অটিজম শিশুরাও হতে পারে দেশের সম্পদ তার জন্যে চাই আর দশটা শিশুর মতো স্নেহ-ভালোবাসা

71

এমরান চৌধুরী

পৃথিবীর প্রত্যেক মা-বাবাই চায় তাঁদের শিশুটি সুন্দর, সুস্থ, চটপটে, হাসিখুশি,উচ্ছল হয়ে বেড়ে উঠুক। তাঁদের শিশুটি হোক দেখতে পরির মতো সুন্দর কিংবা পঙ্খিরাজে সওয়ার বেপরোয়া রাজকুমারের মতো। আর শিশুটি যখন স্কুলে যাবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে পড়ালেখা করবে তখন সে আভির্ভূত হোক ধীমান হিসেবে। প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা আর বুদ্ধিমত্তায় সে হয়ে উঠুক সবার সেরা। আর কর্মজীবনে হয়ে উঠুক একজন সেরা ব্যবসায়ী, একজন প্রকৌশলী কিংবা চিকিৎসা জগতের একজন সেরা ডক্টর। কোনো মা-বাবাই চায় না তাঁদের শিশুটি বাক, শ্রবণ বা শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে বেড়ে উঠুক। একটি শিশু প্রতিবন্দ্বী হওয়া মানে একটি পরিবারের জন্য তা সীমাহীন দুর্ভোগের। কারণ শিশুটিকে দেখাশোনার জন্য পরিবারের মা-বাবার পাশাপাশি, পরিবারের অন্য সদস্যদেরও বাড়তি শ্রম, অর্থ ব্যয় করতে হয়। এই বাড়তি শ্রম, অর্থব্যয় দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতেও ফেলে বিরূপ প্রভাব। কিন্তু মা-বাবার কাঙক্ষিত না হলেও কোনো কোনে মায়ের কোলজুড়ে আসে এমন কিছু শিশু যাদের মাঝে অসম্পূর্ণ থেকে যায় মানব শিশুর আচরণগত কোনো না কোনো উপাদান।
গত ২ এপ্রিল ছিল বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস। এখন থেকে তেরো বছর আগে ২০০৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে এই দিনটি পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতিবছর জাতিসংঘের সদস্যদেশসমূহে সরকারিভাবে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। জাতিসংঘ স্বাস্থ্যসংক্রান্ত যে সাতটি দিবস পালন করে তারমধ্যে বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস অন্যতম। মানসিক প্রতিবন্ধিত্ব বা শিশুদের মানসিক বিকাশজনিত সমস্যা নিয়ে মা-বাবা, অভিভাবক তথা সমাজের করণীয় সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টিই হলো এই দিবস পালনের উদ্দেশ্য। কিন্তু এ বছর সারা বিশ্বব্যাপী চলছে করোনা ভাইরাসের ভয়াবহ তাÐব। এ তাÐবে দিবসটি যেভাবে পালন হওয়ার কথা তা করা মোটের ওপর সম্ভব নয়। ফলে দিনটি মূলত বিভিন্ন মিডিয়ায় সীমাবদ্ধ থেকে গেছে। তবে বর্তমান সময়ে তথ্যের অবাধ আদান প্রদানের সুযোগ থাকায় ঘরে বসেও অটিজম বিষয়ে মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করা যায়। যে ঘরে অটিজম শিশু আছে তার মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন এবং এদেশের সচেতন নাগরিক সমাজ যদি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে তাহলে তারাও অন্য শিশুদের মতো সমান স্নেহ ও আদর পাওয়ার অধিকার রাখে।
