স্বাধীনতার পরবর্তী প্রাথমিক শিক্ষা

1323

শিক্ষা সভ্যতার বিকাশ ঘটায় শিক্ষাই মানুষকে বন্য জীব থেকে সভ্যতার আলোয় ফিরিয়ে দিয়েছে। শিক্ষা হচ্ছে শরীর, মন ও আত্মার উন্নয়ন। একটা জাতিকে উন্নত করার প্রধান শর্ত হচ্ছে শিক্ষার উন্নয়ন। কোনো এক মনীষী বলেছেন, ‘কোনো জাতিকে ধ্বংস করতে হলে প্রথমে তার গ্রন্থাগারগুলোকে ধ্বংস করে দাও। তাহলে সে জাতি আর জ্ঞান অর্জন করতে না পেরে ধ্বংস হতে বাধ্য।’ বুদ্ধিজীবী হত্যা তার একটি নিদর্শন। ১২৫৮ সালে হালাকু খাঁ বাগদাদ নগরী ধ্বংস করলে সর্বপ্রথম তিনি ধ্বংস করেন ইরাকের সুপ্রাচীন গ্রন্থাগার। অতএব একটা জাতি দাঁড়ানোর মূল শক্তি হচ্ছে সে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা। শিক্ষাকে যদি পিলার বা স্তম্ভ বলা হয় তাহলে প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে জাতির উন্নয়নের ভিত্তিপ্রস্তর বা ফাউন্ডেশন। শুরুটা যদি ভাল হয় তবে শেষটাও ভাল হবে। তাই বর্তমান সরকার প্রাথমিক শিক্ষাকে ঢেলে সাজানোর জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করছে, যার শুরু হয়েছে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নের মাঝে। এ দেশ ছিল পরাধীন, নির্যাতনের যাতাকলে পিষ্ঠ একটি অসহায় জাতি। পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে সদ্য জিঞ্জিরমুক্ত একটা স্বাধীন জাতি পুনঃগঠনে বিভিন্ন সেক্টরের ন্যায় শিক্ষার দিকে নজর দেওয়া হয়। ১৯৭২ সালে সংবিধানে প্রাথমিক শিক্ষাকে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। গঠিত হয় ড. কুদরত-ই-ক্ষুদা শিক্ষা কমিশন। ১৯৭৩ সালে প্রাথমিক শিক্ষা অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়। ১৯৭৩ সালে ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ ও ১,৫৭,৭৪২ জন শিক্ষককে সরকারি করা হয়। বর্তমান সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে এস.ডি.জি (সাসটেইনএবল ডেভেলপমেন্ট গোল) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য ২০১৫ সাল হতে কাজ শুরু করেছে। এস.ডি.জি হচ্ছে মানুষ এবং পৃথিবীর সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার একটি বৃহৎ পরিকল্পনা যাতে রয়েছে ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা ও ১৬৯ টি টার্গেট যার চতুর্থ লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে ন্যায্য ও মানসম্মত এবং সবার জন্য আজীবন শেখার সুযোগ সৃষ্টি করা।
মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে ২৬১৯৩ টি স্কুল ও ১,০৩,৮৪৫ জন শিক্ষকের চাকুরী জাতীয়করণ করা হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে বিভিন্ন ধরনের বরাদ্দ প্রদান করা হচ্ছে। প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি চালু ও প্রাক প্রাথমিক শ্রেণির জন্য প্রতি বছর বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। ৫+ হতে ১০+ বছর বয়সের সকল শিশু বিদ্যালয়ে ভর্তি এবং নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই বিনামূল্যে বিতরণের জন্য শতভাগ বই বিদ্যালয়ে পৌঁছে যাচ্ছে।
১. ঝড়েপড়া রোধ, শতভাগ শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি প্রদান ও স্কুল ফিডিং এর ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
২. ২০১১ সালে কারিকুলাম পরিবর্তন-পরিমার্জন করা হয়।
৩. অভিন্ন প্রশ্নপত্রে সমাপনী পরীক্ষা চালু করা হয় ।
৪. শিক্ষা বিভাগের সকল অফিসে ইন্টারনেটসহ কম্পিউটার প্রদান করা হয়। ই মনিটরিং সিস্টেম চালু করা হয়।
৫. ডিজিটাল পাঠদান নিশ্চিত করার জন্য ওঈঞ প্রশিক্ষণ জোরদার হরা হয়।
৬. শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ১৮ মাসব্যাপী ডিপিএড কোর্স চালু করা হয় এবং ৭১ টি পিটিআইকে আধুনিক ও যুগোপোযোগী করার জন্য ভিডিও কনফারেন্স ডিভাইজ স্থাপন করা হয়।
