অপেক্ষা

36

সিরাজুল ইসলাম সোহাগ

স্বভাবতই তাড়াহুড়ো আর অস্থির চিত্ত স্বভাবের জন্য সমালোচিত আনোয়ার। পড়াশোনা, চলাফেরা এমনকি খাওয়া-দাওয়ার বেলায়ও চঞ্চলতা চপলতা আচ্ছন্ন করে রাখে তাকে। মা বারবার বলে থাকে জীবনকে জীবনের মতো পরিচালিত করতে গেলেও অস্থিরতা বর্জন করে শান্ত-স্থির আর অক্ষয় স্বভাবকে চিত্তে ধারণ করা শ্রেয়।
একমাত্র সন্তান হওয়ায় তাঁকে ঘিরে আদর-সোহাগ-স্নেহের কমতি ছিল না। মা, আনোয়ারা বেগম, ছেলের ডানপিটে, অস্থির আর বেয়ারা স্বভাবের জন্য পুত্রকে দেয়া মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসা আর নিজের অপত্য স্নেহকেও দায়ী করেন!
খেলাধুলা শেষে দৌড়ে এসে মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ার মুহূর্তে আনোয়ার মাঝেমধ্যেই মাকে বলে থাকে মা, ইদানীং আমার শ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হয়।
খেলাধুলায় লম্পজম্প করে শরীরে ক্লান্তি চেপে বসার দরুনই হয়তো একটু স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাসে বিঘ্ন ঘটে -এমনটা ভেবে মা আনোয়ারা বেগম খুব আমলে নেন নি বিষয় টা।
এক রাতে আনোয়ার হঠাৎ বিকট চিৎকারে পুরো বাড়ির সবাইকে জাগিয়ে তুললো। মা-বাবা বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে চললো ছেলের ঘরে।
শ্বাস নিতে পারছি না…., আমি মরে যাচ্ছি…., মা আমি বাঁচতে চাই….., আমাকে বাঁচাও…… এমনসব আকুতি আর্তচিৎকারে পুরো বাড়ির আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করছে আনোয়ার। স্নেহের কমতি রাখেন না যাকে ঘিরে সেই আদরের ছেলের মুখে এমন আহাজারি আনোয়ারা বেগম এর পৃথিবীতে বিধ্বংসী ভূকম্পন সৃষ্টি করেছে।
বাবা সেকেন্দার আলী ইতোমধ্যে এম্বুলেন্স নিয়ে হাজির। পলকেই মেডিকেলের পথ ধরে এগিয়ে চললো এম্বুলেন্স। এমারজেন্সি সাইরেনের বিকট শব্দ আনোয়ারা বেগম এর কাছে ছেলের অবস্থা যে বেগতিক ঠিক তাঁরই যেন জানান দিচ্ছে।
মায়ের অব্যক্ত আর্তচিৎকার মহান আল্লাহর দরবারে আরতি জানাতে জানাতে মেডিকেল বারান্দায় এসে হাজির এম্বুলেন্স।
মেডিকেল বারান্দায় উপস্থিত কর্তব্যরত কর্মীগণ স্টেচারে আনোয়ারকে জরুরি বিভাগে নিয়ে চলে যাচ্ছিলো। তখনও আনোয়ার হাত টা ধরে রেখেছে মায়ের। কোথা থেকে আগš‘কের মতো এক নার্স এসে হাতটা ছাড়িয়ে দিয়ে স্টেচার ঠেলে সামনের দিকে নিয়ে চলে গেল।
প্রায় এক ঘণ্টার পর্যবেক্ষণ শেষে গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলানো দাড়ি ভর্তি এক ডাক্তার এসে বললো- আনোয়ারের জরুরি অপারেশন লাগবে। ওর শ্বাসপ্রশ্বাসের নালীতে ছোট টিউমার দেখা গেছে!
মা আনোয়ারা বেগম এর হৃদ স্পন্দন পূর্বের চেয়েও বহুগুণ বিবর্ধিত হয়ে গেল।
যে আনোয়ারা বেগম,মানুষের দুঃখ-কষ্টে দুঃখিত, ব্যথায় ব্যথিত, বেদনায় নীল, শোকে শোকার্ত হয়ে দু‘চোখের কূল ভাসিয়ে শ্রাবণের ভারী বর্ষণের মতো শিক্ত আর্দ্র নয়নে মাঝেমধ্যেই হতাশা আর অনিশ্চিত আশঙ্কায় আচ্ছন্ন মানুষ কে আশার বাণী শোনান সেই বৃহৎ সাগরসম হৃদয় যেন আজ কাঁদতে ভুলে গেছে। আশেপাশে এতো এতো মানুষ, পরিচিত অপরিচিত শুভাকাক্সক্ষী এসে ভিড় জমাচ্ছে ওয়েটিং রুমে। সবাই সান্ত¡নার বাণীর সঙ্গে সঙ্গে খোদার দরবারে এই চঞ্চল চপল আর দুষ্টু ছেলেটির জন্য প্রার্থনা করছে অনবরত।
কিন্তু একি!
আজকে এতোগুলা শুভাকাঙ্ক্ষীর মুখ নিসৃত আশার বাণী আনোয়ারা বেগম এর কাছে আশঙ্কায় পূর্ণ মনে হচ্ছে!
আনোয়ার বেগম ভালো করেই জানেন, যে জীবন সৃষ্টি সুখের সে জীবন সমুদ্রে মাঝেমাঝে জলোচ্ছ¡াস ওঠে জীবন তীরে আঘাত হেনে গতিশীল জীবনে কিছু টা স্থবিরতা নিয়ে আসে।
