অশনির গতিবিধি বোঝা যাবে আজ

10

নিজস্ব প্রতিবেদক

‘আম্ফানের’ পর আন্দামান সাগর হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোসাগরে সৃষ্টি হওয়া নতুন ঘূর্ণিঝড় ‘অশনি’র শক্তিমত্তা নিয়ে মোটামুটি একমত দেশ-বিদেশের আবহাওয়াবিদ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা। এটি যে প্রবল শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় হতে চলেছে সেটা সকলের কাছেই সন্দেহাতীত। তবে এটির গতিপথ নিয়ে এখনও সন্দিহান তারা। ঠিক কখন কোন সময় নাগাদ ঘূর্ণিঝড়টি বঙ্গোপসাগর থেকে উপক‚ল হয়ে স্থলভাগে আঘাত হানতে পারে- তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। এ জন্য আজ মঙ্গলবার দুপুর নাগাদ পর্যন্ত অপেক্ষা করার কথা বলছেন আবহাওয়াবিদরা।
অধিদপ্তরের ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্রের আবহাওয়াবিদ খোন্দকার হাফিজুর রহমান গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় পূর্বদেশকে বলেন, ঘূর্ণিঝড় অশনি যে সাগরে অবস্থান করে প্রবল শক্তি সঞ্চয় করছে, সে ব্যাপারে আমরা মোটামুটি নিশ্চিত। তবে এটি সাগর থেকে প্রতিবেশি দেশ ভারতের অন্ধ্র প্রদেশ উড়িষ্যা উপক‚ল হয়ে স্থলভাগে উঠে আসবে কিনা সেটা আমরা এখনও বলতে পারছি না। সময়ের ব্যবধানে ঘূর্ণিঝড়টি প্রাকৃতিকভাবেই গতিপথও পরিবর্তন করতে পারে। সুতরাং এটির গতিপথ সম্পর্কে আমরা এখন পর্যন্ত সন্দিহান। আশা করছি, মঙ্গলবার দুপুর নাগাদ এ বিষয়ে আমরা স্পষ্ট করে কিছু জানাতে পারব।
দেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের সিনপটিক অবস্থা বা দৃশ্যপটে গতকাল সন্ধ্যা ছ’টায় বলা হয়েছে, দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত ঘুর্ণিঝড় ‘অশনি’ উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর ও ঘনীভ‚ত হয়ে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়ে সন্ধ্যায় পশ্চিম-মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছিল। এটি আরো উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে পারে। এর একটি বর্ধিতাংশ উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। এছাড়া, গতকাল সোমবার ছয়টা থেকে পরবর্তী চব্বিশ ঘন্টার জন্য প্রচারিত আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, খুলনা, রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহ, সিলেট, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় এবং রংপুর বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ীভাবে ঝড়ো হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সাথে খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হতে পারে। সারাদেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। গতকাল সোমবার বরিশালের খেপুপাড়ায় দেশের সর্বোচ্চ দুইশ এক ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অদিপ্তর। এছাড়া চট্টগ্রাম নগরে ১২ মিলিমিটার, স›দ্বীপে ৩৩, সীতাকুÐে ৮৫, রাঙামাটিতে ২৩, চাঁদপুরে ২৮, ফেনীতে ১৭, হাতিয়ায় ৫৯, কক্সবাজারে ১৯, কুতুবদিয়ায় ২৯ এবং টেকনাফে ২৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। বৈশাখের এই বৃষ্টিধারায় বিড়ম্বনার চেয়ে স্বস্তিই বেশি অনুভব করেছে মানুষ।
আবহাওয়া ও ঘূর্ণিঝড়ের গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণকারী বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় অশনির প্রভাবে পুরো বঙ্গোপসাগর জুড়ে গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালা তৈরি অব্যাহত রয়েছে। এই মেঘমালার বেশ কিছু অংশ ইতিমধ্যেই উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। যার ফলে গত রবিবার রাতেই দেশের উপকূলের আকাশে মেঘের আনাগোনা বাড়তে শুরু করেছে। সেই সাথে গতকাল সোমবার দিনে বা রাতের যে কোনও সময় দেশের উপকূলীয় জেলাসমূহ বিশেষ করে সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, ল²ীপুর, নোয়াখালী, টেকনাফ, কক্সবাজার, কুতুবদীয়াসহ খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের বেশকিছু স্থানে দমকা বাতাসসহ আকস্মিকভাবে বৃষ্টি অথবা বজ্রবৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টিপাতের এই ধারা আজ থেকে দক্ষিণাঞ্চলের পাশাপাশি রাজধানী ঢাকাসহ দেশের উত্তরাঞ্চলের দিকে বিস্তার লাভ করতে পারে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে আগামী কয়েকদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে বজ্রপাত, প্রবল বর্ষণ, ঝড়ো বাতাসসহ উপকূলে জোয়ারের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেতে পারে।
আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক পিএইচডি গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশের মতে, ঘূর্ণাবর্তটি অবস্থান করছে দক্ষিণ বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান সাগরের সন্নিহিত এলাকায়। এটির গতিপ্রকৃতি নিয়ে আমেরিকা ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেলগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে যে, গত শনিবার ঘূর্ণিঝড়টি সৃষ্টির প্রাথমিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। গত রবিবার সেটি ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়টির স্থলভাগে আঘাত করার সময় তিন দিন পেছানোর পাশাপাশি সেটির গতিমুখও পরিবর্তন হয়েছে। আগামী ১৪ মে সকাল থেকে ভারত ও বাংলাদেশের সুন্দরবনের ওপর দিয়ে (ইউরোপিয়ান মডেল অনুসারে) ও আমেরিকান মডেল অনুসারে আগামী ১৩ মে দুপুরের পর থেকে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী উপকূল দিয়ে স্থলভাগে আঘাতের আশঙ্কার কথা নির্দেশ করছে। ঘূর্ণিঝড়টি স্থলভাগে আঘাত করার সময় বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ উঠতে পারে ঘণ্টায় একশ’ থেকে একশ’ ৩০ কিলোমিটার। ইউরোপিয়ান মডেলের পূর্বাভাস সঠিক প্রমাণিত হলে ঘূর্ণিঝড়টি সাতক্ষীরা, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের জেলাগুলো লÐভÐ করে দিতে পারে। পক্ষান্তরে আমেরিকান মডেলের পূর্বাভাস সঠিক প্রমাণিত হলে চট্টগ্রাম বিভাগের জেলাগুলোতে প্রভাব বেশি পড়বে।
ফ্ল্যাশব্যাকে চোখ রাখলে ট্র্যাক রেকর্ডটা এই রকম- ২০০৯ সালের ২৫ মে ধেয়ে এসেছিল প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’। যার বীভৎস ধ্বংসযজ্ঞে চিরচেনা রূপ হারিয়েছিল সুন্দরবন। এরপর ১১ বছরের ব্যবধানে ২০২০ সালে এই অঞ্চলে পুনরায় আছড়ে পড়েছিল ‘আম্ফান’। সেটাও ছিল ২০ মে। পরের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালের ২৬ মে হাজির হয়েছিল ‘ইয়াস’। এবার আসছে ‘অশনি’। নামটি শ্রীলঙ্কার দেয়া। ‘অশনি’ মানে ক্ষুব্ধ। গতকাল সন্ধ্যায় এ প্রতিবেদন লেখার সময় ঘূর্ণিঝড়টি দেশের বিভিন্ন সমুদ্রবন্দর থেকে হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দূরত্বে অবস্থান করছিল। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর উত্তাল রয়েছে। এ কারণে চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর এবং কক্সবাজার উপক‚লকে এক নম্বর দূরবর্তী সতর্ক সঙ্কেত পাল্টে দুই নম্বর নৌ হুঁশিয়ারী সঙ্কেত দেখাতে বলা হয়েছে। উত্তর বঙ্গোপসাগের অবস্থানরত সকল মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে উপক‚লের কাছাকাছি এসে সাবধানে চলাচল করতে বলা হেয়েছ। সেইসাথে তাদেরকে গভীর সাগরে বিচরণ না করতে বলা হয়েছে।