স্বপ্নগুলো বেঁচে থাকুক

12

কাজী আবু মোহাম্মদ খালেদ নিজাম

মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। সব ধরনের মানবিক গুণাবলী দিয়ে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। মানুষই আদর্শ সৃষ্টি। সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ এই পৃথিবীকে গড়েছে। বলতে গেলে সব মানুষই তাদের জীবনযাপনে নানা ধরনের কাজে জড়িয়ে পড়ে। চেষ্টা করে সবকিছু গুছিয়ে একটি সুন্দর জীবন গঠন করতে। তাই জীবন গঠনের বাঁকে বাঁকে মানুষ নানা স্বপ্ন দেখে। বড় লোকের বড় স্বপ্ন, মধ্যবিত্ত ও অসচ্ছল মানুষেরও থাকে স্বপ্ন। উচ্চ বিত্তের স্বপ্নের শেষ নেই। কিন্তু ছোট ছোট স্বপ্ন দেখে জীবন গঠনের চেষ্টা করে মধ্যবিত্ত ও অসচ্ছল কিংবা নিম্ন আয়ের মানুষ। আসলে আর্থিক সংগতিহীন মানুষের তেমন স্বপ্ন থাকেও না। এই দুর্মূল্যের বাজারে তাদের সব স্বপ্নের মৃত্যু ঘটে নিমিষেই।
মানুষের নানা স্বপ্ন, নানা ইচ্ছা থাকে কিন্তু ক’জনেরই বা সেই স্বপ্ন পূরণ হয়! আবার এটাও মানতে হবে, যে লেগে থাকে, সে এক সময় সফল হয়। কাঙ্ক্ষিত সাফল্য না এলেও এর কাছাকাছি হলেও কিছুটা আসতে পারে। এটাই সবচেয়ে বড় সফলতা। এই সফলতা নিয়েই কেউ গর্ব করতে পারে যে এটাই তার স্বপ্ন, এটাই তার ইচ্ছা।
অসহায় মানুষের স্বপ্ন থাকে কীভাবে দু’বেলা দুমুঠো অন্ন জোগাড় করে জীবন পার করা যায় সেটা। তাদের স্বপ্নের পরিধি বেশিদূর এগোয় না। স্বপ্ন দেখতে দেখতেই তাদের বেলা শেষ হয়ে আসে। তাদের হয়তো স্বপ্ন থাকে পরিবারের জন্য কষ্টের আয় দিয়ে ঝুপড়ি ঘরটা মেরামতের, বাচ্চা থাকলে ঈদে তার জন্য একটি স্বল্পমূল্যের নতুন জামা কেনার অথবা বছর ছ’মাসে একবেলা খাবার পেটপুরে খাবার বা জমানো খুচরো পয়সা দিয়ে সাধ্যের ভেতর একটা নতুন জিনিস কেনার। দিনে আনে দিনে খায় এমন মানুষের স্বপ্ন থাকে খেয়ে পরে একটু বেঁচে থাকার। যারা ট্রলি, রিকশা চালায় তাদের হয়তো একটি স্বপ্ন থাকে নিজের একটা ট্রলি/রিকশা হবে। সেটা দিয়ে সে রোজগাড় করবে। বউ, ছেলেমেয়েকে নিয়ে একটু শান্তিতে ঘুমাবে। বড় স্বপ্ন সেতো কল্পনায়! সন্তানদের পড়ালেখার কথা বাদই দিলাম। পড়ালেখা করলেও স্কুলে নিয়মিত আসা কিংবা খাবার খেয়ে আসা সম্ভব হয়না। অনেক স্কুলে এমন কিছু বাচ্চাও রয়েছে যারা কিনা প্রতিদিন ভরপেটে খেতে পায়না বা উপোষ থেকেই স্কুলে আসে! তাদের আবার স্বপ্ন! এসব দেখলে মন কাঁদে।
