কক্সবাজারে একদিন

119

চড়–ইভাতি এবং বনভোজন বাংলাদেশের আনন্দ ফুর্তির একটা অংশ। চড়–ইভাতি, ছোট, কিশোর কিশোরিদের আনন্দের আয়োজন। শিশুকালের মালাপাতি খেলা খেলতে খেলতে উৎসাহী কিশোর কিশোরীরা চড়–ইভাতি, দিকে ঝুঁকে পড়ে। আমরা পাড়ার ছেলে মেয়েরা এখনকার মতো কোঠা ঘরের শক্ত চার দেওয়ালে, মাতা-পিতার কঠোর শাসনে কয়েদীরূপে আবদ্ধ ছিলাম না। তাই দুপুরের সময়টা চাপিয়ে দেওয়া শাসনের পরিবর্তে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে খেলাধুলা; দৌঁড়ঝোঁপসহ দুষ্টুমিতে দিনের বেশীরভাগটা নিঃশেষ হয়ে যেতো। চড়–ইভাতি এবং আভিধানিক অর্থ বা শাব্দিক বিশ্লেষণ খুঁজে না পেলেও এটা আমাদের সাংস্কৃতিক অংশ। দিনদুপুরে ক্লান্ত দেহে যখন ঘরের বড়োরা বিছানায় সুখের ঘুমে গলার ঘোর কাটতো তখন শিশু কিশোরদের ক্লান্তহীন শরীরে ঘুমের কোন প্রবণতা ছিলোনা। মায়ের হাতের বানানো বহনযোগ্য মাটির উনুন (চুলা), খেলার ছোটখাটো হাঁড়িপাতিল এবং ভাগ্যবতি মায়েদের বাঁচানো আলু, শুটকী, পিঁয়াজ, নুন, তেল, চাল সুকৌশলে নিয়ে, শিশুকিশোর-কিশোরীরা বড়–ইভাতি বা খেলায় ব্যাস্ত থাকতো। কেউ কেউ খর খুটো যায় জোগাড় করতো ঝোপ ঝাড় কেটে তা ছোট উনুনে ট্যাঁসেটুঁসে প্রবেশ করিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিতো, পর্যাপ্ত অক্সিজেনের অভাবহেতু ধুয়া ছড়াতো। মুখে ফু দিয়ে আগুন জ্বালাবার ব্যর্থ প্রয়াসে নাকের এবং চোখের পানিতে একাকার হয়ে ওঠতো শিশু-কিশোর কিশোরীরা। কিছুক্ষণে ভাতের হাঁড়ি নামতো আধা ফোঁটা ভাত, আলু আর শুটকী মেশানো তরকারীতে লবণ, তেল মরিচের ও পিঁয়াজের পরিমাণ হয়ত অত্যাধিক নয়ত স্বল্প, তারপরও আধাসিদ্ধ আলু তরকারীতে স্বীয় অভিজ্ঞতার বদনামের চাইতে সুনামের পাল্লার ঝুকটা বেশী। সেই চড়–ইভাতি বা কোঁয়াপাতির আয়োজক ও কর্মীদের আনাগোনা তথাকথিক একগুয়েমী ও আত্মকেন্দ্রিকতার জোরে তাড়া খেয়ে জীবনের জন্য চম্পট দিয়েছে। সেই উপভোগ্যতা এবং সে মজা আর দৃশ্যমান না হয়ে অতীতের ক্ষীণ আভা নিয়ে আমার সমসাময়িক কারো কারো চিত্তে অবস্থান করে থাকলেও থাকতে পারে।