অটিজম শব্দটি গ্রীক শব্দ থেকে আগত, যার অর্থ আত্ম বা নিজ। অর্থাৎ নিজকে নিয়ে বিভোর থাকা। এ জাতীয় শিশু একা একা নিজের সঙ্গে কথা বলে। নিজের জগতে বিচরণ করে। নিজের চাওয়া পাওয়া নিয়ে মা-বাবা, ভাই-বোন বা পরিবারের কোনো সদস্যের সঙ্গে ভাব বিনিময় করে না। এসব শিশুদের চলাফেরায় এক ধরনের অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করা যায়। তবে এটি কোনো বংশগত বা মানসিক রোগ নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও আমেরিকান সাইকিয়াট্টিক এসোসিয়েশন অটিজমকে শিশুর বিকাশজনিত সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এটি শিশুর স্নায়ুর বিকাশজনিত সমস্যা। এখানে স্নায়ু শব্দটি স্নায়ুতন্ত্র বা মস্তিষ্কের সঙ্গে স্নায়ুর সম্পর্ক বোঝায়। বিকাশজনিত শব্দটির মাধ্যমে শিশুর বিকাশ প্রক্রিয়াকে বোঝায়। প্রাক শৈশবকাল থেকে এই সমস্যাটি শুরু হয়, যা শিশুর স্বাভাবিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। সাধারণত শিশুর দেড় বছর বয়স থেকে তিন বছরের মধ্যে অটিজমের লক্ষগুলো প্রকাশ পায়। অটিজমের প্রাথমিক ও সাধারণ পর্যায়ের যে সব লক্ষণের কথা জানা যায় তা হলো :
কোনো শিশু এক বছর বয়সের মধ্যে বা বা, দা দা, মা মা উচ্চারণ করতে না পারা,
দুই বছর বয়সের মধ্যে অর্থপূর্ণ দুটো শব্দ দিয়ে কথা বলতে না পারা,
চোখে চোখ না রাখা,
 নাম ধরে ডাকলে সাড়া না দেওয়া,
অন্যের সাথে মিশতে না চাওয়া, আদর দিতে বা নিতে না চাওয়া,
 হঠাৎ করে উত্তেজিত হয়ে ওঠা,
পছন্দের জিনিস অন্যের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে না পারা,
 আনন্দের বিষয় অন্যদের সঙ্গে প্রকাশ করতে না পারা,
 শব্দ আলো ইত্যাদি বিষয়ে কম বা বেশি প্রতিক্রিয়া দেখানো।
উপর্যুক্ত লক্ষগুলো সাধারণত তিন বছর বয়সের মধ্যে দেখা যায়। ক্ষেত্রবিশেষে পরেও দেখা দিতে পারে। তবে বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে উপর্যুক্ত কোনো লক্ষণ অল্প সময়ের জন্য কোনো শিশুর মধ্যে দৃশ্যমান হলেই ধরে নেওয়া যাবে না শিশুটির মধ্যে অটিজম আছে।
অটিজম কেন হয় এই বিষয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এখনো পর্যন্ত কোনো একক কারণ চিহ্নিত করতে পারেননি। তবে অটিজম হওয়ার কারণ হিসেবে বিষেষজ্ঞগণ কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করেছেন। তাঁদের মতে
ডেলিভারিজনিত জটিলতার কারণে মস্তিষ্কে পর্যাপ্ত পরিমাণ অক্সিজেন সরবরাহ না হওয়া,
জন্মকালীন সমস্যা, যেমন : দীর্ঘসময়ব্যাপী প্রসব, জন্মকালীন সময় ট্রমা বা ফরসেফ ডেলিভারি এবং জন্মের বেশ পূর্বে পানি ভেঙে যাওয়া,
জন্ম পরবর্তী সমস্যা, যেমন : মাথায় আঘাত ও সংক্রমণ, খিঁচুনি ও দারিদ্র্য,
পরিবেশগত সমস্যা, যেমন : গর্ভকালীন মায়ের স্বাস্থ্য, মায়ের পুষ্টিহীনতা, এক্সরে রেডিয়েশন, সন্তান জন্মের সময় মায়ের বয়স, মায়ের আবেগ ও কর্ম পরিবেশই অটিজমের জন্যে দায়ী।
কোনো শিশুর মধ্যে অটিজমের কিছু ল²ণ প্রকাশ পেলেই তার অটিজম আছে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। এ সিদ্ধান্তটি দিতে পারেন কেবলমাত্র বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। এজন্য অটিজমের আশংকা আছে এমন শিশুটিকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। কেবলমাত্র অটিজমে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকই সিদ্ধান্ত দিতে পারেন আপনার শিশুটির মধ্যে অটিজম আছে কিনা। যদি আপনার শিশুর মধ্যে অটিজম থাকে হতাশ না হয়ে মনকে শক্ত করে শিশুটিকে আগলে রাখতে হবে। এ ব্যাপারে একজন অভিভাবক হিসেবে আমাদের করণীয় হবে :
লক্ষণগুলো গোপন না রাখা
অযথা বিভ্রান্তি থেকে দূরে থাকা,
পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সমস্যাটি নিয়ে আলোচনা করা ও সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা,