হ্যাঁ,
জীবনে ক্ষয় আছে,
তেমনি আছে জয়ও!
আছে আশঙ্কা সঙ্গে আশাও।
এই দুর্বোধ্য আর কুটিলতায় পূর্ণ পজিটিভ প্রত্যাশার বাণীগুলো আনোয়ারা বেগম ভালো বুঝলেও তাঁর সদ্য কৈশোরে পদার্পণ করা ছেলেটা যে বুঝে না। তাঁর আত্মোপলব্ধি যে এখনো অপরিপক্ব।
কেমন আছে সে?
ডাক্তারই বা এতো সময় কেন নিচ্ছে?!
খোদার দরবারে অনবরত আরতির সঙ্গে সঙ্গে উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় ভরা মনের কোণে উঁকি দিচ্ছে কত কথা-
“কি বিপন্ন দিন আমার
কি বিষাদের রাত্রী, কি দহনের কাল”
বাসা থেকে আসা উপস্থিত অন্যান্য সদস্যদের থেকে অনেকটা দূরে বসে এমন সব চিন্তায় মগ্ন ছিল আনোয়ারা বেগম।
হঠাৎ কাঁধের উপর একটা আগন্তুকের হাতের পরশ পরলো। এই স্বল্প সময়ে অনেকেই
নির্মল হাতের পরশে ভ্রম কেটে নিজেকে কিছুটা আবিষ্কার করলেও এবার যেন নিজেকে পুরোপুরি আবিষ্কার করলো।
কারণ এ হাত যে নিভর্রতার হাত,
এ হাত যে আস্থা আর ভালোবাসায় পরিপূর্ণ,
যে হাত আজ একুশ টা বছর আগলে রেখেছে তাঁকে।
নিজের ভ্রমকে বিসর্জন দিল যে হাত, সে হাত টা ধরেই হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে দিলো আনোয়ারা বেগম। এতোক্ষণ ব্যথা, বেদনা আর আশঙ্কার ঘোরে যেন পাথর হয়ে গেছিলো মন-মনন। যে চোখটাকে তাঁর এতোক্ষণ পাষাণ মরুভূমি মনে হচ্ছিলো সেই চোখের দু’কূল ছাপিয়ে হঠাৎই যেন শ্রাবণের খরগ্রোতার ন্যায় প্লাবন নেমে আসলো।
আনোয়ারা বেগমের আহাজারি আর আর্তনাদ মিশ্রিত চোখের পানিতে সেকেন্দার আলীর শার্ট ভিজে গেল।
সেকেন্দার আলী স্ত্রীকে বুকে জড়িয়ে নিজেও ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলেন।
বিরহ-বেদনা আচ্ছন্ন গুমোট পরিবেশে হঠাৎই এক নার্স এসে খবর দিয়ে গেল- আনোয়ারকে কেবিনে ট্রান্সফার করা হয়েছে।
আপনারা এখন বাইরে থেকে দেখতে পারেন।
আনোয়ারা বেগমের বুকে যেন একটু আশার আলো ঝলক দিয়ে উঠল। যাক অন্তত দেখতো পাবো আমার বুকের ধন, নয়নের পুতলিকে।
কেবিনের বাইরে ট্রান্সপারেন্ট গদ্বাসের বাইরে থেকে আনোয়ার কে নিথর ভাবে শুয়ে থাকতে দেখে আনোয়ারা বেগমের পৃথিবী যেন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিলো। যে ছেলে বরাবরই চঞ্চলতা চপলতা আর বুনো উল্লাসে দ্বিকবিদিক দাপিয়ে বেড়ায় সে আজ ছোট এনেস্থিসিয়ার কবলে কুপোকাত!
সে আজ কৃঙ্খল বদ্ধ হয়েছে অজানা উদ্ভত জরা-ব্যাধির বেড়াজালে!
বাইরে কখন বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে খেয়াল করেনি আনোয়ারা বেগম।
নিরবচ্ছিন্ন ফোঁটায় ফোঁটায় স্যালাইন চলছে আনোয়ারের শরীরে। আনোয়ারা বেগমের বুকে ছেলে কে জরিয়ে ধরার প্রবল আকুতি চেপে বসলেও হাজারো বাঁধা যেন রুদ্ধ করে রেখেছে মা-সন্তানের স্বর্গীয় বন্ধনকে।
রৌদ্রজ্বল তাপীয় দিনের শেষে প্রকৃতির আর্দ্রতা কমে আসলে মানব শরীর যেন ক্লান্তি-অবসাদ কে বিদায় জানাতে প্রস্তুত হয়। ক্লান্তি উপশমে উপস্থিত সবার চোখে ঘুম ভর করেছে প্রবল ভাবে। কিন্তু বৃষ্টিস্নাত আর্দ্র গভীর রজনীতে যখন প্রকৃতি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হওয়ার বার্তা দিচ্ছে, তখন উপস্থিত সবার চোখে ঘুম ভর করলেও আনোয়ারা বেগমের চোখকে স্পর্শ করতে পারেনি।
অপলক দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে মন কে এই বলে প্রবোধ দিচ্ছে-
এমনি এক দুরারোগ্য রাতে
ভুগছে এমন একটা জীবন
যে জানে না জীবন মানে ক্ষয়,
জীবন মানে জয়,
জীবন মানে চঞ্চলতা-চপলতা নয়,
জীবন মানে অনন্ত অপেক্ষা
আর অফুরন্ত মরণের পৌনঃপুনিকতা।