চড়–ইভাতি, উন্নত সংস্করণ হচ্ছে বনভোজন। শীতের হিমেল অবস্থায় পাহাড়ের পাদদেশে ঝোপ-ঝাড় বা বনজঙ্গল কিংবা লতাগুল্মের ছায়া আবৃত্তের মধ্যে আনন্দ ভোজনই হচ্ছে বনভোজন। মোদ্দা কথা হচ্ছে বনভোজন। মনে আছে আমি তখন শিশু অর্থাৎ পঞ্চম শ্রেণিতে বান্ডেল অবৈতনিক মিউনিসিপ্যাল প্রাইমারি স্কুলের ছাত্র। একদিন স্কুলে অনুপস্থিত থাকলে হেড মাস্টারের বেত্রাঘাত কঠোর শাস্তিকে উপেক্ষা করে অগত্যা বনভোজনের বাহানায় বড়োভাই মালেক দাকে উম্মাদ করে ছাড়লাম। আমার জন্য স্নেহের ঘাটতি ছিলোনা বড়ো ভাইয়ের। উনি চট্টগ্রাম ইয়াং স্টারস ক্লাবের নামকরা প্লের্য়া ক্ষীপ্রগতি সম্পন্ন খেলোয়াড রাইট আউট পজিশনে খেলতেন। আমার আবদারের কাছে হার মেনে নিজে বনভোজনে না গিয়ে আমার যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। সরকারের দোকানে পাশে শফিউল্লাহ সওদাগরের ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। ড্রাইভারের সিটের পাশে মক্বুল্লাহ সওদাগর তাঁর বাম পাশে জাকির মোহাম্মদ উনার কোলে আমি। কমিশনার রাজামিঞা তখন অবশ্য ইয়াং স্টারস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক, উনার তত্ত্বাবধানে বনভোজনের আয়োজন। গন্তব্যস্থান রাঙামাটি। সবাই গাড়িতে রক্ষিত ব্যঞ্চে বসেছে। গাড়ির পাগড়ীতে লাউড স্পিকার। হঠাৎ হিন্দ সংগম ছবির গান বেজে ওঠলো। ম্যারি মানকা গঙ্গা, ত্যারি মানকা ঝমুনা তা বোল রাধা বোল সংগম হোগা হে ন্যাহি, আরে বোল রাধা বোল সংগম বোল সংগম হোগা হে ন্যাহি। আরে নেহি নেহি…নেহি। কিছুক্ষণ পর গাড়ির সহকারী লোহার হ্যান্ডেল হাতে ছিদ্রপথে হ্যান্ডেল প্রবেশ করে সর্বশক্তিতে হ্যান্ডেল ঘুরাতে ঘুরাতে গঁ-অ, গঁ-আ শব্দে গাড়ির স্ট্যার্ড হলো। লক্কড় ঝক্কর মার্কা উড়ম ট্রাক যোগে প্রায় ১২.৩০টার দিকে রাঙামাটি পৌঁছে গেলাম মুরগী আলু, ডিম, আগের থেকে পাক করা ছিলো ভাত পাক করতে তেমন বিলম্ব হয়নি। পৌঁছবার পর ডিম, কলা পাউরুটি পরিবেশিত হয়। খালি পেটে যেন অমৃতের স্বাদ প্রাপ্ত হলাম।
খাওয়া পরিবেশনে কোন অনিয়ম পরিলক্ষিত হয়নি। রাজামিঞা (সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার) সাহেবের সিদ্ধান্তই ছিলো সর্ব গ্রহণযোগ্য। সত্যিকার অর্থে এটাই ছিলো বনভোজন।
আমাদের পড়োশী তরুণেরা এমাসে পিকনিকের আয়োজন করেছিল। দিনক্ষণ স্থির হয় শুক্রবার ১০ জানুয়ারি, সময় ছিলো সকাল সাড়ে সাতটায় বেশ ভালো। প্রস্তুতি এগিয়ে চলছে। তথায় যুক্ত হতে মন চায়নি। প্রথমত বয়সের দিকে দিয়ে আমি সর্বজ্যৈষ্ঠ এখন জীবিত থাকলেও মনের দিক থেকে দুর্বল প্রকৃতির। রং ঢং এর ক্ষেত্রে মন এগুতে চায়না। পিকনিকে যাওয়ার অর্থ মরা গাঙ্গে বান আসা। ঐ বান আসলেও কি, না। আসলেও কি ? শুক্রবারে