নিম্ন আয়ের মানুষ তাদের স্বপ্নকে বড় করে দেখতে পারে না। সীমাবদ্ধতার কারণে তাদের স্বপ্ন বাড়তে পারে না। মধ্যবিত্ত মানুষও স্বপ্ন দেখে। কিন্তু তাদের কষ্টটা অন্য অনেকের চেয়ে বেশি। তারা তাদের কষ্টটুকু কাউকে বুঝাতে পারে না। মুখ বুজে সহ্য করতে হয়। তারা স্বপ্ন দেখে, হয়তো তার আয় দিয়ে সন্তান মানুষ করবে, পরিবারকে একটু ভালোভাবে চালাবে। কিন্তু সাধ্যে কুলোয় না। মাস শেষে যা বেতন/মজুরি পায় তা দিয়ে সংসারে টানাটানি দেখা দেয়। চরম অভাবের সংসার না হলেও বড় স্বপ্ন দেখতে পারেনা ওরাও। হাতে গোনা দু’একজন তাদের ব্যতিক্রম। তাও বড়লোকের স্বপ্নের মতো নয়। নিজের সাধ্যের মধ্যে যতটুকু ততটুকুই। স্বপ্নবাজ মানুষ হয়তো স্বপ্ন দেখতেই পারে। কিন্তু যারা ছোট ছোট স্বপ্ন দেখে তাদের জীবনের চলার পথ মসৃণ নয়। স্বপ্নের বাস্তবায়ন করতে চাইলেও তা সম্ভব হয় না। কিন্তু স্বপ্ন দেখতে কোন দোষ নেই। মধ্যবিত্ত ও অসহায় মানুষ বড় স্বপ্ন দেখতেও ভয় করে। ছোট ছোট স্বপ্নের মাঝেই তাদের আনাগোনা। তাদের সম্ভাবনার সেই ছোট ছোট স্বপ্নগুলোও বিভিন্ন দৈবদুর্বিপাকে অনেক সময় অদৃশ্য হয়ে যায়। চোখের আড়াল হয়। চলে যায় সীমানার বাইরে। ছোট ছোট স্বপ্নগুলোও অনেক সময় সুখের হয় যখন তা বাস্তবায়নের আশা জাগে। আশা জাগে নতুন করে বাঁচার। কিন্তু তাও যদি ভেঙে খান খান হয় তাহলে জীবনটাই বিষাদে ভরে উঠে। মানুষের ছোট ছোট স্বপ্নগলোকে বাঁচাতে সমাজ ও রাষ্ট্র পৃষ্ঠপোষকতা করতে পারে চাইলে। সামর্থ্যবান মানুষ এবং আত্মীয়-স্বজনও চাইলে এগিয়ে আসতে পারেন। আমরা সবার জন্য দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখি। কিন্তু শুরুতেই যদি অসহায় মানুষের ছোট ছোট স্বপ্নগুলো নষ্ট হয়, বড় হতে না দিই তাহলে তা কেবল মুখের বুলিতেই থেকে যাবে।
জীবন গঠনে স্বপ্ন হয়তো উল্টোটাই হতে পারে। সে জন্য হতাশ কিংবা অসহায়ত্ব বোধ করার কোন কারণ নেই। জীবনকে কেবল স্বপ্নের বাহুডোরে না বেঁধে সম্মুখপানে এগিয়ে যেতে হবে। কষ্ট সহ্য করে যা অর্জন করা সম্ভব হয় তাকেই স্বপ্ন ধরে নিতে পারি! হয়তো আল্লাহ আমার জন্য এতটুকুই নির্ধারণ করেছেন। সেজন্য জীবনকে বাস্তবতার নিরিখে গড়ে তোলার কোন বিকল্প নেই। এই লেখায় আমি মূলত: খেটেখাওয়া, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের স্বপ্ন কী হতে পারে সে সম্পর্কে আলোচনার চেষ্টা করেছি। আসুন, ছোট ছোট স্বপ্ন দেখা এই মানুষগুলোকে শ্রদ্ধা জানাই। চাই তাদের স্বপ্নগুলো বাস্তবে রূপ লাভ করুক। বেঁচে থাকুক তাদের স্বপ্নগুলো।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট