হযরত শাহসূফী সৈয়দ মুহাম্মদ আবু ছৈয়দ শাহ আল্ আমিরভান্ডারী(রহ.)

233

মহান স্রষ্টা, প্রতিপালক ও লা’শরীক আল্লাহ্পাকের মাহাত্ম্য, মহত্ত¡, গুণ,ক্ষমতা ও কুদরতের ব্যাপ্তি বর্ণনা করা দুনিয়ার কারো পক্ষে কখনো সম্ভব নয়। কিভাবে বিস্ময়কর সপ্তস্তর আকাশ শূন্যে লটকিয়ে রেখেছেন, তা ভাবনার বহির্ভূত ; তবে কিছু নিদর্শন জগতজুড়ে চোখের সম্মুখে দেদীপ্যমান ও অন্তরে অনুভব করা যায়। যারা সত্য ও শাশ্বত পথে আত্মোৎসর্গ হয়ে আল্লাহ্পাকের নিকটজন ; তাঁরা অলি-আল্লাহ্ নামে আখ্যায়িত। আল্লাহর হাবীব ও সমগ্র সৃষ্টির করুণাধারা মহানবী (সা.) এর বংশানুক্রমে সারাজগতের পথহারা মানবকূলের হেদায়তের দিশারী বেলায়তের উত্তরসূরী, নায়েবে আম্বিয়া, হযরত আমিরুল আউলিয়া (ক.) এর প্রপৌত্র, যুগশ্রেষ্ঠ শক্তিধর ও দিগ্বিজয়ী পথপ্রদর্শক-হাদীয়ে জমান, বাবাজান কেবলা হযরত শাহ্সূফী সৈয়দ মুহাম্মদ আবু ছৈয়দ শাহ্ আল্ আমিরভাÐারী (রহ্.)।
আধ্যাত্মিকতার জ্বলন্ত ঐশীর বারতা বইয়ে নেবার একাত্মতায় হযরত আমিরুল আউলিয়া (ক.) বেছাল লাভের পর ১৯২৮ সালে হযরত আমিরুল (ক.) এর দ্বিতীয় পুত্র মাহবুবে ইলাহী খাজা খলিলুর রহমান শাহ্ (ক.) এর ঘরে সৈয়্যদা মেহেরাফজান বিবির গর্ভে জন্মলাভ করেন হাদীয়ে জমান শাহ্সূফী সৈয়্যদ মুহাম্মদ আবু ছৈয়দ শাহ্ আল্-আমিরভান্ডারী( রহ.)। কথিত আছে, মাতা সৈয়্যদা মেহেরাফজানের গর্ভে প্রথম পুত্রসন্তান নাবালক অবস্থায় ইন্তেকালের পর আর কোন সন্তান না হওয়ার প্রেক্ষিতে মানসিক ভারসাম্য ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় আমিরুল আউলিয়া(ক.) এর কাছে কঠোর রেয়াজতের মাধ্যমে আরজি পেশ করতে থাকেন। এমন এক রাতে সৈয়্যদা মেহেরাফজান বিবির চোখ যখন তন্দ্রাগ্রস্ত, তখন দিবালোকের মতো স্বপ্নে আমিরুল আউলিয়া (ক.) তাঁকে দু’টি শশা দিয়ে বললেন- ‘এই দু’টি শশা তুমি ভক্ষণ করিও’
সৈয়দা মেহেরাফজান বিবি আশ্চর্য চোখে ভালোভাবে অবলোকন করতে লাগলেন। হঠাৎ স্বপ্ন ছুটে গেল। রাত গভীর হতে হতে এক সময় ফজরের আযান ধ্বনিত হল। ঘুম থেকে ওঠে নামাজ ও অজিফা পাঠের পর তাঁর সিথানে স্বপ্নদৃষ্টে আমিরুল আউলিয়া (ক.) এর হাত মোবারকের প্রদত্ত শশার অনুরূপ একই আকৃতি,একই রঙের দুটি শশা দেখে পবিত্র মুখে ‘সুবাহানাল্লাহ’ বলে উঠলেন। বিহŸল হৃদয়ে কালক্ষেপণ না করে বিছমিল্লাহ বলে শশা দু’টি আহার করলেন। এর কিছুদিন পর মাতৃগর্ভে হযরত শাহ্সূফী সৈয়দ মুহাম্মদ আবু ছৈয়দ শাহ্ আল্-আমিরভান্ডারী তশরীফ আনেন। যা সকল যুক্তি-বিশ্লেষণের উর্ধ্বে, তর্কের কোন অজুহাত নেই, সৈয়দ মুহাম্মদ আবু ছৈয়দ শাহ্ আল্-আমিরভাÐারী হলেন হযরত আমিরুল আউলিয়া(ক.) এর প্রদত্ত নেয়ামত,দ্যুতিময় নূরের কাচফলক।
পাঁচ বছর বয়সে তাঁর আব্বাজান মাহবুবে ইলাহী খাজা খলিলুর রহমান শাহ্(ক.) শাহ্চান্দ আউলিয়ার মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা হযরত মাওলানা নুরুল হক শাহ্(রহ্.) এর নিকট অর্পণ করেন। তাঁর কাছে আরবী, ফার্সী ও উর্দু ভাষায় বিশেষ পারদর্শিতা লাভ করেন। উক্ত মাদ্রাসায় কৃতিত্বের সাথে বিদ্যালাভের পর, উচ্চ শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে ভারত যাবার কথা তাঁর আব্বাজানের নিকট জানালে তিনি অনুমতি না দিয়ে ইনসানিয়াতের (মানবতার) ত্বরীকার খেদমতে নিয়োগ দেন। এতে বাবাজান কেবলা একাগ্রতায়, বিচিত্র বিশিষ্টতায় অনূদিত করেছেন সূফিবাদের অনন্যে।
উপমহাদেশের অনন্য সূফিসাধক,আধ্যাত্বিক জগতের এক কিংবদন্তী বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব হাদীয়ে জমান, হযরত সৈয়্যদ মুহাম্মদ আবু ছৈয়দ শাহ্ আল্- আমিরভাÐারী আধ্যাত্ববাদের মূলে গ্রষ্টার প্রতি গভীর আনুগত্যে মানব হৃদয়ে উৎকর্ষতায় আত্ম-নিবেদিত। কণ্ঠে সর্বদা উচ্চকিত গ্রষ্টার প্রেমে উন্মীলিত হওয়ার উদাত্ত আহŸান। কোমল হৃদয়ের ভালবাসার পরশ দিয়ে অবিরত ভক্ত-মুরিদানকে শুনিয়ে গেছেন অমর বাণী ‘সব সময় ভাবনা কর, তোমার সঙ্গে যাবে কি?’
পথের মাঝে রোদের প্রখরে মৃতপ্রায় শামুক কুড়াতে কুড়াতে পথচলা, পিঁপড়াদের খাদ্য দেওয়া যা রহমান মঞ্জিলের অনুগত ভক্তদের কাছে বাবাজান কেবলার নসিহত হয়ে আজো জারি আছে। প্রথমে স্বপ্নে, তারপর জাহেরে দরশন, সাহচর্যে এসেই আমূল পরিবর্তন। জাহেরি দ্বীনি শিক্ষার পর ইলমে তাছাউফ বা আধ্যাত্মিক জ্ঞানার্জনে ব্যাকুল হৃদয়ে তর সইছেনা বুঝি-
‘এক জমানা ছোহবতে বা আউলিয়া
বেহতর আজ ছদ ছালে তা আত বেরিয়া’
– (জালালুদ্দিন রুমী)
অর্থ্যাৎ এক মুহূর্তের আউলিয়ার দর্শনলাভ করা শত বছরের ত্রুটিহীন (কবুল হওয়া) ইবাদত অপেক্ষা উত্তম। একদিন রাতে বাবাজান কেবলা স্বপ্নে দেখলেন- বিশাল এক মাহফিলে সমবেত অন্যান্যদের সাথে শামিল হয়ে ওনার আব্বাজান মাহবুবে এলাহি খাজা সৈয়দ খলিলুর শাহ ( ক.) এর নিকট বাইয়াত গ্রহণ করছেন। স্বপ্নে দেখার পরে অন্য কোথাও বাইয়াত গ্রহণের চিন্তাকে বাদ দিয়ে তাঁর আব্বাজানের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। এরপরে পীরের কাছে কঠোর রেয়াজত এমনকি তাঁর আব্বাজান নিজের সন্তান বলে কোনো ধরণের সমীহও করেননি। লাঞ্চনা- বঞ্চনা, ত্যাগ তিতিক্ষায় কোনো মায়ায় টলে যায়নি। এটার অনেক দৃষ্টান্ত মানুষের মুখে ও হৃদয়ে স্থাপন করে গিয়েছেন। এমন ঐকান্তিক ও একাগ্রতায় সন্তুষ্টির ফলস্বরূপ অনেকদিন পরে খাজা খলিলুর রহমান শাহ্ (ক.) বাবাজান কেবলাকে খেলাফত প্রদান করেন। লোকজনকে মুরীদ করানোর এজাজত প্রদান করেন। এটি এই মুহূর্তে রহমান মঞ্জিলের অনেকের জন্য শিক্ষণীয় বটে। পীরের ছেলে হয়েও পীর দাবি করেননি,সামান্য মুরিদ হয়ে রেয়াজতের পরে এবং সবকিছু অর্জনপূর্বক পীর যখন হুকুম দিলেন অতঃপর নিজেকে সমর্পণ করলেন আধ্যাত্মিক প্রতিনিধিত্বে। এটাই নিয়ম। দরবারির পথে এটি ‘অ’ ও ‘ক’ পড়ার মতো ব্যাপার। কেউ যদি গুলিয়ে ফেলেন অর্থ্যাৎ ডাক্তারের ছেলে নিজেকে ডাক্তার দাবি করলে ক্লাসেও ভর্তি না হয়ে এবং কেউ যদি মূর্খতায় ঐ স্বনামে দাবি করা ডাক্তারের ছেলের কাছে যায়, রোগীর অবস্থা কীরকম হবে ভেবে দেখতেই পারেন।
আল্লামা রুমি (রহ.) বলেন- প্রত্যেক বৃত্তে জগতের আবর্তন-বিবর্তনের যুগে একজন বিশিষ্ট অলি থাকবেন। যাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষা কেয়ামত পর্যন্ত বিদ্যমান থাকবে।’ হযরত শাহসূফী সৈয়দ মুহাম্মদ আবু ছৈয়দ শাহ (ক.) সমকালীন যুগশ্রেষ্ঠ অলি ছিলেন নিঃসন্দেহে। ধরাধাম ত্যাগের পূর্বপর্যন্ত জাহেরে সাহচর্যে ত্বরীকত ও বিপথগামী মানুষকে সত্যব্রতী করেছেন। অকূল সাগরে উত্তাল ঢেউয়ে দিকহারা জাহাজের পথ বাতলে দেওয়া,সারাদেশে অসংখ্য অলিদের রওজা নির্ধারণসহ মানুষের দুরারোগ্য ব্যাধিতে মুক্তি কিংবা হাজারো মানুষের নেক নিয়ত পূরণ করেছেন এবং এখনো জায়মান। পৌষের হাড় কাঁপানো শীতে শুধু লুঙ্গি পরিহিত, অনাহার, অনিদ্রা, নির্ভোগ ও নির্লোভ অভ্যাস আয়ত্বে অধ্যাত্ম সাধনার চরম শিখরে পৌঁছেছিলেন। এই মহান অলি ভবত্যাগের একমাস পূর্ব থেকে স্বীয় প্রতিষ্ঠিত খানকা শরীফ ও মুরিদানদের এলাকায় সফরে ব্যতিব্যস্ত ছিলেন। একপর্যায়ে পাহাড়তলী নোয়াপাড়াস্থ খানকা শরীফে অসুস্থবোধে এক পড়ন্ত বিকেলে বাবাজান কেবলা কেবল বিশ্রামস্বরূপ চোখের পাপড়ি বন্ধ করলেন। উপস্থিত ভক্তগণ বাবাজান কেবলার শ্বাসপ্রশ্বাসের চলাচল না দেখে তাদের মুখগুলি বিষণ্ন ও হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ল। অধিকন্তু সময় যাচ্ছে বাবাজান কেবলার উঠার ফুরসত নেই। ভক্তদের কান্না উচ্চস্বরিত হচ্ছে। হঠাৎ বাবাজান কেবলা আল্লাহু আকবার বলে উঠে বসলে ভক্তদের চোখে বিস্ফোরণ হলো। এরপর কালুরঘাট হয়ে সফর শেষ করার আগে রাঙ্গুনিয়া সফরে এক ভক্তকে বাবাজান কেবলা বললো- আমি আর আসবো না, আমার পরে আমার তৌহিদ মিয়া (বর্তমান পীরছাহেব আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তৌহিদ শাহ্ ) আসবে,ওর সাথেই থাকো সবাই ….’ এই কথা শুনে ভক্ত স্তম্ভিত। কালুরঘাট সফর শেষে দরবারে ফিরে প্রথমে আমিরুল আউলিয়া, তারপর তাঁর পীরে মুর্শিদ খাজা খলিলুর রহমান শাহ (ক.) মাজারে জেয়ারতের শেষে স্বীয় হুজরায় প্রবেশ করে ভক্তদের নিয়ে সমবেত কণ্ঠে ‘হাবিবে রহমান মেরে বাবাজান, সাহেবে সুলতান’ পড়তে থাকেন। সুললিত কণ্ঠ দেয়ালে দেয়ালে অনুরণিত হচ্ছিল।
দুপুর পেরিয়ে সন্ধ্যা, রাত ঘনে এলো। নির্বাক, নিস্তব্ধ ও নির্নিমেষে আমিরুল আউলিয়া (ক.) এর রওজা মোবারকের দিকে চেয়ে চেয়ে কী যেন জপনা করতে লাগলেন। রাতে আমিরুল আউলিয়া (ক.) এর রওজায় নামাজ ও অজিফা শেষে দাঁড়িয়ে অঝরে অশ্রু ছেড়ে দু’হাত তুলে মেনাজাত করে স্বীয় হুজরায় ঢুকেন। রাতের গভীরে সুনসান নীরবতায় হুজরার দরজার আড়ালে তাঁর বিবি দাঁড়ালে,বাবাজান কেবলা এক ভক্তকে বলে- তোমার মা-জানকে বলো ঘুমিয়ে যেতে,কাল সকাল সকাল উঠতে হবে…. হ্যা, ঠিকই। সকাল সকাল সবাই উঠল। পাখিরাও উঠলো তবে আনন্দে কিচিরমিচির করলো না। ঠিক সুবহে সাদিকের সময় ত্বরিত গতিতে হাজত সেরে,ওজু করে স্বীয় হুজরার বিছানায় আমিরুল আউলিয়া (ক.) এর রওজামুখী তাজিমী সিজদায় জোরে জোরে কালেমায়ে তৈয়্যবা পড়তে পড়তে এই জগত পাড়ি দেন। শত সহগ্র অগণিত ভক্তদের শোকের সাগরে ভাসিয়েছে এই ধ্রæব সত্যে ভক্তের শান্ত¡না নেই। চোখে শুধুই অশ্রু ঝরাবে… দিনটি ছিলো ১৯৯৯ সালের ২১ শে সেপ্টেম্বর, ৬ই আশ্বিন১৪০৬,১১ জমাদিউসসানি ১৪২০ হিজরী। বাবাজান কেবলার এই জগত ছেড়ে যাওয়ার পরে জীবদ্দশায় তাঁর মনোনিত একমাত্র খেলাফতপ্রাপ্ত পীরছাহেব হযরতুলহাজ্ব আল্লামা শাহসূফী সৈয়দ মুহাম্মদ তৌহিদ শাহ (ম.) রহমান মঞ্জিলের দায়িত্ব গ্রহণপূর্বক বাবাজান কেবলার ওরশ শরীফ উপলক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) ও বোখারী শরীফ দেশ ছাড়িয়ে সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে… আজ, ০২ রা আশ্বিন রোজ মঙ্গলবার পীরে মুর্শিদ হযরতুলহাজ্ব আল্লামা শাহসূফী সৈয়দ মুহাম্মদ তৌহিদ শাহ (ম.) এর আখেরী মোনাজাতে ভক্তরা জড়ো হবে বাবাজান কেবলার ওরশে, বোখারী শরীফে জনসমুদ্রে প্রকম্পিত হবে আমির ভাÐার দরবার শরীফের রহমান মঞ্জিলের প্রাঙ্গন….
লেখক : প্রাবন্ধিক