‘অন্যের ঝামেলায়’ শেষ হয়ে গেল খাতুনগঞ্জের ‘মাঝি’

30

মনিরুল ইসলাম মুন্না

চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে ১০-১৫ জন শ্রমিকের নেতৃত্ব দিতেন মো. মাসুদ। ট্রাক থেকে পণ্য উঠানামার জন্য ব্যবসায়ীরা তার খোঁজ করতেন। নিজে পণ্য উঠানামানোর পাশাপাশি অন্যান্য শ্রমিকদের মাধ্যমেও পণ্য লোড-আনলোড করাতেন। তাই তিনি শ্রমিকদের ‘মাঝি’ হিসেবে পরিচিত। ৪৫ বছরের মাসুদ দীর্ঘ ২৫ বছর চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে সুনামের সাথে শ্রমিক ও মাঝির কাজ করে এসেছেন। দৈনিক যা আয় হতো তা দিয়ে তাদের সংসার চলত।আয়ের চাকা একদিন বন্ধ থাকলে সংসারের চাকাও ঘুরত না মাসুদের। এখন মাসুদ নেই। দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে না ফেরার দেশের বাসিন্দা হয়েছেন। এই অবস্থায় তার সংসারের কি হবে? কে টানবে সংসারের ঘানি? এই প্রশ্ন এখন শ্রমিকদের। এখন ঘোর অনিশ্চয়তায় তার পরিবারের সদস্যদের ভবিষ্যৎ।
গতকাল বুধবার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের সামনে তার ছেলে মো. বাবর প্রকাশ বাবুল (২১) পূর্বদেশকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, গত সোমবার যে ঘটনাটি ঘটেছে, তা আমার বাবাকে ঘিরে হয়নি। অন্যজনের সাথে ঝামেলা তৈরি হয়েছিল। এতে জড়িয়ে যান আমার বাবা। অথচ তিনি এসবের সাথে জড়িত ছিলেন না। আমার বাবা সমাধান করতে গেলে পিকআপ চালক মোহাম্মদ রাসেলসহ ১০-১২ জন এসে ছুরিকাঘাত করে। পাশাপাশি কিল-ঘুষি মারে। এতে তিনদিনের মাথায় আমার বাবার মৃত্যু হয়।
জানা যায়, মাসুদের নিজ বাড়ি ভোলা জেলার দৌলতখান উপজেলার দলিকার হাট পুরান সিকদার বাড়িতে। স্ত্রী বকুলের ঘরে দুই সন্তান রয়েছে মাসুদের। বড় ছেলে মো. বাবর (২১) ও ছোট মেয়ে ময়না (৯)। তারা ঢাকার সভারের নবীনগর রাজাসন ফুলের মার্কেট এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন। মাসুদ একা খাতুনগঞ্জ এলাকায় বসবাস করতেন। মাসে ৩-৪ দিন ঢাকায় অবস্থান করতেন। দৈনিক যা আয় হতো, তা জমা করে রাখতেন। ঢাকায় গেলে স্ত্রী-সন্তানের হাতে টাকা তুলে দিতেন। এই দিয়ে চলত তার সংসার।
কথা হয় মাসুদের শ্যালক মো. রাসেলের সাথে। তিনি পূর্বদেশকে বলেন, আমরা ভাই-বোন আগে থেকে একসাথে থাকতাম। ফলে বড় বোন বকুল (মাসুদের স্ত্রী) চট্টগ্রামে থাকতে চাইতেন না। তার স্বামী চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে শ্রমিকের কাজ করলেও প্রতিদিন আমাদের সাথে যোগাযোগ হতো। খুব শান্তশিষ্ট স্বভাবের অত্যন্ত ভদ্র প্রকৃতির মানুষ ছিলেন আমার দুলাভাই। কিন্তু সামান্য একটা ঘটনা যে তার মৃত্যু ডেকে আনবে তা কখনো কল্পনাও করিনি। হাসপাতালে আইসিইউতে থাকাকালীন খুব কষ্ট পেয়েছেন তিনি। মৃত্যুর আগে আমাদেরকে কিছু বলেও যেতে পারেননি।
মো. মাসুদের ছেলে বাবুল বলেন, আমরা পিতা হারিয়ে এখন অসহায়। আমাদের কি হবে? আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবো ? বাবা হারিয়ে পথে পথে ভিক্ষা করা ছাড়া আমাদের কোনো উপায় নেই। পুলিশ ও প্রশাসনের কাছে আমার দাবি- যারা আমাদেরকে এতিম করেছে তাদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি যেন প্রদান করে।
উল্লেখ্য, গত সোমবার সন্ধ্যায় খাতুনগঞ্জের চাঁন মিয়া গলিতে শ্রমিক মাসুদ দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হলে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গতকাল বুধবার সকালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। শ্রমিকদের অভিযোগ, সোমবার সকালে পণ্য নিয়ে খাতুনগঞ্জে যাওয়া এক পিকআপ চালকের সঙ্গে মালামাল ওঠানামার কাজে নিয়োজিত এক শ্রমিকের ঝগড়া হয়। এর জের ধরে সন্ধ্যায় ওই পিকআপ চালক ‘কিশোর গ্যাং’ নিয়ে এসে মাসুদের ওপর হামলা করে।
কোতোয়ালী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) জাহিদুল কবীর পূর্বদেশকে বলেন, হামলায় আহত মাসুদকে চমেক হাসপাতালের ২৭ নম্বর সার্জারি ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছিল। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছিল। অস্ত্রোপচারের পর তাকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে আজ (বুধবার) ভোরে তার মৃত্যু হয়। হামলার ঘটনার পর তার ছেলে বাদি হয়ে কোতোয়ালী থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। ঘটনার পর থেকে খাতুনগঞ্জ এলাকায় আমাদের একাধিক টিম পিকআপ চালক রাসেলকে ধরার চেষ্টা চালাচ্ছে। শীঘ্রই তাকে আইনের আওতায় আনা হবে।
যে কারণে হামলা করা হয় মাসুদকে
মাসুদের ছেলে বাবুল পূর্বদেশকে বলেন, পিকআপ চালক মোহাম্মদ রাসেলের সাথে আরেক শ্রমিক গিয়াস উদ্দিনের ঝামেলা ছিল। সোমবার রাসেল গিয়াস উদ্দিনকে না পেয়ে আমার বাবার সাথে কথা বলতে চায়। বাবা বিষয়টি এড়িয়ে চলে যেতে চাইলে রাসেল ধাক্কা মারে। এনিয়ে বেশ কিছুক্ষণ কথা কাটাকাটি হয়। সন্ধ্যায় রাসেল ১০-১২ জনের কিশোর গ্যাংয়ের একটি টিম নিয়ে এসে বাবার উপর হামলা চালায়। এতে কিল-ঘুষির পাশাপাশি তাকে শরীরের চার জায়াগায় ছুরিকাঘাত করা হয়। এ অবস্থায় তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লে হামলাকারীরা পালিয়ে যায়। পরে স্থানীয়রা বাবাকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করান’। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল সকালে তিনি মারা যান।