সাগরে ঘূর্ণিঝড়ের ঘনঘটা বাড়ছে

58

চলতি মৌসুমে সাগরে যেন ঘূর্ণিঝড়ের বান ডেকেছে! এক ঘূর্ণিঝড় থাকতে থাকতেই আরও এক ঘূর্ণিঝড়। একটির নাম ‘কিয়ার’, অন্যটি ‘মহা’। বলা যায়, জোড়া ঘূর্ণিঝড়। মৌসুমে এই নিয়ে চার-চারটি ঘূর্ণিঝড় হয়ে গেল আরব সাগরে। এখানকার ঘূর্ণিঝড় অবশ্য বাংলাদেশ ও প্রতিবেশি ভারতের তেমন ভয় পাওয়ার নয়। কারণ, বেশিরভাগই ওমান-ইয়েমেনের দিকে সরে যায়। তাও দুর্বল অবস্থায়। ভয় সব বঙ্গোপসাগরে। চলতি নভেম্বরের প্রথম পক্ষেই বঙ্গোপসাগরে একটি নি¤œচাপ শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়ার আভাস মিলেছে।
আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণকারী দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার পূর্বাভাস বলছে, ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’ পরবর্তী দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু বা বর্ষা-বিদায়ের পর বঙ্গোপসাগর লঘুচাপের উত্থান-পতনের মধ্য দিয়েই যাচ্ছে। তবে আপাতত শান্ত থাকলেও চলতি নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আন্দামান সাগরে সৃষ্ট একটি নিম্নচাপ আটচল্লিশ ঘন্টার ব্যবধানে বাঁক নিয়ে হাজির হতে পারে বঙ্গোপসাগরে। আর সেটি গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়ে রূপ নিতে পারে ঘূর্ণিঝড়ে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, আগামী ৩ নভেম্বর নাগাদ আন্দামান সাগরে একটি নিম্নচাপ সৃষ্টি হবে। তার ৪৮ ঘণ্টা পর পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগরে পৌঁছে গভীর নিম্নচাপে পরিণত হতে পারে। এমনিতে অক্টোবর-নভেম্বরে আন্দামানের কাছাকাছি নিম্নচাপ সৃষ্টি হলে তা ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়ার প্রবণতা বেশি থাকে। এক্ষেত্রে কি হবে তা এখনও স্পষ্ট না হলেও চোখ রাখতেই হচ্ছে বঙ্গোপসাগরেও। সেই হিসেবে আগামী ৮ নভেম্বর থেকে ১৩ নভেম্বরের মধ্যে দেশে আসতে পারে একটি বৃষ্টিবলয়।
অধিদপ্তরের ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্রের আবহাওয়াবিদ মো. আরিফ হোসেন পূর্বদেশকে বলেন, মৌসুমী বায়ু বিদায় নিয়ে প্রকৃতিতে এখন ঋতুর পালাবদলের সন্ধিক্ষণ চলছে। আমাদের দেশে আবহাওয়া ও জলবায়ুগত যে বৈশিষ্ট্যসমূহ বিদ্যমান রয়েছে, তার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অক্টোবর-নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড় হয়। তার মানে আবার এটা নয় যে, ঘূর্ণিঝড় হবেই। তবে প্রকৃতিতে যে তথ্য-উপাত্তগুলো বিদ্যমান তাতে ঘূর্ণিঝড় হওয়ার দিকেই বেশি নির্দেশ করছে। বর্র্তমানে লঘুচাপের বর্ধিতাংশ উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। তবে, আগামী ৪৮ ঘন্টা বা দু’দিনের আবহাওয়া পূর্বাভাসে উত্তর আন্দামান ও তৎসংলগ্ন এলাকায় একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হতে পারে।
আবহাওয়াবিদদের মতে, জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণে আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি নিজের বৈশিষ্ট্য ও আচরণে বর্ষপঞ্জিকা বা ক্যালেন্ডারে ছাপানো মাসভিত্তিক ঋতু বা কালের হিসাব মেনে চলাকে শিকেয় তুলে রেখেছে সেই কবে। মৌসুমের হিসাবেও সময়ের চেয়ে অসময়ের চর্চাই বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাই বলে দু’মাস বয়সী আস্ত একটা ঋতুই হাওয়া হয়ে যাওয়া নিশ্চয়ই বড় ধরণের ব্যতিক্রম। এবার সেটাই ঘটেছে। ‘তালপাকা’ ভাদ্র পেরিয়ে আশ্বিনের বিদায়ের দিনেই পরিপূর্ণভাবে বিদায় নিয়েছে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু অর্থাৎ বর্ষা। তার প্রভাবে শরতের নীলাকাশে সাদা মেঘের ভেলার বদলে কৃষ্ণমেঘ আর হঠাৎ গগণবিদারী বজ্রপাতকে সঙ্গী করে নেমে এসেছে বৃষ্টিধারা। আস্ত শরতই হাওয়া হয়ে গেল রেকর্ড ভাঙা বিলম্বিত বর্ষার পেটে। গত ৫৮ বছরে এত দেরিতে মৌসুমি বায়ুর প্রস্থান ঘটেনি। তবে মৌসুমি বায়ুর দেরিতে প্রস্থান এটাই প্রথমবার নয়। গত আট বছরে অন্তত চারবার নির্ধারিত সময়ের চেয়ে দেরিতে প্রস্থান ঘটেছে মৌসুমি বায়ুর। যার ফলে মৌসুমি বায়ুর স্বাভাবিক গতিবিধি নিয়েও ভাবনার অবকাশ তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন আবহাওয়াবিদরা। এর আগে মে মাসের শেষের দিকে বঙ্গোপসাগর থেকে টেকনাফ উপকূল দিয়ে দেশে প্রবেশ করত দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু। তাতেই যাত্রা শুরু করত দেশের সবচেয়ে বড় বর্ষা ঋতু। বাদল ধারার এই ঋতুর বিদায় ঘটত সেপ্টেম্বরের শেষে এসে। এখন বর্ষা শুরু হতেই জুনের মাঝামাঝি সময় লেগে যাচ্ছে। মৌসুম শেষ হচ্ছে অক্টোবরে এসে। এবার জুনের প্রথম সপ্তাহেই মৌসুমি বায়ু টেকনাফ উপকূল দিয়ে দেশে প্রবেশ করলেও বর্ষার বিরামহীন বৃষ্টি শুরু হয়েছিল একটু দেরিতে। ২০ জুন চট্টগ্রামসহ সারাদেশে বর্ষা সক্রিয় হয়।
এদিকে, হেমন্তের শৈশবে বিরাজমান আবহাওয়ার গতিবিধি দেখে আবহাওয়াবিদদের কেউ কেউ এমনও মনে করছেন, এবার বর্ষা কয়েক দশকের রেকর্ড ভেঙে বড্ড দেরিতে বিদায় নিলেও শীত ঋতু অনেকটা সময় মেনেই অতিথি হতে চাইছে বাংলাজুড়ে। দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করা শীত সাগরে ঘূর্ণিঝড়ের ঘনঘটা আর নি¤œচাপ-লঘুচাপের বাধা পেরিয়ে চৌকাঠ মাড়িয়ে ঘরে ঢোকার আয়োজন করবে। যদিও ষড়ঋতুর দেশে হেমন্ত মানেই প্রকৃতিতে শীতের আগমনী বার্তা। পালাবদলের এ দোলায় কেবল জীবজগতই নয়, গা ভাসায় বৃক্ষরাজীও। বদলে যায় মানুষের জীবনধারা। ঝরে পড়ে গাছের পত্রপল্লব। শহর কিংবা গ্রামে ধুনকরদের ব্যস্ততা বাড়ে। লেপ-তোষক তৈরি বা মেরামত কিংবা শীত মোকাবেলার উপযুক্ত সময় হেমন্ত। প্রকৃতিতে তাই এখন ধানের ডগায় কিংবা দুর্বাঘাসের মাথায় জমছে শিশির বিন্দু। নদী অববাহিকায় নামছে হালকা কুয়াশার চাদর। কাল বা ঋতুচক্রের হিসাবে পৌষ-মাঘ দুই মাস শীতকাল হলেও দেশে শীত শুরু হয় কার্তিকের মাঝামাঝি থেকে। শরতের বিদায়, হেমন্তের আবির্ভাব। দিনের দৈর্ঘ্য হ্রাস। রাতের তাপমাত্রা কমতে থাকা।
উল্লেখ্য, এর আগে ২০১৯ সালে ফণী ও বায়ু আঘাত হেনেছিল। যদিও এ দুটি ঘূর্ণিঝড় দেশের ওপর বড় ধরণের ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারেনি। তার আগে ২০১৮ সালে ভারতের উড়িষ্যায় তিতলি, ২০১৭ সালে মোরা, ২০১৬ সালে রোয়ানু, ২০১৫ সালে কোমেন এবং ২০১৩ সালে মহাসেন দেশের উপকূলীয় জেলাগুলোতে ভয়ঙ্কর তান্ডবলীলা চালিয়েছিল।