 ধৈর্য ধরা, সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া, শিশুকে সামাজিকতা শিক্ষা দেওয়া,
শিশুর সঙ্গে খেলা, শিশুকে খেলতে দেওয়া,
শিশুকে ভাষা শেখানো, শিশুর জন্য শব্দ ভাÐার ব্যবহার করা,
শিশুকে ব্যক্তিগত কাজ শেখানো, শিশুর ইচ্ছা ও শখকে প্রাধান্য দেওয়া,
শিশুর মা-বাবা হিসেবে অটিজম বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়া, দিনলিপি সংরক্ষণ করা ও চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।
বর্তমান বিশ্বে অটিজম শিশুর সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশেও এ সংখ্যা খুব একটা কম নয়। এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় বিশ্বে প্রতি ১১০ জন শিশুর মধ্যে ১ জন অটিজমে ভুগছে। সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশের ৯.৭ শতাংশ মানুষ প্রতিবন্ধী। আন্তর্জাতিকভাবে কোনো দেশের মোট প্রতিবন্ধীর ১ শতাংশকে অটিজমের শিকার বলে ধরে নেওয়া হয়। আর বাংলাদেশে এ সংখ্যা দেড় লক্ষ। এসব শিশুদের নিয়ে আমাদের অনেক বেশি সচেতন হতে হবে। সংখ্যায় দেড় লক্ষ হলেও এদের জন্য আরও দেড় লক্ষ মানুষকে লেগে থাকতে হয় তাদের দেখাশোনা ও সেবাযত্নের জন্যে। এই বিপুল জনগোষ্ঠী যদি শুধুমাত্র অটিজমের কারণে পিছিয়ে থাকে তাহলে আমাদের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। সামগ্রিক উন্নয়নের লক্ষ্য পূরণে অটিজম শিশুদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। তাই অটিজম শিশুদের আস্থা ও চাহিদা অনুযায়ী সেবা প্রদান, শিশু স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মোতাবেক ওষুধ সেবন, প্রয়োজন অনুযায়ী ফিজিওথেরাপী, স্পীচ থেরাপী, অকুপেশনাল থেরাপী প্রদান ও বিশেষায়িত স্কুলে বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদান করলে তারা তাদের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের মাধ্যমে সমাজে ব্যাপক অবদান রাখতে পারে। আশার কথা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের সুষম উন্নয়নের লক্ষ্যে শারীরিক ও মানসিকভাবে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুযোগ্য কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল বিশ্বব্যাপী অটিজম শিশুদের নিয়ে কাজ করছেন। আমাদের মনে রাখতে হবে অটিজম শিশুরাও হতে পারে দেশের সম্পদ। এজন্যে চাই বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের প্রতি অন্য দশটা শিশুর চেয়ে বেশি আদর, স্নেহ ও ভালোবাসা। তবেই আমরা পেতে পারি কার্টুন ছবির আবিষ্কারক সাতসি তাহরি, তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন, বিশ্ববিখ্যাত কমেডিয়ান চার্লি চ্যাপলিন, বিববর্তনবাদের জনক চার্লস ডারউইন, কবি ও নাট্যকার উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস, ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী আইজাক নিউটন, বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী ডারিল হান্না ও আমেরিকান গায়ক বব ডিলানের মতো এর মতো অসাধারণ ও কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব, যাঁরা অটিজম নিয়ে জন্ম নিলেও নিজেদের মেধা ও সৃজনশীলতায় অটিজমকে পরাস্ত করেছেন।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক