রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে পরিবার ও জনসমাজেরও দায়িত্ব আছে। আবার সরকারকেও মনে রাখতে হবে কেবল বলপ্রয়োগ বা অভিযান চালিয়ে জঙ্গি সমস্যার সমাধান মিলবে না। দেশে-বিদেশে এদের অর্থ ও অস্ত্রের উৎস বন্ধ করতে হবে। যেই মতাদর্শ তরুণদের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করে, সেই মতাদর্শের বিনাশ না করতে পারলে শঙ্কা থেকেই যাবে। যেসব তরুণ ধরা পড়েছেন, তাঁরা যাতে ভবিষ্যতে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেন, সে জন্য সরকারের ‘পুনর্বাসন’ কার্যক্রমও জোরদার করতে হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, যেকোনো উগ্রপন্থাই খারাপ। প্রতিটি ধর্মের অন্তর্নিহিত মর্মবাণী হচ্ছে শান্তি। অশান্তি, নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা শুধু ধর্মীয় নয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও পরিত্যাজ্য। দেখা যাচ্ছে, উগ্রপন্থিরা পরিত্যাজ্য একটি বিষয়কে উপজীব্য করে তাদের ভাষায় ‘জেহাদের ময়দানে’ অবতীর্ণ হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে কঠোরতা অবলম্বনের পাশাপাশি তরুণরা যাতে উগ্রবাদে আকৃষ্ট না হয়, সেজন্য তাদের মোটিভেট বা উদ্বুদ্ধ করতে হবে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। বিশেষ করে অতিদরিদ্ররা যেহেতু সহজেই উগ্র বা জঙ্গি মতবাদে আকৃষ্ট হয়, সেহেতু এই শ্রেণির মানুষের জন্য জঙ্গিবিরোধী উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। কয়েক বছর আগে চট্টগ্রামের বাঁশখালীর গহিন অরণ্যঘেরা পাহাড়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সন্ধান মিলেছিল। ধারণা করা যায়, জঙ্গিরা দেশের দুর্গম এলাকাগুলোকে আবারও তাদের গোপন তৎপরতার কেন্দ্র হিসাবে বেছে নিয়েছে। সেক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এসব অঞ্চলে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। জোরদার করতে হবে গোয়েন্দা নজরদারি।