জুম্মাটা মাটি করতে চাইনি। আমার ইচ্ছাহীনতার ওপর বার বার হিট করতে থাকে শুক্কুর, সালাউদ্দিন ওরা বয়সে ছোট। ওদের বাপ মায়ের বিয়ে খেয়েছি। আমার অনিহার হেতু হচ্ছে একেতো প্রচÐ শীত, অন্য কারণ হচ্ছে আমার সমসাময়িক বন্ধুরা কেউ সাথে নেই, শেষ অবলম্বন সহোধর্মিনীও না খাওয়ার পক্ষে। ওরা নাছোড়বান্দা, ফিট করেছে আমার ভাই পো জাহেদকে। কাবুলিওয়ালার মতো আর একটা চিজ শেষমেশ আমাকে দেখবাল করার সার্বিক দায়িত্ব তার স্বীয় স্কন্ধে নিয়ে আমার ঔষধপত্র বøাড প্রেসার মেশিন ডাইবেটিক মাপার যন্ত্র ও কাপড়চৌপড় নিয়ে জোর জবরদস্তি করে বাসে তুলে নিতে সক্ষম হলো। আমার নাসুচক অবস্থানের হেতু হচ্ছে কক্সবাজরে এটা পিকনিক নয় বা বনভোজনের পর্যায়েরও নয়। এটাকে প্রাসাদভোজন বললে অত্যুক্তি হবে না। অর্থাৎ নির্ঘুম রজনীতে পাকশাক করে এবং নাস্তা পানি রেডিমেইট করে বুকিং করা হোটেলে ওঠে ভক্ষণ প্রক্রিয়া সমাপ্ত করে সাগরের ঢেউ প্রত্যক্ষ জল স্পর্শ বা অস্তগামী সূর্য দর্শন বা সকালের উদিয়মান সূর্য প্রত্যক্ষ করা।
সময়মতো হানিফ পরিবহনের বাসটি কোতোয়ালী সীমানা প্রাচীর ঘেষে অবস্থান নেয়। সকাল ৮টার মধ্যে প্রয়োজনীয় মালপত্র এবং যাত্রীদের সবাই যার যার নির্ধারিত স্থানে ওঠে পড়ে। সবার মধ্যে বয়োজৈষ্ঠ হওয়ায় আমার জন্য সামনের দিকের একটি ভালো সিট আগ থেকে সংরক্ষিত ছিলো। তাতেই বসে পড়লাম। আনুমানিক সোয়া আটটার দিকে গাড়ি ছাড়লো ১০ জানুয়ারি শুক্রবার বন্ধেরদিন পথঘাট ফাঁকা দ্রুতগতিতে গাড়ি গন্তব্যস্থানে ছুটে চললো। তারপরও সামান্যের জন্য জুম্মার জামাতে অংশ নিতে পারিনি, এটাই দুর্ভাগ্য। গাড়ি থেকে নেমে আরামগত হোটেলে বরাদ্দকৃত কক্ষে যে যার যার অবস্থানে প্রবেশ করি, আমি উঠে চারতলার ৩০৪ নং কক্ষে। উঠা-নামা করাটা আমার জন্য চ্যালেঞ্জের বিষয়। তারপরও করার কিছুই নেই। হঠাৎ গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে ভাই পোর ফোন। ও বলে ‘আব্বা (ও আমাকে আব্বা বলে সন্বোধন করে) তুঁই কন্ডে নিচে নামো নইলো ভাত ঠাণ্ডা অই যাইবো। আমি বললাম, আঁই আইর, তু-ই আঁর লাই জা-গা রাখ্।
চারতলা থেকে নামতে অসুবিধা হয়নি। ভাই পো আমার জন্য ভাত তরকারী নিয়ে দÐায়মান। ডাইনিং টেবিলের ব্যবস্থা নেই। হাতে বাসন আর একহাতে খাওয়া ক্ষুধার পেটে অমৃতের স্বাদ যেন পেলাম, উপরে আর ওঠা হয়নি শুক্কুর বলে ওঠে, ‘অ-দা আর কষ্ট গরি উ-অরে ন-অ উইট্টো। যা-উ ভাইফুতেরে লই এক্কানা সাগরের পারোত্তুন গুরি আ-ই-উ-গৈ। ক-অ- দিন্না দুনিয়া। তুঁই আইচেচ্যাদে অ-দাদ ব-অর মজা লা-গের। জাহেদকে বলে অ-ভাইফুত যা-যা দাদারে লৈ এ-নে সাগরোত্তুন ইক্কিনী গা-ভিজাই-আ-গৈ। জাহেদের হাত ধরে শিশুর মতো লাবনী পয়েন্টের পথ ধরে চললাম। যেতে যেতে মিছিলের শব্দ, জাহেদের কাছে জানতে চাই অ-ডা কি অর শব্দ ইবা ক-অন ফাটির ? কতদ্দুর যেতেই দেখি সারিবদ্ধ চেয়ারে শ্রোতাদর্শক বসে আছে বিচের বেশ অর্ধেক যেন তাদের দখলে। ওরা সবাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারি।
আনন্দে মনটা ভরে ওঠলো। এখানে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ ফিরতি দিবস পালিত হচ্ছে। মাইকে বক্তৃতা, তরুণ তরুণী এবং স্কুলের শিশু-কিশোর প্রিয় জাতীয় পতাকা হাতে শ্লোগানে স্লোগানে মুখরিত করে তুলেছে। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ মন খুলে উপভোগ করলাম। উপছেপড়া ভিড় আর আনন্দ। ভাই পো কে বললাম অ-ডা ন-অ যাইস। আর ইক্কিনি চা-আতি দেচুনা। তোরার পিকনিকোত্তুনও এ-নডে মজা বেশী। রাঘ রাঘ। কথায় বলে এক টিকেটে দুই মজা। আনন্দে মন ভরে উঠলো। এরা সবাই বাংলাদেশ প্রেমিক। এরা বঙ্গবন্ধুর উত্তম সৈনিক। এদের ক্লান্তি নেই এদের সাহস আছে এরা ভীরু নয়। দেশের তরে এরা নিজকে উৎসর্গ করতে পারবে। ছোটমনিদের পতাকা হাতে এক মিছিল এগিয়ে আসতে দেখলাম ওরা বলতে থাকতো আমার নেতা তোমার নেতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব। আমি বুড়ো লোকটা তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সেøাগান ধরলাম। ওদের একজন বললেন, এ্যাই দাদুকে জায়গা দেয়। বার্ধক্যটা যেন ভুলে গেলাম মুহূর্তে কিছুক্ষণের জন্য শিশুদের সঙ্গে একাকার হয়ে গেলাম। তাদের থেকে শক্তি পেয়ে মুহূর্তের মধ্যে মনটা যেন চাঙ্গা হয়ে উঠলো। এরপর ভাইপোকে নিয়ে সোজা সাগরের কাছাকাছি গেলাম। তখন ভাটার টান। স্থানে স্থানে শর্তকতামূলক পতাকা। তখন পানিতে নামা নিষেধ। তা উপেক্ষা করে কয়েকজন তরুণ সাগরের পানিতে অবস্থান করছে। ভাইপো বললো আব্বা, চলো ফাঁনিত না নামি, আমি বললাম ভাডার মিদ্দে মরতি যাতি ? ইন্ন্দি খাড়া সূর্য কেঁ এনে ডুবে চা-আ কিছুক্ষণ পর সূর্য অস্ত গেলো। দারুণ দৃশ্য। ভাইপোকে সাথে নিয়ে বার্মিজ মার্কেটে গেলাম। কিছু টুকি টাকি কেনাকাটার পর হোটেল কক্ষে অবস্থান, আর কোথাও যাওয়া হয়নি।
লেখক : কলামিস্ট