সময় দিন, বদলে দেব চট্টগ্রাম

107

চট্টগ্রামের পাঠকনন্দিত-নান্দনিক পত্রিকা দৈনিক পূর্বদেশ আজ ৮ বছরে পা দিয়েছে। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে পূর্বদেশ এর মুখোমুখি হয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। নগর ও নাগরিকের প্রতি দায়িত্ব, নাগরিক সেবার পূর্ণ বাস্তবায়নে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথাও বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক ওয়াসিম আহমেদ

পূর্বদেশ : নগরপিতা হিসেবে চট্টগ্রামকে কেমন দেখতে চান?
মেয়র : সবুজে ছুঁয়ে যাওয়া একটি পরিচ্ছন্ন আধুনিক শহর হিসেবে চট্টগ্রামকে দেখতে চাই। তবে তার জন্য সময়ের প্রয়োজন। কেননা বছরের পর বছর অপরিকল্পিতভাবে চট্টগ্রাম গড়ে উঠেছে। তাই শহরটিকে মোটামুটি পরিকল্পিত হিসেবে গড়তে সময়ের প্রয়োজন। ইতোমধ্যে বদলে যাওয়া শুরু হয়েছে। সময়ের সাথে নগরবাসী পূর্ণাঙ্গ স্বাদ নিতে পারবে। সময় পেলে বদলে দিব চট্টগ্রাম।
পূর্বদেশ : নগরপিতার দায়িত্ব পালন করছেন প্রায় সাড়ে চার বছর হলো। এই সময়ে কি বদলে দিতে পেরেছেন বলে মনে করেন?
মেয়র: সিটি মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর চট্টগ্রামকে ‘ক্লিন সিটি, গ্রিন সিটি’ হিসেবে গড়তে কাজ করে যাচ্ছি। আমি হলফ করে বলতে পারবো, আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় নগরী এখন পরিচ্ছন্ন। কেননা ‘ডোর টু ডোর’ প্রকল্পের অধীনে ২ হাজার পরিচ্ছন্নকর্মী প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বর্জ্য সংগ্রহ করে। আগে ডাস্টবিনের বেশিরভাগ ছিল মূল সড়কে। ফলে মানুষ দুর্গন্ধে হাঁটতে পারতো না। সেই যন্ত্রণা থেকে নগরবাসীকে মুক্ত করতে সড়ক থেকে সরিয়েছি প্রায় ৮২৫টি ডাস্টবিন। আরও ৬০০ এর মতো রয়েছে, সেগুলোও পর্যায়ক্রমে সরানো হবে। মানুষ জায়গা দিচ্ছে না। কেননা কেউ চায় না ডাস্টবিনটা তাদের এলাকায় হোক। ফলে জায়গা সংকটের কারনে সময় নিতে হচ্ছে। অন্যথায় এতোদিনে একটা ডাস্টবিনও সড়কে থাকতো না।
পূর্বদেশ : আপনি পূর্ববর্তী সকল মেয়রের তুলনায় প্রায় চারগুণ প্রকল্প বেশি পেয়েছেন। কিন্তু প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের কারনে দৃশ্যমান উন্নয়ন কতটুকু ?
মেয়র: চট্টগ্রামের লালদিঘীতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের উন্নয়নের ভার নিয়েছিলেন। এরপর থেকে চট্টগ্রামকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। আমার চারবছরে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আরও প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। বিগত বিশবছরে সিটি কর্পোরেশন যত প্রকল্প পেয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি। তবে আমি প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে শুধু আমাদের স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দিকে তাকিয়ে থাকিনি। বিএমডিএফ, জাইকা ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয় থেকেও প্রকল্প অনুমোদনে সচেষ্ট ছিলাম। তারই ফলশ্রুতিতে প্রকল্পের অংকটা বেড়েছে। তবে বাস্তবায়নের নির্দিষ্ট একটি মেয়াদ রয়েছে। সেই সময়ের মধ্যে শেষ করা অনেক কঠিন। কেননা প্রকল্পের কাজ শুরু করতে যে পরিমাণ প্রশাসনিক ‘ফরমালিটি মেইনটেইন’ করতে হয়, তাতে বছর চলে যায়। তাছাড়া আবহাওয়ার প্রভাব ও অর্থছাড়ের বিষয়তো রয়েছেই। তবে আগের তুলনায় অর্থছাড়ে গতি বেড়েছে। এরই মধ্যে প্রকল্পগুলোর সবমিলিয়ে প্রায় ৬০ শতাংশ কাজ শেষ। বাকিটা পুরো শেষ করতে সময় লাগবে আরও বছর তিনেক। তখন নগরীতে একটি দৃশ্যমান উন্নয়নের সুফল ভোগ করতে পারবে নগরবাসী। নগরবাসী সাথে থাকলে কোনো চ্যালেঞ্জই চ্যালেঞ্জ নয়, যেকোনো লক্ষ্যকে ছুঁয়ে যেতে পারবো।
পূর্বদেশ : সিটি কর্পোরেশনের আইন অনুযায়ী আপনার মূল কাজ তিনটি। নালা-নর্দমা ও সড়ক সংস্কার, পরিচ্ছন্নতা এবং শহর আলোকিত করা। এই তিনটি কাজে আপনি আপনাকে কিভাবে মূল্যায়ণ করবেন?
মেয়র: নগরীতে আলোকায়নযোগ্য সড়ক রয়েছে ১ হাজার ১৮৪ কিলোমিটার। তারমধ্যে মোট ১ হাজার ৪৩ কিলোমিটার সড়কে বাতি রয়েছে। অর্থাৎ অবশিষ্ট রয়েছে ১৪১ কিলোমিটার। গত ৯ জুলাই এলএইডি বাতি স্থাপনের জন্য ২৬১ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। এই প্রকল্পের অধীনে ৪৬৭ কিলোমিটার সড়কে সোডিয়াম বাতির বদলে বসানো হবে এলইডি বাতি। তবে ওই সরানো সোডিয়াম বাতিগুলো নগরীর অবশিষ্ট সড়ক ও নতুন আবাসিকে সংযোজন করা হবে। ফলে অবশিষ্ট নগরীর সবক’টি সড়কে বসবে বাতি। এর মাধ্যমে শতভাগ আলোকায়নের পথে যাচ্ছে সিটি কর্পোরেশন। আগে সোডিয়াম বাতি দিয়ে শহরে আলোকায়নের ব্যবস্থা করা হতো। আমার আমলে নগরীতে প্রথম এলইডি ‘কনসেপ্ট’ প্রয়োগ করি। যেটাতে বিদ্যুৎ খরচ অনেকাংশে কম, আলো বেশি ও ব্যবস্থাপনা খরচ তুলনামূলক অনেক কম। অনুমোদিত প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে প্রায় ৬০ শতাংশ সড়কে এলইডি বাতি বসবে। বাকিগুলোকে পর্যায়ক্রমে এলইডির আওতায় আনা হবে। আর যেখানে বাতি নেই বা নতুন সড়ক তৈরি হয়েছে, সেখানে সরানো বাতিগুলো বসানো হবে। অন্যদিকে পরিচ্ছন্নতার কথা আগেই বলেছি। এবার নালা ও সড়ক সংস্কারের কথা বলি। নগরীতে ১ হাজার ৩০ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। এসব সড়কের পুরোটাই পাকা হওয়ার পথে। ইতোমধ্যে কয়েকটি প্রকল্পের ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষের দিকে। আবার নগরীর সড়ক নেটওয়ার্ক উন্নয়নে ১ হাজার ২৩০ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এই প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়েছে ২০১৭ সালের সার্ভের উপর। এরমধ্যে নতুন সড়ক তৈরি হয়েছে বিভিন্ন আবাসিকে। এছাড়াও এয়ারপোর্ট রোড সম্প্রসারণ ও ড্রেন তৈরিতে ২ হাজার ৭ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। প্রকল্পটির বাস্তবায়ন সম্ভব হলে আর কোনো সড়ক কাঁচা থাকবে না। আমি শুধু তথ্য তুলে ধরলাম। মূল্যায়নের ভার নগরবাসীকে দিলাম।
পূর্বদেশ : নগরীতে গণপরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা আনতে ‘মেট্রোরেল’ প্রকল্পের উদ্যোগ নিয়েছেন। সেই উদ্যোগের কি অবস্থা?
মেয়র: মেট্রোরেল চট্টগ্রাম নগরীর জন্য অপরিহার্য একটি গণপরিবহন ব্যবস্থা। তবে সেটা আগে কেন করা হয়নি তা আমার বোধগম্য নয়। কেননা সবার প্রথমে মেট্রোরেল করা উচিত ছিল। আমি দায়িত্বে আসার পর থেকে মেট্রোরেল নিয়ে কাজ করছি। সর্বশেষ আমরা নগরীতে মেট্রোরেল নিয়ে প্রাক-প্রাথমিক সম্ভাবতা যাচাই করেছি। আরও অধিকতর যাচাইপূর্বক প্রকল্পটি আমরা মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করবো। এছাড়াও আমার উদ্যোগে আগামি মাসের মথ্যে গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে ১০০টি এসি বাস নামছে।
পূর্বদেশ : জনসংখ্যা বাড়ছে কিন্তু শহর/শহরের আয়তন বাড়ছে না। জনসংখ্যার এই চাপ সামলাতে সিটি কর্পোরেশরে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?
মেয়র: চট্টগ্রামের অহংকার পূর্ববর্তী প্রয়াত মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী শহরের আয়তন বাড়াতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আইনী জটিলতার কারণে সেটি আটকে যায়। এখনও জটিলতা চলছে। তবে আমি মনে করি, শহর না বাড়ানো হলে চাপের মুখে উন্নয়নের স্থায়িত্ব কমে যাবে। তাই শহরের আয়তন বাড়ানো উচিত।
পূর্বদেশ : সারা দেশে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে সুনাম রয়েছে। আপনার সময়ে এই সুনাম কতটুকু অক্ষুন্ন থেকেছে বলে মনে করেন?
মেয়র: সারাদেশে কোনো সিটি কর্পোরেশনের এমন সুনাম নেই। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে নগরবাসীর শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় কাজ করে যাচ্ছে। এরজন্য প্রতিবছর প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা ভর্কুকি দিতে হয়। মূল কাজের বাইরে গিয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠির জন্য কর্পোরেশনের সেবা খাত বাড়িয়েছি। আমার দায়িত্বপালনকালীন সময়ে পাঁচটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নতুন করে অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়াও অনেকগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নতুন ভবন ও ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ করা হয়েছে। মূলত একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষার উপর জোর দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষক সংকট থাকায় নতুন করে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও প্রতিটি ওয়ার্ডে দরিদ্রদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ৪১ হাজার মানুষকে মেয়র হেলথ কার্ড দেওয়া হবে। যার ফলে বিশাল সংখ্যার এই মানুষগুলো সম্পূর্ণ বিনামূল্যে চিকিৎসা নিতে পারবেন।
পূর্বদেশ : আপনাকে ধন্যবাদ।
মেয়র: প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে পূর্বদেশ পরিবারের সবাইকে শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।