অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা রোধে জনসচেতনতার বিকল্প নেই

15

সম্প্রতি দেশব্যাপী অগ্নি দুর্ঘটনা এক নতুন সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে শীতের শেষে আর বসন্তকালজুড়ে চট্টগ্রাম-ঢাকাসহ দেশের কোথাও না কোথাও অগ্নিকাণ্ডে ভস্মীভূত হচ্ছে কল-কারখানা, বস্তি, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ও বসতবাড়ি। হতাহত হচ্ছে শত শত মানুষ। ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছে হচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদ। অনেকেই অগ্নিদগ্ধ হয়ে বিভীষিকাময় জীবন অতিবাহিত করছেন। কয়েকবছর আগে ঢাকার চকবাজার, কাউরান বাজার, চট্টগ্রামের জহুর হকার মার্কেট, চাকতাই, স¤প্রতি ঢাকার গুলশানে, চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লাসহ বিভিন্ন জায়গায় ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার জন্য কেউ কেউ আধুনিক প্রযুক্তিকে দোষছেন, কেউ অসচেতনতাকে দোষছেন। প্রকৃতপক্ষে অগ্নি দুর্ঘটনার পেছনে প্রযুক্তি নয় দায়ী মানুষের অসাবধানতা ও অসচেতনতায় দায়ী। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের হিসাব মতে বছরে অন্তত ১৬ হাজার অগ্নিকাÐের ঘটনা ঘটছে। গত ৮ বছরে সারা দেশে ১ লাখ ৩০ হাজার ২১৫টি অগ্নিকাÐের ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছে ১ হাজার ৯২৮ জন। আহত হয়েছে ১২ হাজার ৮২৫ জন। ওই সময়ে আনুমানিক ক্ষতির পরিমাণ সোয়া ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি বলে এক পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়েছে। অনেক ঘটনা পরিসংখ্যানের বাইরে রয়ে যাওয়ায় প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি বলে ধারণা করছেন গবেষকরা। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এবং পুলিশ সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী ২০১৫ সালে সর্বাধিক অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয় বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে। এ সংখ্যা ৫ হাজার ৯২৩টি।
দ্বিতীয় কারণ ছিল রান্নার চুলা থেকে সৃষ্ট আগুন। ৩ হাজার ৩৬৬টি অগ্নিকাণ্ড হয়েছে রান্নার চুলা থেকে। সিগারেট থেকে ২ হাজার ৫৩২টি, শিশুদের আগুন নিয়ে খেলার কারণে ৫২৬টি, যন্ত্রাংশের সংঘর্ষজনিত কারণে ২৪৪টি, অগ্নিসংযোগে ২৩৮টি, মানবসৃষ্ট হাঙ্গামায় ৯৬৩টি, মিস ফায়ারে ৫৯২টি এবং বাকিগুলো অন্যান্য কারণে সংঘটিত হয়। এসব ঘটনার প্রায় ৮০ ভাগই অসাবধানতা ও অসতর্কতার কারণে ঘটেছে। বড় অগ্নিকাÐগুলো ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির কারণে সবার দৃষ্টি কাড়লেও প্রকৃতপক্ষে প্রতিনিয়তই দেশের কোথাও না কোথাও অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটছে। পরিসংখ্যান মতে, সম্প্রতি যেসব অগ্নিকােণ্ডের ঘটনা ঘটছে এর ৬৫ ভাগ ঘটছে বৈদ্যুতিক কারণে। আগুন দুর্ঘটনার কারণ ব্যাখ্যা করে, ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলেন, দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য অফিস, কল-কারখানা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও আবাসিক ঘরবাড়ি। সেগুলোয় ব্যবহৃত হয় লাখ-লাখ কম্পিউটার। কাজ শেষে ব্যবহারকারীরা কম্পিউটার বন্ধ করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সচল থাকে আইপিএসের লাইন। কোনোরকম বৈদ্যুতিক গোলোযোগ হলেই সেসব আইপিএসের মাধ্যমে ঘটে যেতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। বেশ কয়েকটি অগ্নিকাÐের তদন্তে এ ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে। আর গ্যাসজনিত দুর্ঘটনার কয়েকটি কারণের মধ্যে অন্যতম হলো অবৈধ গ্যাস সংযোগে নিম্নমানের মালামাল ব্যবহার। এ ছাড়া পাইপের লিকেজ বা চুলার চাবি নষ্ট হয়ে গেলে, এমনকি গ্যাসের চুলা চালু করে অন্য কাজ বা এর ওপর কাপড় শুকাতে দিলেও অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে। তাই বাসা-বাড়িতে গ্যাসের চুলা ব্যবহার এবং অফিস আদালতে ইলেক্ট্রিক যন্ত্রের ব্যবহারে বিশেষ সতর্কতার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
আমাদের দেশে অগ্নিদুর্ঘটনা রোধ এবং অগ্নিনির্বাপণের চিত্র অগ্নিকাÐের মতই ভয়াবহ। চট্টগ্রাম ও রাজধানী ঢাকায় বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বিল্ডিং কোড মেনে আগুন নেভানোর জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে উল্লেখ থাকলেও অধিকাংশ ভবন মালিক তা মানছেন না। এমনকি বড় শপিং মল ও রেস্টুরেন্টগুলোর ভবন তৈরির সময়ও মানা হচ্ছে না বিল্ডিং কোড। নিয়ম মেনে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান তৈরি না করায় প্রায়ই নগরীর শপিং মলগুলোতে বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে দেখা যাচ্ছে।
এজন্য বেসরকারিভাবেও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা জোরদার করার বিষয়টি এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আগুন লাগলে বরাবরের মতো নগরবাসী শুধু দমকল বাহিনীর ওপর নির্ভর করে বসে থাকে। ফলে আগুনে জানমালের ক্ষতির পরিমাণও কমানো যাচ্ছে না। ফায়ার সার্ভিসের একটি ফিলোসফি হচ্ছে আগুন লাগার প্রথম পাঁচ মিনিট হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ সময়। ছোট একটি আগুনের ঘটনা যদি প্রথম পাঁচ মিনিটে নেভানো সম্ভব হয় তবে সেটি তেমন কোনো দুর্ঘটনা বলেই বিবেচিত হয় না। আর এই পাঁচ মিনিটে স্থানীয়দেরই আগুন নেভানোর কাজটি করতে হবে। এ জন্য ফায়ার বিগ্রেডের ওপর নির্ভর করে থাকলে হবে না। স্থানীয়দেরই আগুন নেভানো বা কমাতে তৎপর হতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষণের।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, আগুনের দুর্ঘটনা প্রতিরোধে দমকল বাহিনীর পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরও নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। একইভাবে আগুন নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষকে আধুনিক যন্ত্রপাতির মজুদ ও প্রশিক্ষিত জনবলে স্বাবলম্বী হতে হবে। আর সরকারি বিভিন্ন উদ্যোগের সঙ্গে বেসরকারি পর্যায় থেকেও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণে জোর দিতে হবে।