৭. ওঈঞ গুলোতে প্রশিক্ষণ আরো জোরালো করা হয়েছে।
৮. নীডবেইজ সাব ক্লাস্টার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
৯. লেসন স্টাডি বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
১০. শিক্ষা সপ্তাহ পালনের মাধ্যমে বিভিন্ন ক্যাটাগরীতে যোগ্যদের মূল্যায়ন করার সুযোগ সৃষ্টি হয়- যা সবাইকে দায়িত্ব পালনে আরো তৎপর করে।
১১. বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজনের মাধ্যমে শিশুদের খেলাধুলার প্রতি আগ্রহী করে তোলে- যা তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে ভূমিকা পালন করে।
১২. স্টুডেন্ট কাউন্সিল গঠনের মাধ্যমে শিশুদের মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা ও ভবিষ্যত নেতৃত্ব তৈরি করার প্রয়াস চলছে।
১৩. বর্তমান সময়ে বিভিন্ন ধরনের বরাদ্দ যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি ছাত্র অনুপাতে সিøপ বরাদ্দও বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বিদ্যালয়গুলো প্রতিবছর চাহিদা অনুযায়ী কাজ করতে পারছে যা আকর্ষণীয় শিশুবান্ধব বিদ্যালয় তৈরিতে ভূমিকা রাখছে।
১৪. বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থীদের দেওয়া হচ্ছে শিক্ষা উপকরণ ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী।
১৫. সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য আনন্দস্কুল ও উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
১৬. ২০১০ সালের শিক্ষানীতি অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করা হয়।
১৭. প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদা দেওয়া হয় ।
১৮. পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে নন ক্যাডার পদে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে পদায়নের ফলে প্রাথমিক শিক্ষার ভিত আরো সুদৃঢ় হচ্ছে।
১৯. টিএসএন ( টিচার্স সাপোর্টিং নেটওয়ার্ক ) এর মাধ্যমে শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়ন হচ্ছে।
২০. ন্যাপের মাধ্যমে শিক্ষক ও কর্মচারীদের উন্নত প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
২১. চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে ।
২২. উপজেলাভিত্তিক বিভিন্ন ইনোভেটিভ কার্যক্রম যেমন স্টুডেন্ট অব দা ডে, সততা স্টোর, মহানুভবতার দেয়াল, বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার বিতরণ, ক্ষুধে ডাক্তার টিম, বঙ্গবন্ধু কর্নার, মোবাইল মাসি, শহিদ মিনার স্থাপন, জাতীয় দিবস পালন, বিজয় ফুল প্রতিযোগিতা, মৌসুমি প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম চালু আছে।
২৩. শিক্ষকদের পাঠদান আকর্ষণীয় ও ফলপ্রসু করার জন্য শিক্ষাক্রম শিক্ষক সংস্করণ, ও শিক্ষক সহায়িকাসহ বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণের জোরালো ভূমিকার কারণে আজ প্রাথমিক শিক্ষা প্রচলিত তথাকথিত কেজি স্কুল ইংরেজি মাধ্যমের চেয়ে অধিক স্থায়ী ও শিশুবান্ধব।
২৪. ডিজিটাল হাজিরা চালুর মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষকদের সঠিক সময়ে আগমন প্রস্থান শতভাগ নিশ্চিত করার পদক্ষেপ এক যুগান্তকারী ঘটনা।
পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ, অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য দূর করে, প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা বাস্তবায়ন প্রাথমিক শিক্ষার সাফল্যের দ্বার উন্মোচন করবে বলে আশা করা যায়।

লেখক : সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার, সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম